Loading..

উদ্ভাবনের গল্প

০২ মার্চ, ২০২২ ১১:৩১ অপরাহ্ণ

আমার স্বপ্ন নয়, শখ ছিল


মোহাম্মাদ আবু সাইদঃ জীবনে আমার কিছু শখ ছিল। খুব বড় কিছু কিংবা আহামরি কিছু নয়। আমার তো তাই মনে হয়। লম্বা এক জীবনে এইটুকু শখ থাকা কোন অপরাধ নয়। শখ, আশা, স্বপ্ন--এইগুলোর মধ্যে পার্থক্য আছে। 'শখ' ব্যাপারটা সাবলীল, গ্রহনযোগ্য এবং নিরপরাধ। সুন্দর শখগুলো মনে ধারন এবং লালন করাটাও একটা আর্ট। এর একটা নিজস্বতা আছে। 'আশা' করাটাও কোন অপরাধ নয়। তবে এর কিছুটা ব্যপ্তি এবং ব্যাপকতা আছে। আশা ব্যক্তি বিশেষের সংগে সম্পর্কযুক্ত। কে কতটুকু আশা করতে পারে! সম্ভব-অসম্ভবের ব্যাপার আছে। আর তাই হয়তো বলা হয়ে থাকে 'first deserve, then desire'। তার মানে যোগ্য না হয়ে আশা করো না। আশা ব্যাপারটা নিরপরাধ নয়। এটা ধারন করার আগে একটা যোগ্যতার ব্যাপার আছে। তবে আশা মনের মধ্যে লুকিয়ে রেখে অপেক্ষা করা যায়। এর মধ্যে একটা সংগ্রামের গন্ধ পাওয়া যায়। আশা বাস্তবায়ন আর্থাৎ অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌছানোর জন্য এক ধরনের দৃঢ়তার প্রয়োজন পড়ে। আশার মধ্যে একেবারেই নিরপরাধবোধ নেই তা নয়। কিছু আশা আছে যা নিজস্ব নয়, অনেকটা গৌন ব্যাপার। যেমন, কিছু একটা ঘটলে ভাল হয়, যা অনেকের জন্য-সামগ্রিক। অন্যেরা কাজ করছে কিন্তু আমি আশা করছি। কিন্তু শখ ব্যাপারটা সে রকম নয়। শখ সম্পূর্ণ নিজস্ব। এমনকি শখ পুরন করা যায় সীমিতের মাঝে, ক্ষুদ্র মাত্রায়, হ্রস্বতায়।




'স্বপ্ন' ব্যাপারটা ব্যাপক, বিরাট--সীমাহীনও বলা যেতে পারে। ইচ্ছে মত স্বপ্ন ধারন করতে পারি এবং ইচ্ছে মত স্বপ্নে বিচরন করতে পারি। ভবিষ্যতের জন্য কিছু বড় স্বপ্ন থাকতে পারে এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হোক বা না হোক, আধা ঘন্টা চোখ বন্ধ করে সেই লালিত স্বপ্নের মাঝে বিচরন করে সুখানুভুতি পাওয়া কঠিন কিছু নয়। স্বপ্ন আসলে অবাধ্য। স্বপ্ন অপরাধ এবং নিরপরাধ, দু'টোই। স্বপ্ন দেখেই যেমন একটা জাতীর উদ্ভাস ঘটে, পৃথক রাষ্ট্র লাভ করে। তেমনি স্বপ্ন দেখেই বিশ্বজয়ের আশায় লক্ষ প্রানের সংহার ঘটে, দিগ্বিদিক ধ্বংসযজ্ঞ সাধিত হয়। নিরপরাধ, নির্দোষ এবং সীমাবদ্ধ স্বপ্নের বাস্তবায়ন যেমন মানুষের জীবনকে পরিশীলিত করে, সুন্দরতম করে, তৃপ্ত করে--তেমনি স্বপ্নের সীমাহীন, অবাধ্য এবং ব্যাপক লালন মানুষকে অসৎ, দুরাচারী, অহংকারী এবং অতৃপ্ত করে। না পাওয়ার স্বপ্ন অধিক সময়ই নিদারুন হয়ে থাকে। স্বপ্নের ব্যাপারে মাত্রাজ্ঞান খুব জরুরী। আয়েশি জীবনের স্বপ্ন এক জিনিস, মেধা সহযোগে বিশেষ কোন লক্ষ্যে পৌছানোর স্বপ্ন অন্য জিনিস। একটায় আছে যে কোনভাবে, যে কোন প্রকারে, অতৃপ্তি যেখানে নিশান উড়িয়ে থাকে--সোজা কথায় বড়লোক হওয়া, অন্যকে আরো নীচে ফেলে। আরেকটায় আছে ধীরে-সুস্হে, ধাপে ধাপে--প্রজ্ঞা আর সহনশীলতায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া।


আমার মেধার খবর রাখি বলেই জীবনে সেই অর্থে আমি তেমন কোন স্বপ্ন দেখিনি। বনেদি জায়গায় একটা বড় সুশ্রী বাড়ি, দামী গাড়ি, অগাধ ব্যাংক ব্যালেন্স, আয়েশি জীবন--এই রকম বড় স্বপ্ন ছিল না কখনো। হ্যাঁ, জীবনের নিরাপত্তা চেয়েছি, ভদ্রোচিতভাবে যেন বাঁচতে পারি সে রকম মাথা গুজার ঠাঁই চেয়েছি। ব্যাংকে যেন এই রকম সঞ্চয় থাকে যা দিয়ে শেষ বয়সে কিছু করে খেতে পারি। এইগুলো কি স্বপ্ন? ঐ একটা কারনেই আমি বড় বড় স্বপ্ন দেখতে ভয় পেয়েছি--যে কোন ভাবে, যে কোন প্রকারে স্বপ্ন পূরণ হতে হবে! স্বপ্ন মাঝে মাঝে লোভের কাছাকাছি চলে যায়। আমি বাংলাদেশের মানুষ বলে আমাকে এই দেশের আঙ্গিকে চিন্তা করতে হয়। এখানে মেধার চেয়ে অবৈধ পন্থায় বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন পুরন সহজ উপায়। ঘুষ-দুর্নীতির আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে একটা আয়েশি এবং দাম্ভিক জীবনের ঠিকানা খুঁজে পাওয়া কঠিন কিছু নয় এই সমাজে।


আমার লালন করা কিছু নির্মোহ শখ পূরণ করে নির্ঝণ্ঝাট একটা চারু জীবন কাটিয়ে দিতে চেয়েছি।অবশ্য আমার এই শখগুলোর কথা মুখ ভরে বলতে দ্বিধা হয় বৈকি। প্রশ্ন উঠতে পারে...'তুমিতো জীবনে তেমন কিছু করতে পারনি, গুছগাছ করে চলতে পারনি, জীবনের অধিক সময়েই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেছ, তো তুমি এইসব আশা করো কি করে!'


তবু শখ ছিল, শখ থেকে যায়। আশা-স্বপ্ন-শখ এই তিনটি মানুষের মাঝে থাকতেই হয়, বেঁচে থাকতে হলে। এদের লালন করেই একেকটি জীবন বয়ে চলে।



শখ ১. আমার শখ ছিল, ছোট হোক, বড় হোক, একটা পড়ার ঘরের। যাকে বলে study room. এই শখটা আমার অনেক দিনের। এই শখটা আমার ভিতরে জন্ম নেয় ছাত্রাবস্থায় যখন থেকে শহরের সাধারন পাঠাগার বা পারলিক লাইব্রেরী থেকে বই নিয়ে পড়ার অভ্যাস করি। অষ্টম শ্রেনীতে বৃত্তি পেয়ে আমি প্রথম কাজটি করেছিলাম পাঠাগারের সদস্য হওয়া। সদস্য হওয়ার আগে পর্যন্ত প্রায়ই বিকেলে যেয়ে বসে বসে বই পড়তাম আর লাইব্রেরীর সারি সারি বইগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম। তখন থেকেই একটা শখ মনের ভিতর তৈরী হয়। আমার বাড়ীতেও থাকবে ছোট্ট একটা পড়ার ঘর, যেখানে আশে-পাশে সেল্‌ফে সাজানো থাকবে বিভিন্ন রকম বই। এক কোনে থাকবে একটা চেয়ার আর টেবিল। সময় পেলেই ওখানটায় বসে রাজ্যের সব বই পড়বো। বই পড়া আর কেনা আমার কাছে নেশার মত। আমার এই শখটা আজও পূরণ হয় নি। আমার বাড়ী হয়েছে বটে, কিন্তু পড়ার ঘর হয় নি। কেন হয়নি, জানি না। হয়তো বাড়ীটা অপরিসর। আজকাল তো আর ইচ্ছে মতো বাড়ি বানানো যায় না, ডেভেলপাররা যা দেবে, তাই নিতে হবে। অবশ্য বলে-কয়ে কিছু বাড়তি খরচ করে পরিবর্তন আনা যায়, কিন্তু নির্মানাধীন সময় দেশের বাইরে থাকার কারনে তাও করতে পারিনি। তার পরও হয়তো করতে পারতাম, নিজের বাড়ী যখন, কিন্তু হয়ে ওঠেনি। শখটাকে বশিভূত করে রেখেছি।আমার বইগুলো পড়ে আছে উদ্বাস্তুর মত এখানে সেখানে। কিছু দেয়ালের কংক্রিটের তাকে, কিছু ছেলের পড়ার টেবিলের এক কোনে, কিছু ড্রয়িং রুমের শেল্‌ফে। বেডরুমের ছোট্ট কোন্‌টাতেও কিছু বই মুখ বেজার করে দাঁড়িয়ে আছে।




শখ ২. আরেকটা শক ছিল--একটা বাড়ী, যার সামনে থাকবে ছোট্ট একটা বাগান, যেখানে থাকবে কিছু ফুলের গাছ, লতা-পাতায় ঘেরা। দু'একটা বড় গাছ, যেন ছায়া দিয়ে রাখতে পারে। ছোট্ট পরিসরে একটা-দু'টো চেয়ার আর টেবিল, যেন বসে এক কাপ চা খেতে খেতে খবরের কাগজ, নয়তো বই পড়তে পারি। বাতাস বইলে যেন একটু আওয়াজ পাওয়া যায়। দু'একটা পাখি যেন এসে বসে সকাল বিকাল। একটু প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা। যেন বুঝতে পারি, পৃথিবিটা বেঁচে আছে।পরিসরে একটু বড় হলে আরও ভাল হয়, হাঁটাহাঁটিও করা যাবে। কিন্তু এই 'একটু বড়' চাওয়া তো আবার স্বপ্নের মধ্যে পড়ে যায়। ঐশ্বর্য্যের কাছাকাছি। তাই 'ছোট্ট'কেই প্রশ্রয় দিয়েছি। এই শখটাও পূরণ হয়নি। না হওয়ারই কথা। এটাতো একটা দূর্লভ ব্যাপার প্রায়! আমাদের দেশে যেখানে জমিই নেই, কোন রকমে মাথা গোজার ঠাঁই হলেই হয়, সেখানে বাগানসমেত বাড়ী! আর কিছুদিন পর এই ধরনের কথা বললে নির্ঘাত পাব্‌লিকের মার খেয়ে ইহধাম ত্যাগ করতে হবে। তবে পিতৃভিটায় যদি এক চিল্‌তে জমি পাও্য়া যায়, তা'হলে হয়তো কিছু টাকাকড়ি থাকলে সে শখ পূরণ করা যেতে পারে। ঘর না হয় ছোট হলো, কিন্তু বাগানটা তো করা গেল! শখটা এখনো লালন করা যেতে পারে, অপেক্ষায় থেকে!




শখ ৩. লেখালেখি করার শখ ছিল। এটা অবশ্য শখ থাকলেই করা যায় না। গুন এবং মেধা থাকতে হয়। অভ্যাস, অধ্যাবসায়, ইত্যাদি জরুরি বিষয়। বই পড়ে পড়ে একটু লেখার ইচ্ছে জাগে বলেই একটা শখ জন্ম নিয়েছিল। বড় কিছু না হতে পারলেও যেন নিজের কথা আর ভাবনাগুলো লিখে প্রকাশ করতে পারি। আর তাই যা মন চাইতো তাই লিখতে শুরু করি স্কুল জীবন থেকেই। কবিতা-গদ্য, ডায়েরী, নিজের ভাবনাগুলো। প্রথম প্রথম একটা কবিতা লিখেই মনে হতো নজরুলের কাছাকাছি চলে গেছি। এখন মনে হয় না লিখলেই ভাল হতো, লেখার কথাগুলো মনে পড়লে লজ্জা লাগে। ভাগ্যিস কেউ দেখেনি! তারপরও লিখে গেছি, কিছু কিছু লেখা লিখে নিজের কাছে ভালই লেগেছে, মনে হয়েছে চেষ্টা করলে পারবো। কিন্তু সেই শখটাও আমি পূর্ণ করতে পারিনি। পারিনি হয়তো আমার পেশাগত জীবনের কারনে, নয়তো পারিপার্শ্বিকতার কারনে। একটা বান্ধব পরিবেশ আমার প্রয়োজন ছিল, পাইনি। এই শখটার সঙ্গে ঐ পড়ার ঘরের একটা সম্পৃক্ততা আছে। একটা চেয়ার টেবিল থাকলে তাতে বসে শুধু কি আর পড়তাম, লিখতামও।




আমার শখগুলো হয়তো নির্বিরোধ নয়, কিন্তু নির্দোষ কি নয়? লালিত শখ পূরণ না হলে একটা কষ্ট থাকে। অবশ্য আমাদের নিরন্তর যুদ্ধরত জীবনের ঘাত প্রতিঘাতে ব্যর্থতার যে কষ্টগুলো বয়ে বেড়াতে হয়, তার কাছে এই শখ-পূরণের অপূর্ণতা গৌন ব্যাপারই বটে। তা'হলে আমার এই কষ্টগুলো একধরনের আভিজাত্য নয়তো? হয়তো তাই। আভিজাত্য অর্জন করাও তো কম কথা নয়!