Loading..

পাঠসংশ্লিষ্ট ছবি/ইমেজ

০৭ আগস্ট, ২০২১ ১০:০২ অপরাহ্ণ

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী (গারো)

গারো

এরা মোঙ্গলীয় মহাজাতি সত্তার তিব্বতী-বর্মণ জাতিগোষ্ঠীর, বোড়ো  শাখাভুক্ত। এদের মাথা ও মুখমণ্ডল গোলাকার, চুল ও চোখ কালো, কপাল চোখের দিকে কিছুটা বাড়ানো, ভ্রূ ঘন, চোখ ছোট, শ্মশ্রূহীন, গায়েও লোম কম, নাকমুখ চেপ্টা, চোয়াল উঁচু, নাসারন্ধ্র মোটা, প্রশস্ত বুক, হস্ত-পদ-পেশি স্থূল, শরীর সবল, আকৃতি বেঁটে, চামড়া পীতাভ মসৃণ।

ভারতবর্ষে মোঙ্গলীয়রা প্রবেশ করেছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া দিয়ে। এরা প্রথমে পূর্ব ও উত্তর ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে।

বিশেষ করে চীন-ভারতের সীমান্তবর্তী তিব্বত, ভুটান, নেপাল, সিকিম এবং তৎসলগ্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলের মোঙ্গলীয়রা প্রবেশ করেছিল মায়ানমারের চীন প্রদেশের চীনা পাহাড়ের বন্ধুর পথ পেরিয়ে।

ভারতে প্রবেশকারী মোঙ্গলীরা নানা শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। ধারণা করা এদের একটি শাখা প্রথমে তিব্বতের তুরা প্রদেশে ও ভুটানের নকলবাড়ি নামক অঞ্চলে বসতি শুরু করে। এই শাখাকেই ভারতবর্ষে গারোদের আদি জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

Garo young man
ঐতিহ্যবাহী পোশাকে গারো তরুন

তিব্বত ও ভুটান থেকে স্থানীয় অধিবাসীদের দ্বারা বিতারিত হয়ে এরা কুচবিহার, আসাম ও রংপুরের রাঙ্গামাটি, গোয়ালপাড়াতে আশ্রয় নেয়।

গোষ্ঠীগত কলহে এদের একটি দল গোয়ালপাড়া ত্যাগ করে জনশূন্য, জঙ্গলাকীর্ণ, বৃষ্টিবহুল দুর্গম গারো পাহাড়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। গারো পাহাড়বাসী বলে এদের তখন নাম হয় গারো।

উল্লেখ্য ৩,০০০ বর্গমাইল আয়তনের এই পাহাড়টি বঙ্গদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ব্রিটিশরা এই পাহাড়কে আসামের সঙ্গে সংযুক্ত করে। এরা এই অঞ্চলে পাহাড়ে জুমচাষ, পশুপালন, শিকার ইত্যাদি দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতো। 

কালক্রমে গারোরা বাসস্থানের বিচারে দু’ভাবে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ভাগ দুটি হলো সমতলবাসী ও পাহাড়ী। সমতলবাসীরা লামদানি এবং পাহাড়িরা আচ্ছিক গারো নামে পরিচিত। 

আচ্ছিকরা লামদানি গারোদের বলে ‘মান্দাই’। উল্লেখ্য, আচ্ছিক বা আচিক-এর অর্থ হলো পাহাড়। আর মান্দাই-এর অর্থ হলো মানুষ। এই মান্দই শব্দটি চীনা শব্দ। 

দুর্গম পাহাড়ের কারণে বঙ্গদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে এরা বিচ্ছিন্ন ছিল। মোগলরা যখন পূর্বভারতে রাজ্যবিস্তার শুরু করে, তখন এরা, গারোদেরকে ওরাংওটাং জাতীয় প্রাণী মনে করত।

ব্রিটিশরা এদের মানুষ হিসেবে গণ্য করলেও, অসভ্য ও বর্বর জাতি হিসেবে বিবেচনা করতো। কারণ সে সময়ে গারোরা গাছের বাকল পরত। মেয়েদের ঊর্ধ্বাঙ্গও উন্মুক্ত থাকতো।

আধুনিক ভৌগোলিক বিভাজন অনুসারে এরা বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত। তবে এই অঞ্চলের প্রথম বসবাসকারী জনগোষ্ঠী হিসেবে এদেরকে অধিবাসী  বলা যায়।

সমতলী গারোরা এক সময় বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, শেরপুর ও টাঙ্গাইলের নলিতাবাড়ি, কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, শ্রীবর্দি, বারহাট্টা, ধুবাউরা, হালুয়াঘাট, পূর্বধলা, ফুলপুর, ফুলবাড়িয়া, ভালুকা, মধুপুর ইত্যাদি স্থানে ক্রমে ক্রমে ছড়িয়ে পড়েছিল।

পরে বাঙালিদের আধিক্যের কারণে টিলা-টেকর, সমতল ও জঙ্গলহীন হয়ে পড়ে। এরপর এদের  অধিকাংশই ভালুকা ত্যাগ করে। একসময় সিলেটের সুনামগঞ্জ, গাজীপুর জেলার শ্রীপুর, কাওরাইদ এবং কুড়িগ্রামের রৌমারিতে গারোদের বাস ছিল।

বর্তমানে এদের সংখ্যা কমে গেছে। ভারতে সীমান্ত সংলগ্ন বাংলাদেশের পাহাড়-টিলাগুলি ধসে সমতল হয়ে যাওয়াতে বহু গারো মেঘালয়ে চলে যায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও অনেকে দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিল।

গারোরা ঐতিহাসিকভাবে ভূমিহীন, তাদের অনেকের দখলে কিছু জমি থাকলেও তাদের দখলিস্বত্ব ছাড়া জমির কোনো দলিল নেই, তারা খাজনাও দেয় না।

গারোদের আদিম সাম্যবাদী শ্রেণীহীন সমাজে সামন্তবাদী ভূমিব্যবস্থা শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনামলের মধ্যভাগে। এদের মধ্যে পুঁজিবাদের প্রবর্তনও ব্রিটিশ আমলে ঘটে। পূর্বে বেচা-কেনা হতো বিনিময় প্রথায়।

খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করলে অঢেল জমি দলিল করে ব্যক্তি মালিকানায় দেওয়া হয়। এসব জমি পূর্বে ছিল গোত্রভিত্তিক মালিকানায় এবং সেগুলি সমবায়ের মাধ্যমে চাষাবাদ করা হতো।

গারো সমাজে বিবাহ

সাধারণত অবিভাবকরা বিবাহের আয়োজন করে। এই জাতীয় বিবাহকে বলা হয় দোবিকদোকা। এই প্রথায় সাধারণত মামাতো-পিসতুতো ভাইবোনদের মধ্যে হয়। বিবাহের দিন পাত্র আড়ালে থাকে।

বিবাহের লগ্নে উৎসাহী যুবকরা পাত্রকে ধরে এনে একটি ঘরে আটকে রাখে। প্রথানুসারে পাত্ররা প্রথমে এই বিবাহে রাজী হয় না এবং পালিয়ে যায়। এরপর যুবকরা পাত্রকে পুনরায় ধরে পাত্রীর সাথে একটি ঘরে আটকে রাখে।

এবারও পাত্র পালিয়ে যায়। তৃতীয় দিন তাকে ধরে আনে। পাত্র যদি একেবারেই পাত্রীকে পছন্দ না করে, তবে বিবাহ বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজি হলে, বিবাহ হয় এবং পাত্রীর সাথে রাত্রিযাপন করে।

গারোদের ভিতরে বিধবা বিবাহ প্রচলিত আছে। এক্ষেত্রে মৃত স্বামীর আত্মীয়দের ভিতরে কাউকে বিবাহ করা হয়। সাধারণত মৃত স্বামীর ছোটো ভাইয়ের সাথে বিবাহ হয়ে থাকে। বহুবিবাহ গারো সমাজে নেই।

তবে কোনো কারণে কোনো পুরুষ দ্বিতীয় বিবাহ করতে চাইলে, তাকে প্রথমা স্ত্রী অনুমতি নিতে হয়। এক্ষেত্রে সংসারে প্রথমা স্ত্রীর অধিকার সবচেয়ে বেশি থাকে।

গারো সমাজ ব্যবস্থা ও পরিবার

এদের পারিবারিক ব্যবস্থা মাতৃতান্ত্রিক। গারো সমাজে পুরুষের কর্তৃত্ব নেই। সন্তানদের পরিচয় হয় মায়ের বংশ ধরে। বিবাহিত জীবনে গারো ছেলেরা স্ত্রীর বাড়িতে এসে বসবাস করে।

গারো সমাজে পুরুষদের সম্পত্তিতে কোনো অধিকার নেই। বিবাহের আগে পুরুষদের অর্জিত সম্পত্তি পায় তার মা।

মায়ের মৃত্যু হলে, ওই সম্পত্তি পায় মায়ের বোনেরা। বিয়ের পর পুরুষের পূর্বে অর্জিত সম্পত্তি মা বা মায়ের বোনদের অধিকারে থাকে। সম্পত্তির মালিক মা, তারপর কনিষ্ঠ কন্যা বা মাতা মনোনীত অন্য কোনো কন্যা।

উত্তরাধিকারীণীকে বলা হয় নোকনা।  বিবাহের পর স্বামীর অর্জিত সম্পত্তি স্ত্রীর অধিকারে থাকে। এই সম্পত্তি স্বামী স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে ভোগ করতে পারে, কিন্তু হস্তান্তর করতে পারে না। স্ত্রীর মৃত্যু হলে, ওই সম্পত্তির অধিকার পায়  নোকনা হিসেবে নির্ধারিত কন্যা।  

নিঃসন্তান হিসেব কোনো স্ত্রী মৃত্যুবরণ করলে, স্ত্রী আত্মীয়দের মধ্য থেকে পাত্রী নির্বাচন করা হয়। বিবাহের পর দ্বিতীয়া আগের স্ত্রীর সকল সম্পত্তি  পায়।

কিন্তু কোনো কারণে যদি আগের স্ত্রীর কোনো আত্মীয়াকে সে বিবাহ না করে, তাহলে ওই ব্যক্তিকে আগের স্ত্রীর সকল অর্জিত সম্পত্তি ত্যাগ করে চলে যেতে হয়। স্ত্রীর মৃত্যুর পর যদি নাবালিকা কন্যা থাকে, তাহলে ওই সম্পত্তির তত্ত্বাবধান করে, মৃতা স্ত্রীর আত্মীয়রা।

সন্তানদের লালন-পালনের দায়িত্ব মায়ের ওপর অর্পিত। স্ত্রীর মৃত্যুর পর, ঐ বাড়িতে পিতার থাকার নৈতিক অধিকার থাকে না। তবে সাধারণত এমন পুরুষকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া না। পরিবারে মেয়ের সমাদর ছেলের চেয়ে বেশি।

কারণ, ছেলেটি বিয়ের পর অন্যত্র চলে যাবে। বিয়ের পর, মাতৃগৃহ ছাড়ার সময় ছেলেটি খুব কান্নাকাটি করে। স্ত্রীগৃহে সে মনমরা হয়ে থাকে। স্ত্রীর আন্তরিকতা ও আদর-আপ্যায়ন তাকে আশ্বস্ত করে।

তবু সুযোগ পেলে সে কখনও কখনও পালিয়ে যায়, কিন্তু আবার তাকে ধরে আনা হয়। মায়েরা ছোট শিশুকে একখণ্ড কাপড় দিয়ে পিঠে বেঁধে কঠোর পরিশ্রম ও চলাফেরা করে।

গারোদের মধ্যে সমগোত্রে বিবাহ নিষিদ্ধ। সমগোত্রের যুবকযুবতীর সম্পর্ক ভাই-বোনের। উল্লেখ্য, গারো সমাজে রয়েছে দশটি গোত্র।

প্রথাভঙ্গ করে কেউ বিয়ে করলে সম্পত্তি থেকে সে বেওয়ারিশ ও গ্রাম থেকে বহিষ্কৃত হয়। দুটি জবাই করা মোরগ পাশাপাশি ছেড়ে দিয়ে এগুলি যদি দাপাদাপি করে একত্র হয়ে যায় তবে বিবাহ শুভ বলে গণ্য হয়।

অনেক সময় যথার্থ গোত্রের মেয়ের পছন্দসই কোনো যুবককে ধরে এনে বিবাহের ব্যবস্থা করা হয়। এতে ছেলের গোত্রের আপত্তি থাকে না।  স্বামীর মৃত্যু হলে, স্ত্রী স্বামীর গোত্রের কোনো স্ত্রীবিহীন পুরুষকে স্বামী হিসেবে দাবি করতে পারে।

এরূপ বিবাহ সম্পর্ক ও বয়সে প্রায়শ অসম হয়, তবু গোত্রের চাপে মেনে নিতে হয়। স্বামীর মৃত্যুর পর জামাতা শাশুড়িরও স্বামীরূপে বিবেচিত। এতে মা-মেয়ের মধ্যে সতীনের তিক্ত সম্পর্ক তৈরি হয় না।

গোত্রীয় কারণে কারও নাবালিকার সঙ্গে বিয়ে হলে সাবালিকা হওয়া পর্যন্ত শাশুড়ির সঙ্গে জামাতার যৌনসম্পর্ক বিধেয়। গারো সমাজে একসময় দলবিবাহ ও অবাধ যৌনাচার থাকলেও পরে বাধা-নিষেধ আরোপিত হয়।

বিবাহপূর্ব কিংবা অসম সম্পর্কের নারী-পুরুষদের যৌনাচার জরিমানা ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যথার্থ প্রমাণের অভাবে কিছু কঠিন পরীক্ষা দ্বারা দোষী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে। বিবাহিত ব্যক্তিদের মধ্যে সামাজিক অনাচারের শাস্তি হচ্ছে সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ।

গারোদের পোশাক

এক সময় গারোরা গাছের বাকল পরত। বর্তমানে সাধারণ গারোরা জনা বা নেংটি এবং উপরের স্তরের লোকেরা নিজেদের বোনা সংক্ষিপ্ত কাপড় পরে।

মেয়েরা এক টুকরা সংকীর্ণ কাপড় সম্মুখ থেকে পিঠের দিকে বেঁধে স্তন আবৃত করে রাখে। পুরুষরা গামছা বা ধুতি পরে। আধুনিক কালে গারোরা বাঙালিদের মতোই পোশাক পড়ে।  গারো মেয়েদের অনেকে শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ পরে।

খাদ্য

এরা মোটামুটি সর্বভুক। তবে বিড়াল টোটেম বলে, বিড়াল হত্যা বা খাদ্য হিসেবে নিষিদ্ধ ছিল। ফলমূল এদের প্রধান খাদ্য ছিল বলে অভাবহীন নির্বিঘ্ন জীবনে এদের দ্রুত সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটে। বয়স্ক গারোরা দিনে তিনবার, শিশুরা চার বার খায়।

এরা বাঁশের চোঙায় রানড়বা করে এবং প্রচুর মদ পান করে। মাংস ছাড়া এদের অতিথি আপ্যায়ন হয় না। উৎসবাদিতে অতিথিরা মোরগ, শূকর ইত্যাদি নিয়ে আসে।

এক সময় গারোরা কলাগাছের বাকল পুড়িয়ে এর ছাই সাবান ও লবণের কাজে ব্যবহার করত। বিশেষ বিশেষ খাবার আজও ছাই দিয়ে রানড়বা হয়।

ধর্ম ও বিশ্বাস

বাংলাদেশের গারোদের নগণ্যসংখ্যক মুসলমান ছাড়া সবাই খ্রিষ্টান। খ্রিষ্টধর্মী গারোরা খ্রিষ্টানধর্মের নিয়মাবলির পাশাপাশি তাদের ঐতিহ্যগত প্রথা ও আচার-অনুষ্ঠান করে থাকে।

গারোদের আদি ধর্ম বহু-দেবতা ভিত্তিক। এই ধরএম সূর্য, চন্দ্র, তারকারাজি, বজ্র, বৃষ্টি প্রভৃতির পূজার বিধান রয়েছে।  কিন্তু এর পাশাপাশি গারোরা সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে বরাবর বিশ্বাস করে এসেছে।

তিনি যে এই পৃথিবীর সবকিছুর স্রষ্টা এ বিশ্বাস গারোদের মধ্যে ছিল। গারোরা একইসঙ্গে মানবদেহে আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসী এবং সেই আত্মা যে অবিনশ্বর এটাও তারা বিশ্বাস করে। তারা হিন্দুদের মতো জন্মান্তর বাদে বিশ্বাসী।

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি