Loading..

পাঠসংশ্লিষ্ট ছবি/ইমেজ

০৫ অক্টোবর, ২০২১ ০৩:৩২ অপরাহ্ণ

শিক্ষকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় জাতির পিতার পদক্ষেপ

শিক্ষা জাতির   মেরুদণ্ড,   শিক্ষিত   জাতি   অনুন্নত   বা   পশ্চাৎপদ   থাকার কোনো   নজির  পৃথিবীতে নেই।  বঙ্গবন্ধুর   স্বপ্ন   ছিল   সোনার   বাংলা বিনির্মাণ। তাই শিক্ষিত জাতি গঠনের মধ্য দিয়ে সোনার বাংলা গড়ে তুলতে শিক্ষককে  তিনি বিশেষ  গুরুত্ব   প্রদান করেছিলেন। তাঁর বক্তব্যে তিনি যথার্থ বলেছিলেন, “সোনার বাংলা গড়তে সোনার মানুষ চাই।” সোনার মানুষ আকাশ থেকে পড়বে না, মাটি থেকেও গজাবে না।এই বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে থেকে তাদেরকে সৃষ্টি করতে হবে। নবতর চিন্তা, চেতনা ও মূল্যবোধের মাধ্যমেই সেই নতুন মানুষ সৃষ্টি সম্ভব। শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তিনি জাতিকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে সোনার মানুষ হিসেবে গড়তে চেয়েছিলেন। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু ছিলেন শিক্ষার প্রকৃত অনুরাগী। বর্তমান প্রবন্ধে বঙ্গবন্ধু শিক্ষা দর্শন আলোকে শিক্ষকের মর্যাদা সংক্রান্ত তাঁর ভাবনা ও কার্যক্রম তুলে ধরা হয়েছে।

 

বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শন: শিক্ষা দর্শন এমন একটি বিষয় যা জ্ঞানের বিভিন্ন দিক, জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা যা শিক্ষার সাথে জড়িত তা আলোচনা করে। অর্থাৎ শিক্ষার স্বরূপ, শিক্ষার প্রকৃতি নির্ধারণ, শিক্ষার লক্ষণ নির্ধারণ এবং শিক্ষার সমস্যা নিরসনে যৌক্তিক কাঠামো সংক্রান্ত বিদ্যাই শিক্ষা দর্শন। শিক্ষাক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর দর্শন বাংলাদেশকে আধুনিকভাবে গড়ে তোলার একটি যুগোপোযোগি দর্শন হিসেবে বিবেচিত। আর এই শিক্ষাদর্শনের অন্যতম দিক ছিল অসাম্প্রদায়িকতা, সততা ও মানব কল্যাণ। বঙ্গবন্ধু একজন রাজনীতিবিধ, একজন রাষ্ট্রনায়ক। শুধু তাই নয় তিনি ছিলেন একাধারে লেখক, ভ্রমণবিদ, আত্মজীবনী রচয়িত শিক্ষা দার্শনিক ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদ। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর ৩টি গ্রন্থে (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা ও আমার দেখা নয়া চীন) তিনি তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা, সাহিত্য প্রেম শিক্ষা ভাবনা ও মানব কল্যাণে বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের অন্যতম ভিত্তিভূমি হচ্ছে তাঁর শিক্ষাদর্শন। অর্থাৎ শিক্ষাকে রাজনৈতিক দর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে জনগণের জন্য গণমুখীশিক্ষা প্রসারে তিনি তাঁর কর্মপন্থা নির্ধারণ করেছিলেন।  

১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে নভেম্বর মাসে  রেডিও- টেলিভিশনে এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শিক্ষা নিয়ে তাঁর ভাবনা বিষয়ে বেশকিছিু কথা বলেন। তিনি বলেন,  “সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষাখাতে পূঁজি বিনিয়োগের চেয়ে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারে না। কলেজ ও স্কুল, বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করতে হবে।” ঐ বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, পাঁচবছর বয়সী শিশুদের বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে একটি ক্রাশ প্রোগ্রাম চালু করতে হবে। মাধ্যমিক শিক্ষার দ্বার সকল শ্রেণির জন্য খোলা রাখতে হবে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে দারিদ্র যেন মেধাবীদের জন্য বাধা না হয়ে দাঁড়ায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। বঙ্গবন্ধুর এ বক্তব্যের মধ্যদিয়ে শিক্ষাকে গণমুখী ও সার্বজনীন করার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়।

 শিক্ষকের মর্যাদা : শিক্ষা মানুষের মনুষ্যত্ব বিকাশ এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের মানোন্নয়নে মূল ভূমিকা পালন করে। শিক্ষার অপর নাম আত্মসচেতনতা ও উন্নয়ন। তাই সুষ্ঠু সমাজ  ব্যবস্থা  গড়ে  তুলতে   শিক্ষার  প্রসার  ও   শিক্ষকের মর্যাদা প্রশ্নটি বিশেষভাবে জড়িত। শিক্ষককে বলা হয় জাতি গড়ার কারিগর। এ বিবেচনায় শিক্ষক সমাজের প্রতি বঙ্গবন্ধুর শ্রদ্ধাবোধ ছিল অপরিসীম। তিনি শিক্ষকদের সম্মান করতেন, শ্রদ্ধা করতেন এবং শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষায় ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। এ বিষয়ে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে-

প্রথমত,  ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদালয়ে সংঘটিত একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। পাকিস্তানের বন্দীদশা থেকে দেশে ফিরে এসেছেন বঙ্গবন্ধু। সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশের পর্বতময় সমস্যা মোকাবেলায় রাতদিন পরিশ্রম   করছেন   বঙ্গবন্ধু। এমন   সময়   ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের   পরীক্ষার্থীরা   পরীক্ষা   ছাড়াই   ডিগ্রি   প্রদানের   জন্য আন্দোলন শুরু করলো। পরীক্ষার্থীদের দাবি ছিল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য তারা লেখাপড়া করতে পারেনি এমনকি যুদ্ধ শেষে দেশে তারা বই খাতা ও নোটপত্রও খুঁজে পাচ্ছে না।

আন্দোলনরত পরীক্ষার্থীদের দাবিও কিছুটা যুক্তিযুক্ত। তবে পরীক্ষা ছাড়া ডিগ্রি   প্রদান   করলে   দেশ   বিদেশে   ঢাকা   বিশ্ববিদ্যালয়ের   সম্মান   ও গ্রহণযোগ্যতা  দারুণভাবে  ক্ষুন্ন   হবে  বিবেচনা   করে  বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ   পরীক্ষার্থীদের   এ   দাবি   সরাসরি   নাকচ   করে   দেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি আদায়ের প্রশ্নে অনড় অবস্থান গ্রহণ করে এবং প্রচন্ড আন্দোলন   শুরু   করে। এ  অবস্থায়   ঢাকা   বিশ্ববিদ্যলয়ের   তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী ছাত্রদের দাবির কাছে কোনোভাবেই নতি স্বীকার করতে রাজি হলেন না। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে সামগ্রিক   বিষয়টি   আলোচনার   জন্য   তিনি   বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক   কাউন্সিলের   সভা   আহবান   করেন।  একাডেমিক   কাউন্সিলের প্রায় সকল সদস্যই ছাত্রদের দাবি প্রত্যাখ্যান করে বক্তব্য রাখেন। এ খবর জানতে পেরে দাবি আদায়ে মরিয়া ছাত্ররা একাডেমিক কাউন্সিলের সভাকক্ষ অবরোধ   করে।   শুধু   তাই   নয়   ছাত্ররা   সভাকক্ষের   পানি   ও   বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। অন্ধকরাচ্ছন্ন সভাকক্ষের পরিবেশ ক্রমেই ভয়াবহ   হয়ে  ওঠে। অধ্যাপক মোকারম   হোসেন খন্দকারসহ   কয়েকজন বয়োবৃদ্ধ শিক্ষক সভাকক্ষে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। 

উপর্যুক্ত অবস্থা চলাকালে তৎকালিন গণভবনে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে মন্ত্রী পরিষদের এক জরুরি সভা চলছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ ছাত্রদের দ্বারা অবরুদ্ধ আছেন এমন সংবাদ পেয়ে তিনি খুবই বিচলিত হন এবং সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রী পরিষদের সভা স্থগিত করে তিনি ছুটে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবনের সভাকক্ষে। বঙ্গবন্ধুর গাড়ি আসছে দেখতে পেয়ে অবরোধকারী ছাত্ররা দ্রুত পালিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু অবরুদ্ধ কাউন্সিল কক্ষে প্রবেশ করেন এবং অবরুদ্ধ শিক্ষকদের উদ্ধার করেন। অতপর তিনি শিক্ষকদের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলেন এবং ছাত্রদের এই বাড়াবাড়ির জন্য সরকার প্রধান হিসেবে দু:খ প্রকাশ করে নিজ দপ্তরে ফিরে যান। ২ এই হলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। 

দ্বিতীয়ত, ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ মার্চ রাত। তৎকালে নাইট শিফট চালু ছিল জগন্নাথ কলেজে। অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান বসে আছেন নিজ কক্ষে। হঠাৎ বঙ্গবন্ধু প্রবেশ করলেন অধ্যক্ষ স্যারের অফিস কক্ষে।বঙ্গবন্ধুর এই আগমনের কারণটিও চমকপ্রদ। 

উল্লেখ্য, অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান ছিলেন বঙ্গবন্ধুর শিক্ষক। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গবন্ধু কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হয়ে যে ‘বেকার’ হোস্টেলে থাকতেন সাইদুর রহমান ছিলে সেই বেকার হোস্টেলের তত্ত্বাবধায়ক। অসাম্প্রদায়িক ও উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চায় তিনি বঙ্গবন্ধুকে অনেকখানি প্রভাবিত করেছিলেন। বর্তমানের পর্যটন কর্পোরেশন আওতাভুক্ত হোটেল সৈকত তখন চট্টগ্রাম রেস্ট হাউজ নামে পরিচিত ছিল। শিক্ষা সফরে থেকে জগন্নাথ কলেজের একদল ছাত্র নিয়ে সেখানেই উঠেছেন কলেজের জনপ্রিয় শিক্ষক ড. মোহাম্মদ শাহাদত আলী ও অধ্যাপক ওয়াকেফ হোসেন চৌধুরী (অধ্যক্ষ হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত)। প্রাক্তন মন্ত্রী জহুর আহমেদ চেওধুরী ছিলেন শ্রমিক লীগের নামকরা নেতা। কোনো একটি বিষয় নিয়ে হোটেলে অবস্থানরত জনৈক ছাত্র এবং এক হোটেলবয়ের মধ্যে ঝগড়া হয় এবং একপর্যায়ে ছাত্রটি হোটেলবয়কে চপেটাঘাত করে। ঘটনার পর বর্ণিত শিক্ষকদ্বয় হোটেল ম্যানেজারের সহায়তায় ঘটনাটি মীমাংসা করে দেন এবং হোটেল বেয়ারাকে একশত টাকা দেন। ঘটনাটির এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটে। শিক্ষা সফর শেষে হোটেল ত্যাগ করার সময় সমাগত, হোটেল বিল পরিশোধ করে শিক্ষা সফরের বাসে মালপত্র তোলা হয়ে, এমন সময় ঝড়ের গতিতে সেখানে উপস্থিত হন তৎকালিন নামকরা শ্রমিক নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরী। মারমুখী হয়ে বললেন, “কাউকে ফেরত যেতে দেব না, কর্ণফুলীর পানি এদের রক্তে রঞ্জিত করা হবে”। অনেক তর্ক বিতর্কের পর পূর্বে সংঘটিত ঘটনার মাশুল হিসেবে পাঁচশত টাকা তাকে পরিশোধ করে জগন্নাথ কলেজের ছাত্র-শিক্ষকগণ ঐ স্থান ত্যাগ করার সুযোগ পায়। 

উপর্যুক্ত ঘটনার বেশকিছুদিন পর হোটেল ইডেনে চলছিল আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভা। এ সভায় জগন্নাথ কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি রাজিউদ্দীন আহমেদ রাজু (প্রাক্তন মন্ত্রী ও সাংসদ) ও অন্যান্য ছাত্রনেতারা ঘটনাটি বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেন। বঙ্গবন্ধু ঘটনা শুনে ব্যথিত হন এবং জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ বঙ্গবন্ধুর শিক্ষক প্রফেসর সাইদুর রহমানের কাছে ছুটে গিয়ে চট্টগ্রামের ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। ঘটনার সময় উপস্থিত শিক্ষক ড. মোহাম্মদ শাহাদত আলীর কাছেও তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন এবং ঘটনার খেসারত হিসেবে তাঁর দেয়া পাঁচশত টাকা তাকে ফেরৎ দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, “টাকাটা আমার নয়, জহুর চৌধুরীর কাছ থেকে আদায় করেছি”। মুঘল বাদশা আলমগীর শিক্ষককে মর্যাদা না দেয়ায় নিজ পুত্রকে র্ভৎসনা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষায় যা করলেন তা সত্যিই একটি বিরল ঘটনা।

 তৃতীয়ত, ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ঘটনা। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও তাঁর প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকের কথা ভুলেননি। বেজেন্দ্রনাথ সূত্রধর ছিলেন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক এবং সৈয়দ নুরুল হক মানিক ছিলেন সহপাঠি ও তাঁর শৈশবের খেলার সাথী। ১৯২৭ থেকে ১৯২৯ পর্যন্ত তিনি পড়েছেন এ শিক্ষকের কাছে। তাই প্রিয় শিক্ষক ও সহপাঠি বন্ধুটিকে দেখতে তাদেরকে ঢাকা আসার জন্য খবর পাঠান বঙ্গবন্ধু। নির্দিষ্ট তারিখে তাঁরা দুজন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য অফিসের গেইটে উপস্থিত হয়ে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি চান। বঙ্গবন্ধু খবর পেয়ে সব নিয়মকানুন উপেক্ষা করে তাঁর প্রাইমারি স্কুল জীবনের শিক্ষকের কাছে নিজেই ছুটে আসেন এবং পায়ে ধরে সালামের পর বুকে জড়িয়ে ধরেন। গেইটে তখন অভাবনীয় দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। অতঃপর বঙ্গবন্ধু তাঁর শৈশবের খেলার সাথী স্কুল জীবনের বন্ধু মানিককেও জড়িয়ে ধরেন। বঙ্গবন্ধু সেই শিক্ষককে নিয়ে যান প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর অর্থাৎ তাঁর অফিস কক্ষে। তিনি শিক্ষককে নিয়ে নিজের চেয়ারে বসিয়ে উপস্থিত, মন্ত্রী, এমপিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে গর্বভরে বলেন, “আমার শিক্ষক”। অতঃপর বঙ্গবন্ধু তাঁর স্কুল জীবনের শিক্ষক ও সহপাঠির নানা খোঁজ খবর নেন। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শিক্ষকের হাতে কিছু টাকা দেন তাঁর ঘর তোলার জন্য।

চতুর্থত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ছিলো এক আবেগমিশ্রিত অনুভূতির সম্পর্ক। অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম, আব্দুর রাজ্জাক, ড. আব্দুল মতিন চৌধুরী প্রমুখ প্রথিতযশা শিক্ষাবিদদেরকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন। প্রখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী ড. আব্দুল মতিন চৌধুরী সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর সম্মানবোধ সম্পর্কে শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘‘ড. আব্দুল মতিন চৌধুরী তাঁর স্বভাবসুলভ সত্য ভাষণ, ন্যায়সুন্দর দৃষ্টিভঙ্গি এবং জাতীয়তাবোধের প্রতি অকৃত্রিম আনুগত্য, বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধার কারণে পাকিস্তান আমলেই বিরাগভাজন হয়েছিলেন পাক-শাসক আইয়ুব খান এবং তার দোসর গভর্নর মোনায়েম খানের। শাসকগোষ্ঠীর এই তীব্র রোষানলে নিপতিত হওয়ার কারণেই তাকে তাঁর প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যেতে পর্যন্ত হয়েছিল। এমনকি তৎকালীন আইয়ুব-মোনায়েম চক্র তাঁর দায়িত্ব থেকে অন্যায়, অযৌক্তিক এবং শিষ্টাচারবহির্ভূতভাবে অপসারণ পর্যন্ত করেছিল। আমার স্মরণ আছে, সেই সময়ে বঙ্গবন্ধু তাকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘একদিন যখন সময় হবে, তখন অবশ্যই আপনাকে উপযুক্ত সম্মান দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনা হবে।’ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু তার সেই কথা রেখেছিলেন। ১৯৭৩ এর এপ্রিল মাসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এই প্রথিতযশা পদার্থবিদ এবং দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদে সসম্মানে অধিষ্ঠিত করেছিলেন”।

পঞ্চমত, ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ঘটনা। বঙ্গবন্ধু তখন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ঐ সময় একজন মুসলিম ছাত্র অন্যায়ভাবে মারপিটের শিকার হন। এ নিয়ে স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। বঙ্গবন্ধু তখন স্কুলের প্রধান শিক্ষক নরেন্দ্র দাশগুপ্তের কাছে বিষয়টির সুষ্ঠু মীমাংসা চান। নরেন্দ্র দাশগুপ্ত অন্য অনেকের সহায়তা নিয়ে ঘটনাটি মীমাংসা করে দেন। বঙ্গবন্ধু প্রধান শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ঘটনাটি যেভাবে মীমাংসা করা হয় সেভাবেই মেনে নেন এবং পরিস্থিতি শান্ত করেন। 

ষষ্ঠত, নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ ও পাকিস্তান বাহিনীর জ্বালাও পোড়াওসহ ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের ফলে বাংলাদেশ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্থ এক ভূখণ্ড। মুক্তিযুদ্ধকালিন সময়ে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে ৪০ লক্ষ টন খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। ব্যাংকসমূহ লুট করা হয়, ব্যাংকে গচ্ছিত কাগজ পত্র, দলিলপত্র ও ফাইল পুড়িয়ে ফেলা হয়। এ অবস্থায় ৯০ হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দি, আটককৃত ৩৭ হাজার রাজাকার ও দালাল অমবং লক্ষধীক ভারতীয় বাহিনীর খাদ্য সরবরাহ এক কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।এমন অবস্থার মধ্যেও বঙ্গবন্ধু নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে শিক্ষকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ করেন যেন শিক্ষকদের আর্থিক সংকটের কষ্টটা দূর হয়। 

সপ্তমত, বঙ্গবন্ধু শিক্ষক ও শিক্ষাবিদদেরকে যথাযথ মর্যাদা দিয়েছিলেন। তাই ১৩ সদস্য বিশিষ্ট প্রথম মন্ত্রীসভায় তিনি শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছিলেন শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ ইউসুফ আলীকে। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধুর  শিক্ষা দর্শনের অন্যতম প্রায়োগিক দিক হলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদে তিনি দেশের প্রথিতদশা শিক্ষাবিদদের নিয়োগ প্রদান করেছিলেন। তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, গৃহায়ণ মন্ত্রণালয়ে ইঞ্জিনিয়ার মইনুল ইসলাম, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ডা. টি. হোসেন, তথ্য মন্ত্রণালয়ে ভারপ্রাপ্ত সচিব পদে বাহাউদ্দিন চৌধুরীকে নিয়োগ দেন।৬ এছাড়াও বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. আব্দুল্লাহ আল মতি শরফুদ্দিনকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। অর্থাৎ আমলাতন্ত্রের বাইরে গিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে তিনি সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গকে নিয়োগ প্রদান করেছিলেন। 

অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা  ২০০৯ জাতীয় শিক্ষা নীতি প্রণয়ন কমিটিরর চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেন। এ শিক্ষা নীতির  চূড়ান্ত  খসড়ার ২৭ ধারায় রাখা হয়েছিল শিক্ষকরাও শিক্ষা সচিব হতে পারবেন এমন একটি ধারা। সচিব কমিটির সভায় এটা বাদ দেয়া হয়েছে। এটা বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শনের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন।

অষ্টমত, প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ: (ক) স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১১ হাজার নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং ৪০ হাজার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ এবং ৩৭,৫০০ হাজার বিদ্যালয় সরকারিকরণ করেন; 
(খ) ১ লাখ ৬৫ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকদের চাকরি সরকারিকরণ করেন 
(গ) প্রাথমিক শিক্ষকদের জন্য চাল ডালসহ পূর্ণাঙ্গ রেশন ব্যবস্থা চালু করেন;
(ঘ) পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠ্যবই এবং মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত নামমাত্র মূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহের নির্দেশ প্রদান করেন;
(ঙ) মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পোষাক প্রদানের নির্দেশ দেন; 
(চ) প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক এবং অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক ঘোষণা করেন;
এছাড়াও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন মুজিবনগর সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের প্রধান দূত নিয়োগ করে বিশ্বব্যাপী শিক্ষকের মর্যাদাকে সমুন্নত করেছিলেন। শুধু তাই নয়, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে দেশ-বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনকারী গবেষকদেরকে তিনি ২০ শতাংশ  উচ্চতর পদে সরাসরি নিয়োগের ব্যবস্থাও করেছিলেন। 

বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসন: ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালিন প্রেসিডেন্ট আইয়ূব খান বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের স্বায়ত্তশাসন সংকুচিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু কারাগাওে বসে তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, “ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসন শেষ হয়ে হেল। ভবিষ্যতে সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ে ডান্ডা চালাইতে সক্ষম হইবেন। অবস্থা যে কী হবে!” (কারাগারের রোজনামচা, পৃ.১৫৬)। তাই ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের শুরুতে তৎকালীন আইন মন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের জন্য গণতান্ত্রিক আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক সমিতি ও শিক্ষকদের কাছে মতামত চান। এসব মতামতের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে প্রশাসনিকভাবে স্বায়ত্তশাসন, সরকারি হস্তক্ষেপ বন্ধ, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাইকে গণতান্ত্রিক মতামত রাখার সুযোগ প্রদান, শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পড়াশুনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বিকাশের বিষয়টি উঠে আসে। এসব প্রস্তাব পাওয়ার পর ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দ্রুত স্বায়ত্বশাসন দিয়ে অধ্যাদেশ জারি করা হয়। শিক্ষক ছাত্রদের দীর্ঘদিনের চাওয়া পাওয়ার প্রতিফলন ঘটে আইনগুলোতে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার ফলে একটা আমুল পরিবর্তন আসে। আগে একটি ডিপার্টমেন্টের বয়োজোষ্ঠ শিক্ষক অবসরের আগ পর্যন্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করতেন। এর ফলে অন্য শিক্ষকরা প্রশাসনিক কাজে অভিজ্ঞতা লাভের এবং নিজেদেও ক্রিয়েটিভিটি দেখানোর সুযোগ কম পেতেন। স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্যিকার অর্থে জ্ঞানচর্চার তীর্থভূমি এবং মুক্তবুদ্ধিচর্চার প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে।

পরিশেষে বলা যায়, জাতির পিতা নিজেই ছিলেন একজন মহান শিক্ষক। তিনি প্রতিনিয়ত জাতিকে নানা শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। তাঁর ভাষণ ও লেখা বইগুলো আমরা যতই পড়ি ততই শিখি, অভিভুত হই। দেশ ও জাতির যুগ-সন্ধিক্ষণে ও কালের আবর্তে কিছু কিছু ক্ষণজন্মা মানুষের আবির্ভাব ঘটে। দেশ, জাতি ও ঐ অঞ্চলের শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও আর্থ-সামাজিক জীবন আবর্তিত হয়, বিকশিত হয় ঐ সব ক্ষণজন্মা মানুষগুলোর জীবন, কর্ম ও তাদের জীবনাদর্শকে কেন্দ্র করে। এরাই   হলেন   ইতিহাসের   মহানায়ক।   

বঙ্গবন্ধু   ইতিহাসের মহানায়ক।বাংলাদেশ ও বাঙালির হৃদয়ে চির জাগরুক বঙ্গবন্ধু। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর জীবন ও জীবনাদর্শ সর্বোপরি শিক্ষকদের মর্যাদা ও সম্মানের প্রতি বঙ্গবন্ধুর যে অকৃত্রিম   শ্রদ্ধাবোধ   তা   এতটুকু   অনুসরণ   করছেন আজকের রাজনীতিবিদ ও ছাত্রনেতৃত্ব? এমনকি যে শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষায় বঙ্গবন্ধু ছিলেন নিবেদিত প্রাণ, সেই শিক্ষকদের কতজন বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে লালন করেন? জাতির পিতার  কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখনো তাঁর শিক্ষকের গায়ের চাদরটি শ্রদ্ধায় শিক্ষক অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান এর গায়ে জড়িয়ে দেন, বয়োবৃদ্ধ শিক্ষকের হাতটি ধরে এগিয়ে চলেন মঞ্চের দিকে, প্রধানমন্ত্রীর জন্য বিছানো লালগালিচায় নিজ শিক্ষককে হেঁটে যেতে দিয়ে নিজে হেঁটে চলেন লাল গালিচার বাইরে দিয়ে। তারপরও আজ শিক্ষকের মর্যাদা সমাজে ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কতটা প্রতিষ্ঠিত?

এখনো   ছাত্ররা   তাদের   অন্যায়   দাবি   না   মানায়   অধ্যক্ষের গায়ে   বিষ্ঠা নিক্ষেপ   করে,   অধ্যক্ষকে   কলেজের   পুকুরে   ছুড়ে   ফেলে   দেয়,   শিক্ষককে ছুরিকাঘাত   করে   হত্যা   করে,   শিক্ষকের  গায়ে  হাত  তোলে। আমরা   যদি বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারন করি, তাঁর জীবন ও জীবনাদর্শকে অনুসরণ করি তাহলে   শিক্ষকের   মর্যাদার   প্রশ্নটিকে   অবশ্যই   বিশেষ   গুরুত্ব   দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার নিকট থেকে শিক্ষককে মর্যাদা কীভাবে দিতে হয় সে বিষয়ে বর্তমানকালের ছাত্রনেতা ও রাজনীতিবিদদের শেখার অনেক কিছু রয়েছে।

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি