Loading..

উদ্ভাবনের গল্প

০১ জুলাই, ২০২১ ০৫:০১ অপরাহ্ণ

চট্টগ্রামে যোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাবে বাণিজ্যিক রাজধানীর ধারণা আমরা কাজে লাগাতে পারিনি

চট্টগ্রামে যোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাবে বাণিজ্যিক রাজধানীর ধারণা আমরা কাজে লাগাতে পারিনি

ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরের এলাকা টঙ্গীর কোল ঘেষে মাজুখান। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ সংলগ্ন এই এলাকার ৪৪ হাজার বর্গফুট জমিতে তৈরি ‘এক্সক্লুসিভ ক্যান লিমিটেড’ কারখানা। দেড়লাখ বর্গফুটের ৫ তলা এই কারখানার কাঁচের দেয়ালে বেশ বড় অক্ষরেই লেখা ‘প্রাউডলি চিটাগনিয়ান’। ঢাকার কারখানার কাচের দেয়ালের গায়ে এই ধরনের ‘অদ্ভুত’ লেখা কেনো? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ধারণাই সত্যি হলো। জানা গেলো- কারখানাটির মালিক চট্টগ্রামের ছেলে সৈয়দ নাসির।

চাকরি না পেয়ে উদ্যোক্তা হয়ে উঠা নাসির নিজের মুখেই শোনালেন ‘অদ্ভুত’ এই লেখার কারণ। জনাব নাসির বলেন, চট্টগ্রামে জন্ম। চট্টগ্রামে বেড়ে উঠা। তাই চট্টগ্রামেই থাকতে চেয়েছি। ব্যবসাও শুরু করেছি চট্টগ্রামে। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের শেষের দিক থেকে দেশের পুরো ব্যবসা ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ার পর আমি ঢাকায় এসে দেখি- অনেকেরই বাড়ি চট্টগ্রাম এবং এই পরিচয় দিতে তারা সংকোচ বোধ করেন। চাটগাঁইয়া ভাষায় কথা বলতে চান না। আমার মনে হয়-বাড়ি চট্টগ্রাম, চাটগাঁইয়া ভাষায় কথা বলা, এটা গর্বের। তিনি বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার মানুষ যাতায়াত করেন। ট্রেন ঢাকা থেকে টঙ্গী রেল স্টেশন পার হয়ে সামনে এগোতেই হাতের বাম পাশে আমাদের কারখানা। ঢাকায় ট্রেনে যাতায়াত করা চট্টগ্রামের সব মানুষ যেন দেখেন, ঢাকাতে একটি ‘মিনি চট্টগ্রাম’ আছে, আছে বুক উঁচু করা এক চাটগাঁইয়া ছেলে। এই ভাবনা থেকেই কারখানার কাচের দেয়ালে ‘প্রাউডলি চিটাগনিয়ান’ লেখা।

৩৯টি প্রতিষ্ঠানে নাসিরের পণ্য :

চট্টগ্রামের মুরাদপুরে দুই হাজার বর্গফুটের একটি সেমিপাকা কারখানা দিয়ে ব্যবসা শুরু সৈয়দ নাসিরের। এখন ঢাকা ও চট্টগ্রামে প্রায় আড়াই লাখ বর্গফুটের তিনটি কারখানা তার। শুরুর দিকে কারখানায় রঙের কৌটা বা ক্যান তৈরির কাজ করতেন ২০ জন শ্রমিক। এখন এই কাজে কর্মসংস্থান হয়েছে হাজার খানেক লোকের। ধীরে ধীরে বেড়েছে তার ব্যবসার পরিধিও। ১ লাখ টাকা পুঁজির ব্যবসা এখন দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৫০ কোটি টাকায়।
রং, আইসক্রিম, লুব্রিকেন্ট, ওষুধ এবং খাদ্যদ্রব্যের কৌটা তৈরি করে ৩৯টি প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করা হচ্ছে তার ৩টি কারখানা থেকে। রঙের কোম্পানি- বার্জার, এশিয়ান, নিপপন, ডুলাক্স, আইসক্রিম কোম্পানি- পোলার, সেভয়, কোয়ালিটি, লাভেলো, ওষুধ কোম্পানি- রেডিয়েন্ট, পপুলার থেকে শুরু করে দেশের জনপ্রিয় আড়ং, মিল্কভিটা, প্রাণ-আরএফএলসহ সব বড় বড় কোম্পানিতেই কৌটা সরবরাহ করেন নাসির। পণ্যের গুণগত মান অটুট রাখতে কারখানায় ব্যবহার করা হচ্ছে অর্ধশতাধিক রোবটসহ অত্যাধুনিক চীনা প্রযুক্তির মেশিনারিজ। কারখানার মোট জমির ৪০ শতাংশ জায়গা উন্মুক্ত রাখার পাশাপাশি প্রোডাকশন ফ্লোরের মধ্যেও ৩৫ শতাংশ জায়গা মেশিনারিজ মুক্ত রাখা হয়েছে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং পরিবেশবান্ধব করার জন্য।
শূন্য থেকে শুরু করে দেশের অন্যতম বড় কৌটা কারখানার মালিক এখন নাসির। তবে এরপরেও খুশি নন চট্টগ্রামের এই উদ্যোক্তা। কেনো? এমন প্রশ্নের উত্তরে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দেন তিনি। এক নাগাড়ে বলতে শুরু করেন ব্যবসা শুরুর কথা। চট্টগ্রাম ছেড়ে আসার কষ্ট। ঢাকায় ব্যবসা বড় করার সংগ্রাম থেকে শুরু করে সফল উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প।

আই এম নট হ্যাপি:
নাসির জানান, ১৯৯৩ সালে বাবা এবং ভগ্নিপতির দেওয়া অল্প পুঁজি নিয়ে বার্জার পেইন্টসের ভেন্ডর হিসেবে ব্যবসা শুরু করি। চট্টগ্রামে বার্জারের রঙের কৌটা বানাতাম মুরাদপুরের কারখানায়। কিন্তু বিক্রয় ও বিপণনসহ নানা কারণে বার্জার তাদের হেড অফিস ও বিশালায়তনের কারখানা ঢাকায় স্থানান্তর করেন। এরপর ভারতের সবচেয়ে বড় রং প্রস্তুতকারী কোম্পানি এশিয়ান পেইন্টসও কারখানা নির্মাণ করে ঢাকাতেই। আস্তে আস্তে পেইন্টসের মার্কেটও ঢাকামুখী হয়ে যায়।
তিনি বলেন, ১৯৯৯ সালে আমি সাভারে একজন পার্টনার নিয়ে কারখানা শুরু করি। তবে পরিবার চট্টগ্রামেই রেখে যাই। ৩ বছর ব্যবসা করার পরও মন টিকেনি ঢাকাতে। ব্যবসা গুটিয়ে চট্টগ্রামে চলে আসি। কিন্তু এশিয়ান পেইন্টস ব্যবসার জন্য বারবার অনুরোধ জানালে ২০০৬ সালে ফের ঢাকার টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা মাঠের পাশে ভাড়ায় ছোট একটি জায়গা নিয়ে কারখানা করি।

২০০৯ এর পর থেকে দেখি- দেশের জিডিপি ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। তখন টঙ্গী বিসিকে ১ বিঘার ১টি প্লট কিনে তাতে কারখানা তৈরি করি। ব্যবসা ক্রমান্বয়ে বাড়ার কারণে ২০১২ সালে সপরিবারে চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকার উত্তরায় চলে আসি। গ্রীনলাইন পরিবহনের বাসে করে আসার পুরোটা সময় পুরো পরিবার কাঁদতে কাঁদতে আসি। এই ছেড়ে আসার স্মৃতি এখনো মনে পড়লে দু’চোখ জলে ভরে যায়। এখন ঢাকায় আমাদের সব হলেও চট্টগ্রামে থাকতে না পারার কষ্টে ‘স্টিল আই এম নট হ্যাপি’।

বাণিজ্যিক রাজধানী হয়নি চট্টগ্রাম :
নাসির বলেন, ১৯৫৮ সালে চট্টগ্রামকে প্ল্যান করে কমার্শিয়াল বেল্ট হিসেবে তৈরি করে তখনকার সরকার। ঢাকাসহ সারাদেশের অনেক ব্যবসায়ী এই কারণেই ব্যবসার জন্য চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ছুটে আসেন। ইস্পাহানীর মতো শিল্পগ্রুপ চট্টগ্রামে এসেছে ব্যবসার জন্য। এরপর ইউনিলিভার এসেছে। রেকিট বেনকিজার এসেছে। গ্লাক্সো, বার্জার পেইন্টস, সিঙ্গার, হোয়েস্টসহ নানা খাতের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এসেছে। চট্টগ্রামের কালুরঘাট, বায়েজিদ, নাসিরাবাদ, ফৌজদারহাট, সীতাকুণ্ড ছিলো শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য আদর্শ জায়গা। কিন্তু ৯০ দশকের পর সরকারের ভুলনীতি ও চট্টগ্রামে যোগ্য নেতার অভাবে এই ধারা আমরা ধরে রাখতে পারিনি।
তিনি বলেন, দেশীয় পোশাক রপ্তানির যাত্রা শুরুই হয়েছে চট্টগ্রামের ‘দেশ গার্মেন্টস’ থেকে। দেশের প্রথম প্রাইভেট মেডিকেল ইউনিভার্সিটির যাত্রা চট্টগ্রামেই। দেশের প্রথম এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন সিইপিজেডের কনসেপ্ট চট্টগ্রাম থেকেই শুরু। বন্দরের মতো কেপিআই এর কথা নাইবা বললাম। এতো সুবিধা থাকার পরেও চট্টগ্রামকে সত্যিকারের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলা যায়নি। আমাদের ঢাকাকেন্দ্রিক আমলাদের অদূরদর্শিতা ও চট্টগ্রামে যোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাবে বাণিজ্যিক রাজধানীর ধারণা আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। এটা চট্টগ্রামবাসীর দুর্ভাগ্য বলতে হবে।
দেশের কারখানাগুলো চট্টগ্রামে হলে উৎপাদন ও পরিবহন খরচ কমতো। কারণ কাঁচামাল আসে বন্দর দিয়ে। আর পণ্য রপ্তানি হয় বন্দর দিয়েই। এখন আমরা চট্টগ্রাম থেকে কাঁচামাল এনে ঢাকার কারখানায় পণ্য তৈরি করছি। আবার এ সব পণ্য চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই রপ্তানি করছি। গাছের আগায় উঠে গাছ কাটছি নয় কি? এটা কিন্তু পুরোটাই ভুল পলিসি। অথচ আপনি ভারতের দিকে তাকান। সেখানে গুজরাট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্যাপিটাল আর মুম্বাই বিজনেজ ক্যাপিটাল। পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে কোনো কারখানা নেই। সব কারখানা করাচিতে। একইভাবে জার্মানির বার্লিন বা যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে কিন্তু কারখানা করতে দেয়া হয়নি। প্রায় প্রত্যেক দেশ রাজধানী এবং বাণিজ্যিক রাজধানী আলাদা করতে পেরেছে। রাজনৈতিক এবং আমলাতান্ত্রিক দূরদর্শিতার অভাবে আমাদের দেশে আমরা সেটা করে উঠতে পারিনি।

স্বপ্ন দেখাচ্ছে মেগা প্রজেক্ট :
নাসির বলেন, দেশের সবচেয়ে বড় ইকোনমিক জোন হতে যাচ্ছে মিরসরাইয়ে। সাগরপাড়ের এই জোন বড় বড় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে প্রচুর আগ্রহ তৈরি করতে পেরেছে। কর্ণফুলী টানেলের কাজ শেষ হলে চট্টগ্রামের বিশাল একটি অংশ আলো এবং উন্নয়নের মধ্যে ঢুকে পড়বে। একই সাথে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর আমাদের আমদানি রপ্তানি ব্যবসায় লিড টাইম এবং পরিবহন খরচ দুটোর ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। নিয়ে যাবে দেশকে একটি ভিন্নমাত্রায় বা উচ্চতায়।
তিনি বলেন, পদ্মা সেতু যেমন জিডিপিতে ১.৫ শতাংশ ভ্যালু এ্যাড করবে তেমনি গভীর সমুদ্রবন্দরও আমাদের জিডিপিতে ন্যূনতম ২ শতাংশ ভ্যালু এ্যাড করবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। সরকারের এই উদ্যোগ চট্টগ্রামের মানুষকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে। এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হয়ে গেলে চট্টগ্রামকে ঘিরে ব্যবসা-বাণিজ্য আবার ঘুরে দাঁড়াবে। ফলে আমার মতো ছোট, মাঝারি বা বড় কোন উদ্যোক্তাকেই আর ঢাকামুখী বা চট্টগ্রামের বাইরে গিয়ে কারখানা করতে হবে না। সারাপথে গ্রিনলাইনের বাসে বসে আর কাউকে কান্না করতে হবে না। এটাই হবে আমার মতো এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের উদ্যোক্তাদের কাঙ্ক্ষিত বা স্বপ্নের বিনিয়োগের তীর্থভূমি। সাগর, পাহাড়, নদী দিয়ে প্রকৃতি চট্টগ্রামকে এজন্যই সাজিয়েছে। এটা স্রষ্টারও চাওয়া বলে মনে হয় আমার কাছে।

নাসিরের ব্যবসা এখন শতকোটি টাকার

পড়াশোনা শেষে সৈয়দ নাসির যখন চাকরি খুঁজছিলেন, তখন আসে ব্যবসার সুযোগ। বার্জার পেইন্টসের এক কর্মকর্তার পরামর্শে চালু করেন রঙের ডিব্বা বা ক্যান তৈরির কারখানা। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সৈয়দ নাসিরের প্রতিষ্ঠান এখন বছরে শতকোটি টাকার বেশি পণ্য বিক্রি করে। তার এই উঠে আসার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে কয়েকটি ব্যাংক। ব্যাংকের ভালো গ্রাহক হিসেবে পরিচিত তিনি। এর মাধ্যমে সৈয়দ নাসির নিজে যেমন বড় হচ্ছেন, ব্যাংকের ব্যবসাও ঠিক তেমন বেড়েছে। 

যাঁরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে নিয়মিত শোধ করছেন, নতুন কিছু উৎপাদন করছেন, এমন ভালো গ্রাহকদের কয়েক মাস ধরেই খুঁজছিলাম। সেই খোঁজার অংশ হিসেবে যোগাযোগ করেছিলাম শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম শহীদুল ইসলাম ১৮ মিনিটের মধ্যেই খোঁজ দিলেন সৈয়দ নাসিরের। আর বললেন, ‘এমন গ্রাহককে অর্থায়ন করে আমাদের ব্যাংক গর্বিত। তাঁর কারখানার কর্মীদের বেতন তোলার জন্য আমরা এটিএম বুথও বসিয়েছি।’ 

সৈয়দ নাসিরের গল্প শুনতে গত বুধবার গিয়েছিলাম টঙ্গীতে তাঁর কারখানায়। প্রতিষ্ঠানের নাম কিউ পেইল লিমিটেড, যেটি টঙ্গী বিসিক শিল্পনগরে অবস্থিত। চট্টগ্রামে এক্সক্লুসিভ ক্যান নামে আরেকটি কারখানা রয়েছে। কারখানার ফটকেই সৈয়দ নাসিরের সঙ্গে প্রথম পরিচয়। পুরো কারখানা ঘুরে ঘুরে দেখালেন। আমদানি করা পলিথিলিন থেকে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছোট-বড় ক্যান। ৫৪ হাজার বর্গফুট এলাকার পুরো কারখানায় হাতের কোনো ছোঁয়া নেই, উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়াই হচ্ছে রোবটে। উৎপাদিত ক্যান চলে যাচ্ছে পেইন্টিং বিভাগে। ১৫ হাজার বর্গফুট এলাকায় তৈরি ক্যানে বসছে চাহিদামতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের রং ও স্টিকার। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের রঙের ছোট-বড় ক্যান, আইসক্রিমের বক্স, মবিলের ক্যান, ওষুধের বোতল—সবই তৈরি হচ্ছে তার কারখানায়। আগে এসব পণ্য আসত বিদেশ থেকে। এখন দেশেই তৈরি হচ্ছে। সৈয়দ নাসির বললেন, ‘কারখানায় ৬০০ কর্মী কাজ করেন। সবাই আমার পরিবারের সদস্য। কর্মীদের বিপদে আমি নিজেই এগিয়ে যাই। তাঁরা ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকি।’ 

চাকরি খুঁজতে খুঁজতে উদ্যোক্তা

চাকরি খোঁজার উদ্দেশে ১৯৯১ সালে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসছিলেন সৈয়দ নাসির। ট্রেনেই পরিচয় হয় বার্জারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা রেজাউল করিমের সঙ্গে। তিনি চাকরির পরিবর্তে ব্যবসার পরামর্শ দিলেন সৈয়দ নাসিরকে। রঙের ক্যান তৈরি করতে বললেন। চট্টগ্রামে ফিরে বার্জার অফিসে দেখা করতে গেলে রেজাউল করিম তাঁকে নিয়ে গেলেন সরকারের মালিকানাধীন বাংলাদেশ ক্যান কোম্পানিতে। যাঁরা ওই সময়ে টিনের ক্যান তৈরি করে বার্জারকে সরবরাহ করত। কারখানাটি ছিল আধুনিক ও ব্যয়বহুল। এরপর গেলেন এলিট পেইন্টে। এলিট থেকে এক কর্মীকে নিয়ে এলেন। তারপর বাবার দেওয়া ১ লাখ ২৫ হাজার টাকায় ছোট আকারে কারখানা করলেন চট্টগ্রামের মুরাদপুরে। ১৯৯২ সালে টিনের ক্যান তৈরি করে বার্জারকে দেওয়া শুরু করেন। এ নিয়ে সৈয়দ নাসির বলেন, ‘বাবার অবসরের টাকাই ছিল আমার ব্যবসার প্রথম মূলধন।’ 

 ব্যবসায় মোড় ঘুরিয়ে দেয় ব্যাংক 

কারখানা দেওয়ার পর ঋণের জন্য সৈয়দ নাসির যোগাযোগ করেন সোনালী ব্যাংকের পাঁচলাইশ শাখায়। ব্যাংকটির তৎকালীন এমডি লুৎফর রহমান সরকার তখন সার্টিফিকেট বন্ধক রেখে ঋণ দেওয়ার পদ্ধতি চালু করেছিলেন। এ কারণে সহজেই সোনালী ব্যাংক থেকে ৫ লাখ টাকা পেয়ে যান। আরও ১৫ লাখ টাকা পান প্লেজ (গুদামজাত পণ্যের বিপরীতে দেওয়া ঋণ) ঋণ হিসেবে। সৈয়দ নাসির বলেন, ‘সার্টিফিকেট বন্ধক রেখে ঋণপ্রথা চালু ছিল যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এমন শতাধিক শিল্পপতি পাওয়া যাবে, যাঁরা ওই ঋণসুবিধা নিয়ে বড় হয়েছেন।’ 

১৯৯৬ সালে ভারতে যান টিনের ক্যান তৈরির আধুনিক প্রযুক্তি দেখতে। ১৯৯৯ সালে ৫৫ লাখ টাকা ঋণ পান সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে। ওই টাকায় কারখানার পাশে ৪ তলা ভবন কিনে নেন। সৈয়দ নাসির বলেন, ‘এ ঋণই আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। কারখানা বড় হয়ে যায়।’ ক্যানের নির্দিষ্ট ক্রেতা বার্জার, ফলে কোনো চিন্তাই ছিল না।’ 

তবে ওই সময়ে বার্জার পেইন্ট নিজেরাই ক্যান বানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এতে বড় হোঁচট খান সৈয়দ নাসির, কারণ বার্জারই ছিল তাঁর পণ্যের একমাত্র ক্রেতা। পরে অন্য রং কোম্পানিতে ক্যান দেওয়া শুরু করেন। তখন সব কোম্পানির প্রধান কার্যালয় ছিল চট্টগ্রামে। 

ঢাকায় কারখানা স্থাপন

রং–এর ক্যান উৎপাদনই সৈয়দ নাসিরের মূল ব্যবসা । ২০০০ সালের দিকে রোমানা রং ঢাকা থেকে কার্যক্রম শুরু করে। রোমানার বাহার নামে বিজ্ঞাপন এনে তারা ঢাকার বাজারও পায়। তার আগে সব রং কারখানার প্রধান কার্যালয় ছিল চট্টগ্রামে। ঢাকার বাজার ধরতে বার্জারও সাভারে কারখানা করে। এবার বার্জারের পরামর্শে সৈয়দ নাসির ঢাকার সাভারে কারখানা করেন।

সৈয়দ নাসির বলেন, ‘আড়াই বছর চুক্তি শেষে বার্জার আর টিনের ক্যান নিতে চাইল না। তারা প্লাস্টিকের ক্যান তৈরি করতে বলল। বড় বিনিয়োগ, আমি পারলাম না। কারখানা বন্ধ করে ফিরে গেলাম চট্টগ্রামে। কিছুদিনের মধ্যে বুঝলাম, আমি হেরে গেলাম।’

বছরখানেকের মধ্যে আবারও ঢাকায় ফিরলেন। পুরান ঢাকার আল রাজ্জাক হোটেলে উঠলেন। শিখলেন প্লাস্টিকের ক্যান বানানো। এবার চট্টগ্রামে ফিরে প্লাস্টিকের ক্যান বানানো শুরু করলেন, সরবরাহ করলেন মুনস্টার রং কোম্পানিতে। এবার বার্জারও তার থেকে প্লাস্টিকের ক্যান নিতে শুরু করল, তা শুধু চট্টগ্রামের জন্য। 

২০০৩ সালে ঢাকায় এশিয়ান পেইন্ট চালু হলো। ওই সময়ে অনেক কোম্পানি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় চলে আসে। ২০০৭ সালে দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকায় আসেন। এশিয়ান পেইন্টকে ক্যান দিতে টঙ্গী ব্রিজের কাছে কারখানা চালু করেন। ২০১০ সালে কারখানা স্থানান্তর করেন টঙ্গীর বিসিকে। এরপর সব রং কোম্পানি তার গ্রাহক হয়ে যায়। ওই সময়ে বৈশ্বিক রং উৎপাদক প্রতিষ্ঠান জটুন, নিপ্পন ও একজোনোবেল দেশে আসে। সৈয়দ নাসিরের মতে, ‘এতে আমার পণ্যের বাজার আরও বড় হয়। ওই সময় ওষুধ কোম্পানিগুলো আমাদের পণ্য নেওয়া শুরু করে।’ 

এখন টঙ্গী বিসিকের পাশেই নতুন কারখানা করছে প্রতিষ্ঠানটি। পাঁচতলায় ১ লাখ ২৫ হাজার বর্গফুট জায়গা। নির্মাণ শেষ পর্যায়ে, অক্টোবরেই চালু হবে। এটি নির্মাণ হচ্ছে সবুজ কারখানার সব শর্ত মেনে। 

ব্যবসা ও গ্রাহক

সৈয়দ নাসিরের ব্যবসা অন্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। তার প্রতিষ্ঠানে তৈরি হয় প্লাস্টিক ও টিনের ক্যান। এসব ক্যানে পেইন্ট ও স্টিকারও বসানো হয়। ঢাকার টঙ্গী ও চট্টগ্রামের মুরাদপুরে তাঁর কারখানা। রং উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোই তার বড় ত্রেতা। এর মধ্যে অন্যতম হলো বার্জার, এশিয়ান পেইন্ট, নিপ্পন পেইন্ট, আর এ কে পেইন্ট, উজালা পেইন্ট, রেইনবো, একজোনোবেল, জটুন, ফেবিকল, এলিট পেইন্ট, মুনস্টার পেইন্ট। খাদ্য প্রস্তুত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোয়ালিটি আইসক্রিম, মিল্ক ভিটা, ওয়েল ফুড, আড়ং দুধ, এসিআই, ব্লুপ ও পোলার আইসক্রিমকে কনটেইনার সরবরাহ করেন তিনি। এর বাইরে ওষুধ খাতের রেডিয়েন্ট ফার্মা ও পপুলার ফার্মাকেও কিছু ওষুধের কনটেইনার দেন সৈয়দ নাসির। 

শাহজালাল ইসলামী, ব্র্যাক ও ইউনাইটেড ফাইন্যান্সের ঋণে চলে তাঁর ব্যবসা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৯৫ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিক্রি বেড়ে হয় ১১৪ কোটি টাকা। 

সৈয়দ নাসিরের কিউ পেইল কারখানায় তৈরি ক্যানে রং বসছে। টঙ্গী থেকে তোলা। ছবি: এবং বাণিজ্য

ঢাকায় কারখানায় শ্রমিক রয়েছেন ৬০০, চট্টগ্রামে ২০০। টঙ্গীর কারখানায় কর্মীদের বেতন হয় ব্যাংকের মাধ্যমে। তাঁদের জন্য কারখানার ভেতরেই রয়েছে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের এটিএম বুথ। সৈয়দ নাসির বলেন, ‘বেসরকারি ব্যাংক ব্যবসায়ীদের আশীর্বাদ। এসব ব্যাংক না হলে এত ব্যবসায়ী কখনোই তৈরি হতো না। আমার ক্ষেত্রেও তা–ই।’ 

তবে শেষ করেন এই বলে, ‘প্লাস্টিকের পণ্য তৈরি করছি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কী রেখে যাচ্ছি, এটা সব সময় আমাকে ভাবায়। কারণ এসব প্লাস্টিক তো কখনোই পচবে না।’