Loading..

খবর-দার

১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০৩:১১ অপরাহ্ণ

শিক্ষকসংকটে নিমজ্জিত প্রাথমিক শিক্ষা

শিক্ষকসংকটে নিমজ্জিত প্রাথমিক শিক্ষা

প্রাক প্রাথমিকে ২৮ হাজার স্কুলের শিক্ষক পদ শূন্য। যা গত ২৬ আগস্ট দৈনিক আমাদের বার্তা পত্রিকার প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে। আনুপাতিক হারে হিসাব করলে আনুমানিক প্রাক প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণিসহ অষ্টম শ্রেণির বিদ্যালয় পর্যন্ত ১ লাখ ৬০ হাজার শিক্ষকের পদ শূন্য আছে। শিক্ষক পদ শূন্যের ভয়াবহতা ১৯৭৫ সাল থেকে চলে আসছে।

স্বাধীনতার পর প্রথম নিয়োগ প্রক্রিয়ায় প্যানেল ব্যবস্থা ছিল। যার ফলে শিক্ষক পদ শূন্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্যানেলে অপেক্ষমান তালিকা থেকে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হতো। প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে প্যানেল বা অপেক্ষমান তালিকা লোপ পাওয়ায় শিক্ষকসংকট প্রকট হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষায় ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন, দক্ষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক থাকলেও শিক্ষকসংকট প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে অনেকটা বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। যা অনেকটা ‘উপরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট’ প্রবাদের মতো।শিশুশিক্ষার বিপর্যয়ের ভাবনা মন্ত্রী বা নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তাদের মনে কেন যে আসে না তা বোধগম্য নয়। শিশুদের প্রতি তাদের যে ভালবাসা মোটেই নেই তা নয়। এ প্রেক্ষাপটে জমিদার বাড়ির কাজের মহিলার গল্প উপস্থাপন করছি; জমিদার বাড়ির কাজের মহিলার সন্তান কুয়ায় পড়ে গেছে।

এ নিয়ে অসহায় কাজের মহিলার কান্নাকাটি চলছে, ওদিকে জমিদার কাজের মহিলাকে তিরস্কার ও ধমকা-ধমকি করলেন, সবশেষে চাকরিচ্যুতির ঘোষণা দিলেন। এরই মাঝে দেখা গেল কাজের মহিলা তার সন্তানকে আবেগে, আনন্দমিশ্রিত অবস্থায় জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছেন। জানা গেল কুয়ায় পড়েছে জমিদারের সন্তান।জমিদার কালক্ষেপণ না করে কুয়ায় নেমে তার সন্তানকে উদ্ধার করেন।শিশুদের প্রতি এমন ভালবাসাই প্রাথমিক শিক্ষায় চলে আসছে।ক্ষমতাসীন মন্ত্রী, সচিব, ডিজিসহ সংশ্লিষ্টরা বক্তৃতা, বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা বলতে বলতে অনেকটা ক্লান্ত হয়ে গেছেন।শিশুদের প্রতি বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অকৃত্রিম ভালবাসা উপলদ্ধি করুন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের ঊষালগ্নে চরম অভাবের সময় তৃণমূলের খেটে খাওয়া মানুষের কথা ভেবে প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেছিলেন। তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত যোগ্য উত্তরসূরী ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাও গরিব, মেহনতি মানুষের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে সব বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন। ৭৫ সালের পর থেকে সংশ্লিষ্টরা বছরের পর বছর প্রাথমিক বিদ্যালয়কে চরম শিক্ষকসংকটে রেখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পরিপন্থী কাজ করে চলেন। শিক্ষা অধিকার।

শিশুর শিক্ষার অধিকার বিঘ্ন সৃষ্টি করা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। সংশ্লিষ্টদের চেয়ার তো শূন্য থাকে না। খানিকটা ধুলাবালি পড়ারও সুযোগ নেই। আজকের শিশু আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎকে কেন শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে? এ শিশুদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার কলঙ্কজনক কাজটি নিয়ে আজও কেন কারো ভাবনা দৃশ্যমান হয় না।
এমনিতো প্রাথমিক শিক্ষকেরা পদোন্নতির বেড়াজালে আবদ্ধ, তারা ১১/১৩ স্কেলের মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছেন। সব শিশুর জন্য অভিন্ন বই, কর্মঘণ্টা আজও হয়ে ওঠেনি। ডিপ.ই-এড. শিক্ষকসহ প্রধান শিক্ষকদের টাইমস্কেল প্রাপ্তি নিয়ে একটি ঘটনা মনে পড়ছে। পাকিস্তানি আমলে এক অবাঙালি ট্রাফিক পুলিশ একটি সাইকেলে দুজন যুবককে যেতে দেখে বললো, ‘ইয়ে আদমী, তোম রূখো। তোম ডাবলিং কিউ করারাও। ইয়ে কানুন কা বরখেলাপ হায়।’ এমন সময় ট্রাফিক পুলিশের সামনে দিয়ে আরেকটি সাইকেলে তিনজনকে যেতে দেখে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘ইয়ে কানুন কা বরখেলাপ নেহি হায়।’ স্বাধীন বাংলাদেশে ৫০ বছর পরে প্রাথমিক শিক্ষায় নানা অসংগতি, বৈষম্য। এ অসংগতি ও বৈষম্য দূর করতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গতি অত্যন্ত ধীর। প্রাথমিক শিক্ষার সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্টদের ধীরগতি প্রাথমিক শিক্ষার দুর্নীতির মূল কারণ। নানা যন্ত্রণার মাঝে কাজ করতে হয় প্রাথমিক শিক্ষক সমাজকে।এর মধ্যে শিক্ষকসংকটে প্রাথমিক শিক্ষকদের অপরাধের বোঝা মাথায় নিয়ে বেড়াতে হয়। অভিভাবক, সুধীমহল এমনকি প্রাথমিকে যারা শিক্ষকসংকট তৈরি করছেন তাদের কাছ থেকেও ‘প্রাথমিক শিক্ষকেরা ঠিকমত পড়ায় ন ‘ এ অপবাদ শুনতে হয়। এ প্রসঙ্গে বাবু-মাঝির কবিতা মনে পড়ে গেল, বাবু মাঝি কবিতার সাঁতার জানা সম্পর্কে বাবুকে প্রশ্ন করলে বাবু বলেন, সাঁতার জানি না। মাঝি বাবুকে বললেন, আপনার বিশাল জ্ঞান ষোল আনাই মিছে। এ ঝড় তুফানে নৌকা ডুবে গেলে মৃত্যু অনিবার্য।

প্রাথমিক শিক্ষায় বর্তমান সরকারের অর্জন বিশাল। যা দেশ-বিদেশে সমাদৃত। কিন্তু শিক্ষকসংকট অব্যাহত থাকলে সব অর্জন বাবু-মাঝি কবিতার মতো ষোল আনাই মিছে পরিণত হবে। এ সংকট প্রাথমিকের মূল চ্যালেঞ্জ। প্রত্যেকটি নিয়োগ পরীক্ষা গ্রহণে স্বাভাবিকভাবে দুই বছর সময় লাগে।

এরই মাঝে অবসর গ্রহণ, মৃত্যু, অন্য পেশায় চলে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। নানা কারণে প্রাথমিকে শিক্ষকসংকট অনেকটা ‘নদীর একুল গড়ে, ওকুল ভাঙে এইতো নদীর খেলা’ গানের মতো। ২, ৩, ৪ বছর পর শিক্ষক নিয়োগ হয়। এর মাঝে বিপুলসংখ্যক পদ শূন্য। নদীর ভাঙা-গড়ার খেলার মতো, শিশুদের জীবন নিয়ে এ খেলা চলতে দেওয়া কাম্য নয়। ২০১৪ সালে প্রাথমিক নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর ২০১৮ সালে নিয়োগ দেওয়া হয়। এতে প্রাথমিক শিক্ষক হওয়ার ভাবনা নিয়ে যারা বিভোর সেসব নিয়োগপ্রত্যাশীদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে আবেদন করার বয়স থাকে না। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যারা মৌখিক পরীক্ষায় বাদ পড়ে তারা বয়স হারায় সংশ্লিষ্টদের সময়ক্ষেপণের জন্য। প্রাথমিক শিক্ষায় নিয়োগে প্যানেল বা অপেক্ষমান তালিকা থাকুক। যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষকের যথাযথ পাঠদান থেকে বঞ্চিত না হয়। সংকট দূর করতে একমাত্র পথ শিক্ষক নিয়োগে অপেক্ষমান তালিকা।

শিক্ষকসংকটের এ চ্যালেঞ্জ দূর করতে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতীয়করণের স্বপ্ন পরিপূর্ণ হবে।

লেখক : সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ; সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, দৈনিক শিক্ষাডটকম।