Loading..

খবর-দার

২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১২:২৭ পূর্বাহ্ণ

বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাবে কাঠের দালান

ইউরোপ-আমেরিকার অনেক নামকরা স্থপতি আজকাল কাঠের প্রেমে পড়েছেন বলে মনে হচ্ছে। ইস্পাত ও কংক্রিটের দালান ছেড়ে তাঁরা ঝুঁকছেন কাঠের বাড়ি, কাঠের অফিস বা ডর্ম তৈরিতে। কানাডার প্রিন্স জর্জ সিটির পুরোনো লগিং শহরে একটি বিল্ডিং রয়েছে ৩০ মিটার এবং আটতলা। এই উঁচু বিল্ডিংটি বিশ্বের আধুনিকতম ও উঁচু কাঠের দালানের মধ্যে একটি। ভবনটি আসলে ইউনিভার্সিটি অব নর্দান ব্রিটিশ কলম্বিয়ার (ইউএনবিসি) উড ইনোভেশন অ্যান্ড ডিজাইন সেন্টার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ভবনটির একটি বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কাঠের এই স্থাপনাকে বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রশমন আন্দোলনের এক জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত বলে মনে করা হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ভবনটি যদি কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে তৈরি হতো, তাহলে এটা নাকি ৪০০ টনেরও বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করত। সেটা থেকে বেঁচে গেছে পৃথিবী। এই বিল্ডিং ১ হাজার ১০০ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড আটকে রাখে, যা ব্রিটিশ কলম্বিয়ান বৃক্ষ পরিবেশ থেকে সংগ্রহ করতে পারত। সব মিলে এক বছরে ১৬০টি পরিবার যে পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করত, তার সমপরিমাণ এই বিল্ডিং ধরে রাখে! কাঠের ‘কামব্যাক’

রেনেসাঁর যুগে বাড়িঘর তৈরি হতো কাঠ দিয়ে আধুনিক স্থাপত্যে সেই কাঠের এমন কামব্যাক আগে কল্পনাও করা যায়নি। গত দুই দশকে স্থপতি ও প্রকৌশলীরা কাঠ দিয়ে নির্মিত ভবনের গুরুত্ব নতুন করে অনুধাবন করতে শুরু করেন। আমেরিকার ইয়েল ইউনিভার্সিটির বন ও পরিবেশবিদ চ্যাড অলিভারের একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, কংক্রিট ও স্টিলের বদলে কাঠের আবাসনশিল্প ৩১ শতাংশ পর্যন্ত কার্বন নিঃসরণ প্রশমিত করতে পারবে! কার্বন নিঃসরণ প্রশমিত হওয়ার এই হার আসলে বৈশ্বিক উষ্ণতার বর্তমান গ্রাফকে পুরো উল্টে দিতে সক্ষম।

এই দশকে নতুন করে আকাশচুম্বী কাঠের স্থাপনা তৈরি শুরু হয়েছে। ২০১৫ সালের এর শেষদিকে নরওয়ে ৫২.৮ মিটারের একটি টাওয়ার ব্লক নির্মাণ করে, যা ছিল ঐ সময়ে সবচেয়ে উঁচু কাঠের দালান। এরপর ২০১৬ এর সেপ্টেম্বরে ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়া শিক্ষার্থীদের জন্য একটি আবাসিক ভবন নির্মাণ করে রেকর্ডটি নিজেদের করে নেয়। এই কাঠের স্থাপনাটি নরওয়ের টাওয়ার থেকে মাত্র ০.২ মিটার উঁচু! অর্থাৎ এর উচ্চতা ৫৩ মিটার। এ বছর অস্ট্রিয়ার ভিয়েনাতে ৮৪ মিটার উচ্চতার একটি কাঠের ভবন তৈরি করার পরিকল্পনা করা হয়েছে, যা হবে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে উঁচু কাঠের বিল্ডিং। হোহো বিল্ডিং নামের এই স্থাপনাটি হোটেল, আবাসিক ভবন ও অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হবে।

বর্তমান বিশ্বে বসতবাড়ি নির্মাণ অনেক খরচের ব্যাপার। স্থাপনাশিল্পের পুরো অংশই, বিশেষ করে বড় ও আকাশচুম্বী স্থাপনা নির্মাণ পুরোপুরি কংক্রিট ও স্টিলের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। অন্যদিকে কাঠশিল্প, অর্থাৎ কাঠ দিয়ে বসতবাড়ি তৈরির সংস্কৃতিকে পুরো বিশ্বে পরিচয় করিয়ে দেওয়া অতটা সহজ নয়। কারণ, কাঠের তৈরি ভবন আসলেই জলবায়ু পরিবর্তনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ এখানে পুরো বিশ্বের বনভূমি ও পরিবেশের খাপ খাইয়ে নেওয়ার ব্যাপার থাকে। কয়েকজন গবেষক জানিয়েছেন, বন থেকে বেশি পরিমাণে কাঠ সংগ্রহ করা হলে তা বনভূমির ইকোসিস্টেমকে প্রভাবিত করতে পারে। উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে কাঠ চোরাকারবারির প্রভাব অনেক বেশি থাকায় সেসব জায়গায় পরিবেশ ভয়াবহভাবে বিপন্ন হতে পারে। চ্যাড অলিভার মনে করেন, ‘আমরা যদি কাঠ কেটে বিল্ডিং বানাতে যাই, তা এমনভাবে করতে হবে, যাতে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকে এবং জীববৈচিত্র্য বিপন্ন না হয়।

কাঠ দিয়ে তৈরি স্থাপনার খুঁটিনাটি

১৪০০ বছর আগে যখন কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে ঘরবাড়ি তৈরি হতো না, সে সময় জাপানের ইকারুগার বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা ৩২ মিটার উঁচু একটি প্যাগোডা বানান। এটি তৈরিতে তাঁরা কাঠের ওপরেই ভরসা করেছিলেন। এরপর চীনের ইংজিয়ান নামক স্থানে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের বানানো সাকায়ামুনি প্যাগোডার কথাও উল্লেখ করা যায়। ১০৫৬ সালে নির্মিত এই কাঠের উপাসনালয়টির উচ্চতা ৬৭ মিটার! এই উপাসনালয়গুলো এখনো সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে গত কয়েক দশকে কাঠের স্থাপনা সম্পর্কে প্রকৌশলীদের মধ্যে খুব খারাপ ধারণা তৈরি হয়। লন্ডন, নিউইয়র্ক ও শিকাগোর মতো শহরে কাঠের দালানগুলো একসময় সর্বনাশা আগুনের খপ্পরে পড়ে মিশে যায় মাটিতে। পরে গবেষণা থেকে জানা যায়, যথাযথ উড ট্রিটমেন্ট করা হলে স্টিল ও কংক্রিটের মতো কাঠ গলে বা দুর্বল হয়ে যায় না।

অস্ট্রিয়ার টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব গ্রাজের গবেষকেরা কাঠ নিয়ে কিছু সাধারণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। গবেষকেরা কাঠের তক্তাকে একে অপরের সঙ্গে লম্বালম্বিভাবে আঠা দিয়ে জোড়া লাগান। তাঁরা আবিষ্কার করেন যে কাঠের মধ্যে থাকা ফাইবারের প্যাটার্নের (উড গ্রেইন) দিক পরিবর্তনের ফলে তক্তার বিভিন্ন অংশে থাকা ছোটখাটো ত্রুটি ও দুর্বলতাগুলো নষ্ট হয়ে যায়। একে ক্রস-ল্যামিনেটেড টিম্বার বলা হয়। তক্তাগুলো জোড়া লাগানোর ফলে পুরো কাঠামোটির কাঠিন্য ও স্থায়িত্ব বৃদ্ধি পায়। ভবন নির্মাণের সময় এটিকে কারখানায় সাব-মিলিমিটার পর্যন্ত সূক্ষ্মভাবে কেটে বড়-ছোট করা যায়। ফলে নির্মাণের গতি বাড়ায় ও বর্জ্য হ্রাস করে। কাঠের এই কাঠামোর শক্তি বিবেচনা করে গবেষকরা বলেছেন, এই কাঠামো ব্যবহার করে কাঠের তৈরি বিল্ডিং কত উঁচু হতে পারে তার কোন তাত্ত্বিক সীমারেখা নেই।

বর্তমানে প্রকৌশলবিদ্যা ও নিরাপত্তাবিজ্ঞান অনেক এগিয়েছে। কাঠের বিমকে পেরেক কিংবা আঠার সাহায্যে জোড়া দেওয়ার মাধ্যমে সেটা ভবন নির্মাণে ব্যবহার করার মতো আধুনিক টিম্বার প্রযুক্তির বাজার প্রসারিত হয়েছে। ইউরোপের দেশগুলো গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ও শক্তির অপচয় রোধের ব্যাপারে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। তাই স্থপতিরা বাড়ির নকশা করার সময় পরিবেশের ওপর সেটার প্রভাব সর্বনিম্ন রাখার ব্যাপারে একরকম বাধ্যই হয়েছেন। কাঠের তৈরি বাড়ির সংখ্যা তাই বাড়ছে। সেই সঙ্গে এই বাড়িগুলোর নিরাপত্তার দিকগুলোও বিবেচনা করছেন বিজ্ঞানীরা। ড. উইমার্সের গবেষক দল ‘টল উড প্রজেক্ট’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। মার্কিন ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে করা এই প্রকল্পে দলটি কাঠের উঁচু স্থাপনার ভূমিকম্প প্রতিরোধক্ষমতা নিয়ে কাজ করছে। তারা দেখেছে, কংক্রিট ও ইস্পতের চেয়ে কাঠের ভবনগুলোর ভূমিকম্প প্রতিরোধক্ষমতা বেশি।

কার্বন ট্র্যাকিং

কাঠের নির্মাণশিল্প নিয়ে আগ্রহের মূল কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো তার গ্লোবাল ওয়ার্মিং বন্ধ করার ক্ষমতা। আমরা কাঠকে কেবল জ্বালানি হিসেবে পুড়িয়ে ফেলার জন্যই বেশি ব্যবহার করি। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা কাঠকে না পোড়াচ্ছি, অর্থাৎ কাঠকে না পুড়িয়ে একে নির্মাণশিল্পে ব্যবহার করার অর্থ হলো আমরা কিছু পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইডকে পরিবেশের সঙ্গে মিশতে দিচ্ছি না। ফলে বায়ুমণ্ডলে মোট কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়তে পারছে না। অন্যদিকে হুট করে বনভূমি থেকে অধিক পরিমাণে কাঠ কাটা হলে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা থাকে। সে ক্ষেত্রে এমন একটি উপায়ে বনভূমি থেকে কাঠ সংগ্রহ করতে হবে, যাতে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকে। তাহলে অধিক পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড আমরা ধরে রাখতে পারব। নিয়মিত বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি ও বনভূমি সংরক্ষণ এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

বিশ্বজুড়ে পরিচিত হোক কাঠের তৈরি স্থাপনা

কাঠের বিল্ডিং তৈরির আন্দোলন এখন ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকাতেই সীমাবদ্ধ। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বন ব্যবস্থাপনা একটি চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এটি সত্যি। এরপরও এ আন্দোলন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। ইতিমধ্যে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) তুরস্কে বিশেষ বন ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা করছে, যাতে এখানে আধুনিক কাঠের কাঠামো নির্মাণ করা যায়।

একটি কাঠের স্থাপনা ধীরে ধীরে পুরোনো হওয়া শুরু হলে এটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে কংক্রিট কাঠের চেয়ে বেশি দিন টেকে। কিন্তু কাঠও যে দীর্ঘজীবী হতে পারে, তা এখন আমরা বুঝতে পারি। দশ-পনেরো বছর আগেও যা করা যেত না, তা আমরা আজ করতে পারি। আমরা যদি কাঠকে ল্যান্ডফিলে ফেলে দিই, তাহলে তার কার্বন ধীরে ধীরে বায়ুমণ্ডলে ফিরে আসবে। কিন্তু ভবিষ্যতের বিভিন্ন নির্মাণ প্রকল্পে কাঠ রিসাইকেল করে ব্যবহার করা হলে কার্বন বায়ুমণ্ডলে ফিরে যেতে পারবে না এবং এটি বৈশ্বিক উষ্ণতা কমানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে গবেষকেরা আশা করছেন।

আমরা তাহলে দিন গুনতেই পারি। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন আমাদের দেশেও কংক্রিট ও স্টিলের পাশাপাশি কাঠ দিয়ে আকাশচুম্বী ভবন নির্মিত হবে!