মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা কিছু কথা
একজন জুনিয়র শিক্ষক হওয়ার সুবাদে অনেক কিছু অবলোকন করতে পারি খুব সহজেই। কারণ আমার সদ্ভাব সবার সাথেই। প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে ষ্টাফদের সাথে পর্যন্ত। মাঝে মাঝে অন্যান্য বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথেও সুযোগ হয় কথা বলার। বিশেষ করে সবার সাথে কথা বলার একমাত্র কারণ তাঁদের কাছ থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করা । কারণ আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, শিক্ষকতা এমন এক মহৎ পেশা যেখান থেকে প্রচুর সম্মান পাওয়া যায়। যা অন্যান্য পেশা থেকে পাওয়া সম্ভব নয়। ছোট বেলা থেকে কখনও কোন চাওয়া পূরণ হয়নি। ছিলনা আমার জীবনের কোন লক্ষ্য। একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও লেখাপড়া করা লাগতো মায়ের বকুনির কারণে। খেলাধুলায় প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল আমার। পড়াশুনার কথা শুনলেই আমাকে খুঁজে পাওয়া যেতনা। মা প্রায়ই বলতেন, লেখাপড়া করবিনাতো পরের বাড়ীতে চাকরের কাজ করতে হবে। আমি তাই মেনে নিতাম কোন কিছু না বুঝে। পরবর্তীতে যখন জীবনের মানে কিছুটা হলেও বুঝতে পারলাম তখন থেকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি আমার। যতদূর মনে পড়ে; আমার জীবনের মোড়টা ঘুরে যায় চতুর্থ শ্রেণীতে পড়া অবস্থায়। একান্ত বাধ্যগত ছাত্র হয়ে যায় সেই শ্রেণী থেকেই। কিন্তু আমার অত্যন্ত আফসোস এটুকুই আমার কোন শিক্ষক আমার জীবনের মানে, আমার জীবনের লক্ষ্য নিয়ে কখনই কোন আলোচনা করেন নি। তাঁদের দেখেছি একই রূপে। ইংরেজী শিক্ষক মানে প্রচণ্ড রাগারাগি। গণিতের শিক্ষক মানে বেত্রাঘাত। ধর্মীয় শিক্ষক মানে উদারনীতি। সমাজ বা বিজ্ঞানের শিক্ষক মানেই গল্প অথবা ঘুম। যখন মাধ্যমিক পর্যায়ে লেখাপড়া করি তখন বরাবরের মতোই শ্রেনীর দ্বিতীয় বালক। জানার আগ্রহ ছিল প্রচুর। কিন্তু কোন প্রশ্ন করলে তার সদুত্তর কখনও কখনও কোন কোন শিক্ষকের নিকট থেকে পেতাম কখনও কখনও পেতাম না। খুব খারাপ লাগতো আর খুঁজে বের করার চেষ্টা করতাম আমার প্রশ্নের উত্তর। তারপরের ইতিহাস শুধু নাই নাই আর নাই। বাবা গরীবের দলে পড়ে গেলেন তাঁর সরলতার কারনে। আমার লেখাপড়া বন্ধ হবার উপক্রম। পরের বাড়ীতে একবেলা কাজ করি আর পড়ি। একবেলা কাজ করার পর মন চাইতো একটু বিনোদন। কিন্তু সে বিনোদন মানে আমার কাছে ছিল খেলাধুলা। মা একদিন শপথ করালেন যেন আর না খেলতে যাই। তাঁর কাছে খেলাধুলা ছিল ধনীদের ছেলেপুলের জন্য। আমার খেলা বন্ধ হয়ে গেল। বন্ধুরা যারা ছিল তারা আমার সাথে মেশা বন্ধ করে দিল। যাইহোক, এভাবে কষ্টেশিষ্ঠে যখন একটু একটু করে এগুচ্ছি ঠিক তখন পেশা হিসেবে নিলাম টিউশনিকে। টিউশনির টাকা দিয়ে পড়াশুনা চালাতে লাগলাম। বাবার যা রোজগার ছিল তা দিয়ে পেটের খাবারই কোনরকম হতো। ইতোমধ্যে এলাকার বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দৃষ্টি আকর্ষন করতে সক্ষম হলাম। তিঁনিই দিলেন আমার প্রথম সুযোগ এই মহান পেশায় নিযুক্ত হতে। আমি তাঁর কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ রইবো এই একটি কারণে। শুরু হয়ে গেল আমার স্বপ্ন দেখা আর স্বপ্নপূরণের। নিজে নিজে শপথ করলাম আমি যা যা পাইনি আমার শিক্ষকদের কাছ থেকে তা আমার ছাত্র-ছাত্রী যারা হবে তাদের দিয়েই আমি পূরণ করে নেব। বয়স আমার অল্প হলেও একান্ত ইচ্ছাশক্তির বলে খুঁজে বের করলাম আমার নিজস্ব শিক্ষাদানের কৌশল। আজ ভাল লাগে যখন দেখি আমার কোন ছাত্র-ছাত্রী ভাল কোন অবস্থানে আছে বা ভদ্র আর মার্জিত রূপে আসে আমার সামনে। অথবা অন্য কারও মুখে যখন শুনি আমার বিদ্যালয়ের সুনাম ও আমার ছাত্র-ছাত্রীদের সুনাম। তখন গর্বে বুকটা ফুলে ওঠে। আবার প্রচণ্ড ব্যথায় মুষড়ে পড়ি; যখন দেখি আমারই কোন কোন ছাত্র অথবা ছাত্রী তার জীবন চলার পথে বিপথে চলে গেছে অথবা বখে গেছে। তখন নিজেকে আবিষ্কার করি অথর্ব রুপে। জানিনা আর সব শিক্ষকদের আমার মতো করে লাগে কিনা। যদি লাগে তাহলে বুঝতে পারবেন আসলেই কেমন লাগে। বাতায়নের প্রিয় শিক্ষক-শিক্ষিকাবৃন্দ, আসুন আমরা শুধুমাত্র বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা না দিয়ে সামগ্রিক শিক্ষা প্রদান করতে উদ্বুদ্ধ হই। মাল্টিমিডিয়া শ্রেণীকক্ষ মানে আমার কাছে তো বিশাল মজার ব্যাপার। আশা নয় বিশ্বাস, যা আমার কাছেই এতো মজার লাগে তাহলে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের নিশ্চয় আরও বেশী ভাল লাগবে। যা শিক্ষার্থীদেরকে শিখাবে নতুন করে। আমরা হবো অভিজ্ঞ আর শিক্ষার্থীরা পাবে শেখার মাঝে আনন্দ। কারণ আনন্দের মাঝে কোন কিছু শিখলে তার বেশীদিন পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা ধারণ করতে পারবে বলে আমার মনে হয়। যাতে করে শিক্ষার্থীরা হবে উপকৃত আমরাও পাবো শান্তি। একটিবার ভাবুন, আপনার, আমার, আমাদের চোখের সামনে যারা অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে সে চোখগুলো কত আশা করে চেয়ে আছে আমাদের দিকে। আপনি কিভাবে বলেন? আপনি কিভাবে চলেন? আপনার কথা বলার ধরণ, আপনার উচ্চারণ সব সব তারা অনুকরণ করতে ভালোবাসে । কারণ ওরাতো নরম এঁটেল মাটির মতো। আপনি ওদের যেরূপ দিবেন সেরূপেই ওরা গড়ে উঠবে। হ্যাঁ, মেনে নিচ্ছি দুচারজন বিপথে যাবে। কিন্তু দুচারজন যেন তা দশ বিশজন না হয়ে যায়। তাই প্লিজ আমার সম্মানিত শিক্ষক-শিক্ষিকামন্ডলী, আসুন আমরা মডেল হযে ওদের সামনে যাই, যাতে করে ওরা ওদের জীবনটা সেভাবে গড়ে তুলুক; যেভাবে উন্নত বিশ্বের শিক্ষার্থীরা গড়ে তুলছে। যারফলে আমরা পাবো শিক্ষিত জাতি আর পাবো আমাদের বৃদ্ধ বয়সের ণিশ্চিত সুন্দর ভবিষৎ। কারণ শিক্ষিত জাতি শিক্ষিত দেশ, আমরা পাবো সোনার বাংলাদেশ। যেন কবির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে পারি, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। পরিশেষে ভুলত্রুটির ক্ষমা চেয়ে বিদায় নিলাম। ভাল থাকবেন সবাই, আল্লাহ হাফেজ।

মতামত দিন