Loading..

প্রকাশনা

০৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১২:১৯ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষার চাহিদা

কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ জনবল তৈরির গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষাকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কিন্তু বিভিন্ন কারণে কাঙ্ক্ষিত গুণগত মানের দক্ষতা অর্জন সম্ভব হচ্ছে না। বাস্তব কর্মক্ষেত্র থেকে প্রায়ই প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবলের অভাবের কথা বলা হয়ে থাকে। ফলে ভারতসহ বহু দেশের লোক বাংলাদেশে কাজ করছেন এবং বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যাচ্ছেন।

*** সরকারি ও বেসরকারি খাতে কারিগরি শিক্ষার যথেষ্ট সম্প্রসারণ হয়েছে। বর্তমানে সারা দেশে ৮ হাজার ৬৭৫টি কারগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১২ লাখের বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। পাঁচ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে এই স্তরে শিক্ষার্থী বাড়ছে। সরকার ২০২০ সালে মধ্যে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার হার ২০ শতাংশ (মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে) এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এই হার ৩০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। বর্তমানে এই হার প্রায় ১৬ শতাংশ। কারিগরি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোতে চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো হয়। এ ছাড়া বিএম, ভোকেশনাল, কৃষি ডিপ্লোমা রয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, যারা এসব কোর্স করছে, তাদের সহজেই কর্মসংস্থান হচ্ছে। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে ফারাক থাকলেও তাদের বেকার থাকতে হচ্ছে না।

বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ তরুণ। তাদের কর্মসংস্থান ও আত্মকর্মসংস্থানে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব অনেক বেশি। তা ছাড়া বৈদেশিক কর্মসংস্থানেও দক্ষ জনবলের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। দেশের সার্বিক উন্নয়নে কারিগরি শিক্ষাকে অর্থবহ করার জন্য কারিগরি শিক্ষার আরও সম্প্রসারণ এবং মানসম্মত কারিগরি শিক্ষা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। উপজেলা পর্যায়ে টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠার ফলে কারিগরি শিক্ষাকে উপজেলা পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের হাতের কাছে নেওয়া হয়েছে। আশা করা যায়, গ্রামগঞ্জের মেধাবী ছেলেমেয়েরা এতে উৎসাহিত হবে।

প্রতিটি উপজেলায় টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করে শুরু থেকেই দক্ষতাভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক কাজ সম্পর্কে সব ছাত্রছাত্রীর প্রাথমিক ধারণা থাকা প্রয়োজন। বাড়ির দৈনন্দিন ছোটখাটো কারিগরি কাজ নিজে নিজে করার জন্য দেশের সব স্কুলের সব ছাত্রছাত্রীকে এ সম্পর্কে শেখানো প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে স্কুল পর্যায়ে পাঠ্যক্রমে কারিগরি শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। অবশ্য পত্রিকায় খবর অনুযায়ী, সরকার কারিগরি প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি বিদ্যালয় ও মাদ্রাসায় বাধ্যতামূলকভাবে বৃত্তিমূলক শিক্ষা চালু করতে যাচ্ছে। ২০২১ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে, ২০২২ সালে সপ্তম শ্রেণিতে এবং ২০২৩ সালে অষ্টম শ্রেণিতে প্রাক্​বৃত্তিমূলক শিক্ষা হিসেবে একটি কারিগরি বিষয় বাধ্যতামূলকভাবে চালু করা হবে। অন্যদিকে নবম-দশম শ্রেণিতে ২০২১ সালে বাধ্যতামূলকভাবে একটি কারিগরি বিষয় চালু হবে। এটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক খবর।

কারিগরি শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর লক্ষ্যে তাদের জন্য আরও পলিটেকনিক ও টেকনিক্যাল স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজকে ত্বরান্বিত করা প্রয়োজন। ছাত্রীদের অধিকতর বৃত্তি–উপবৃত্তি প্রদান এবং পড়াশোনা শেষে চাকরিপ্রাপ্তি সহজতর করা প্রয়োজন। কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা দিন দিন বাড়ছে। বেসরকারি উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা প্রয়োজন। কিন্তু বেসরকারি কারিগরি প্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামো ও ল্যাবগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। মানসম্মত কারিগরি শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামো ও ল্যাব উন্নয়নের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। সরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদেরও কার্যকর শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা শিক্ষার মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। তা ছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের উপবৃত্তিসহ আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হলে তাদের অংশগ্রহণ বাড়বে।

যুগের চাহিদা অনুযায়ী নতুন নতুন বিষয়ে কারিগরি শিক্ষা চালু করার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। তা ছাড়া বর্তমানে চালু সিলেবাসগুলোকে যুগের চাহিদা অনুযায়ী আধুনিকীকরণ ও সংশোধন করা প্রয়োজন। বৃত্তিমূলক শিক্ষার ক্ষেত্রে ‘দক্ষতাভিত্তিক’ প্রশিক্ষণ সব ক্ষেত্রে চালু করা হলে দক্ষতার সার্বিক উন্নয়ন হবে। তা ছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসংখ্য লোক অনানুষ্ঠানিকভাবে কাজে দক্ষতা অর্জন করেন কিন্তু আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পান না। তাঁদের স্বীকৃতির ব্যবস্থা করা হলে তাঁদের মর্যাদা বাড়বে এবং বিদেশেও ভালো চাকরি পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। কারিগরি শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে মেধাবীদের আগ্রহী করার লক্ষ্যে কারিগরি সনদধারীদের উচ্চশিক্ষার অধিকতর সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে।

কারিগরি শিক্ষা বিভিন্ন ক্ষেত্রেই অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হয়। স্থানীয়ভাবে সুপারিশের ক্ষেত্রে একটি সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে অগ্রাধিকার পায়। কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণ ও মানোন্নয়নে মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। আশার কথা হলো, ধীরে হলেও পরিস্থিতি পরিবর্তিত হচ্ছে।

***কারিগরি শিক্ষা
বিশ্ব বনাম বাংলাদেশ

ভোকেশনাল এডুকেশন বা কারিগরি শিক্ষা এমন এক শিক্ষা পদ্ধতি যেখানে পাস-ফেল বলে কিছু নেই। বরং এটি একজন মানুষকে যোগ্য প্রতিযোগী করে গড়ে তোলার এক প্রয়াস, যেখানে হয় আপনি যোগ্য অথবা এখনও যোগ্য নন।তাই পরিপূর্ণ দক্ষতা অর্জনের জন্য এবং একজন যোগ্য প্রতিযোগী হতে আপনাকে যতবার প্রয়োজন ততবার পরীক্ষা দেবার এবং নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ দেয়া হয়।কারিগরি শিক্ষায় তত্ত্বীয় পড়াশুনার চেয়ে বাস্তব প্রয়োগে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়, যাতে করে একজন কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি নিজের যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে সবচেয়ে ভালো কাজের সুযোগ খুঁজে নিতে পারে ।বাস্তব কাজের অভিজ্ঞতা থাকায় কারিগরি শিক্ষাকে চাকুরির ক্ষেত্রেও খুব গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। একজন চাইলে খুব সহজেই কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করে নিজের পূর্বের কাজ থেকে বেরিয়ে নতুন কাজ করতে পারে এবং নিজের ক্যারিয়ার কে সমৃদ্ধ করতে পারে।প্রতিযোগিতার বাজারে কারিগরি শিক্ষা যোগ্য প্রতিযোগী তৈরিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। সমমানের শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি এই পদ্ধতি কার্যকর এবং যুগোপযোগী। শিক্ষায় উন্নত দেশগুলোতে আমরা কারিগরি শিক্ষা কার্যক্রমের প্রসারিত চিত্র দেখতে পাই।

***দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে কারিগরি শিক্ষার বিকল্প নেইবাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত করতে হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার প্রয়োজন। এর মাধ্যমে প্রয়োজন মানবসম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদ ও অন্যান্য সম্পদের দক্ষতা বাড়িয়ে দারিদ্র্য বিমোচন, ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা। এ লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে কারিগরি শিক্ষার হার বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশে ২০২১, ২০৩০ ও ২০৪০ সালের মধ্যে এ হার যথাক্রমে ২০, ৩০ ও ৪০ শতাংশে উন্নীত করবার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এজন্য দেশে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন ও তার আলোকে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠনসহ নতুন নতুন কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হচ্ছে। তার পরও বলতে হচ্ছে, দেশে কারিগরি শিক্ষার হার কাক্সিক্ষত হারে বাড়েনি।

কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে পত্রপত্রিকায় নতুন যে খবর প্রকাশিত হয়েছে তাতে হতাশার সুর রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কারিগরি শিক্ষায় বিরাজ করছে শুভংকরের ফাঁকি। কারিগরি শিক্ষার্থীর বর্তমান হার ১৪ শতাংশ বলা হলেও আন্তর্জাতিক কারিগরি শিক্ষার সংজ্ঞা অনুযায়ী বাস্তবে এটা ৮.৪৪ শতাংশ। কারণ এ শিক্ষাব্যবস্থায় রয়েছে নানাবিধ সংকট। শ্রেণিকক্ষ, ল্যাবরেটরি ও শিক্ষকসংকট মারাত্মক। এক শিক্ষককে দিয়ে চালানো হচ্ছে দুই শিফট। এ নিয়ে শিক্ষকের মধ্যে ক্ষোভ বিদ্যমান। ফলে মানসম্পন্ন কারিগরি শিক্ষা যেনো সুদূরপরাহত। এই শিক্ষাব্যবস্থা হতে মেয়েরা কেনো বিমুখ হচ্ছে তা অনুসন্ধান করা উচিত। শ্রমবাজারের সঙ্গে অনেক কোর্স-কারিকুলামের কোনো সংগতি নেই। অর্থাৎ সিলেবাস এখনো যুগোপযোগী নয়। কারিগরি শিক্ষা লাভ করে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থীরা তেমন একটা সুযোগ পাচ্ছে না, ফলে বাড়তেছে না তাদের সামাজিক মর্যাদা। এ কারণে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের কারিগরি শিক্ষায় ভর্তি করতে উৎসাহিত হচ্ছেন না।

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি