Loading..

মুজিব শতবর্ষ

২৫ জুন, ২০২২ ০৩:২৭ অপরাহ্ণ

পদ্মাসেতু-মুজিব বর্ষের শ্রেষ্ঠ উপহার

আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ পদ্মা সেতু নির্মাণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে। ২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল। সরকার নিজস্ব অর্থায়নে ১৯৯৮-৯৯ সালে পদ্মা সেতুর প্রিফিজিবিলিটি সম্পন্ন করে। ২০০৮-এর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে পদ্মা সেতু নির্মাণের অঙ্গীকার করা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরই ফেব্রুয়ারি মাসে পদ্মা সেতুর জন্য ডিজাইন কনসালট্যান্ট নিয়োগ করে। কনসালট্যান্ট সেপ্টেম্বর ২০১০-এ প্রাথমিক ডিজাইন সম্পন্ন করে এবং সেতু বিভাগ প্রিকোয়ালিফিকেশন দরপত্র আহবান করে।পদ্মার ওপর সেতু নির্মাণ ছিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য আরও বড় চ্যালেঞ্জ। এই সেতু নির্মাণ ছিল বাংলার মানুষের প্রায় শতাব্দীকালের স্বপ্ন। কিন্তু তার জন্য দরকার ছিল বিশাল অর্থ, কারিগর ও প্রযুক্তিজ্ঞান। বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু নির্মাণ সমাপ্ত হওয়ার পর বাংলাদেশ সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য বিশ্বব্যাংকের সাহায্যপ্রার্থী হয়। বিশ্বব্যাংকও আর্থিক, কারিগরি সাহায্য দিতে রাজি হয়। ২০১১ সালে সরকার বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণ চুক্তিবদ্ধ হয়। ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে এমন অভিযোগ তুলে ১২০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি বাতিল করে। এ সময় শুরু হয় ষড়যন্ত্রের খেলা। এ ষড়যন্ত্রে কারা ছিল তা কারও অজানা নয়।

শুধু তাই নয়, বিশ্বব্যাংকের পাশাপাশি জাইকা, এডিবিসহ দাতাসংস্থাগুলোও সরে দাঁড়ায়। সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হয়। সংশ্লিষ্ট সচিবসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়। অথচ মন্ত্রীসহ কারোর বিরুদ্ধেই কোনও অভিযোগই প্রমাণিত হয়নি। পরে কানাডার এক আদালতে মামলা করা হয়। বিশ্বব্যাংক সেখানেও কোনও প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। কিন্তু তদসময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের ইমেজকে কলঙ্কিত করা হয়। বিএনপিসহ দেশের সুশীল সমাজ সরকারের সমালোচনায় মেতে ওঠে। ২০১২ সালে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতির জন্য বিশ্বব্যাংক সরে দাঁড়ায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু বিশ্বব্যাংকের চাপ নয়, আমেরিকার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের টেলিফোনে দেওয়া প্রচ্ছন্ন হুমকিও অগ্রাহ্য করার সাহস দেখিয়েছেন এবং দেশের সম্মান রেখেছেন। নোবেলজয়ী ড. ইউনূস ক্লিনটন পরিবারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাকে নানা অভিযোগের দরুন গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালকের পদ থেকে সরানো হলে ক্লিনটন দম্পতি অখুশি হন এবং ড. ইউনূসের পক্ষ নিয়ে হাসিনা সরকারকে বিব্রত করেন। পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থসাহায্য বন্ধ হওয়ার পেছনে হিলারি ক্লিনটনের প্রভাব অনেকটা কাজ করেছে বলে অনেকেই মনে করেন। বিএনপির নেতারাসহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ সরকারের সমালোচনা করে। মনে হয় সরকারকে অপরাধী প্রমাণ করতে পারলেই তাদের লাভ। কারণ আওয়ামীলীগ যত ভালো কিছু করুক না কেন, খুব সম্ভব কোনো ধরনের প্রশংসনীয় কমেন্ট বা বক্তব্য বিএনপি’র থেকে আসেনি। শুধু এই পদ্মা সেতু কেন, কোনো কালেই আসেনি। দৃশ্যমান যে, বিরোধী দল মানেই যেন বিরোধীতা করার নীতি। আসল কথা হলো, ২০০১ সালে বিএনপি জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ৫ বছরে পদ্মা সেতুর কাজ এক ইঞ্চিও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি। আর, আজ সারাবিশ্ব যখন প্রধানমন্ত্রীর সাহসের প্রশংসায় পঞ্চমুখ তখনও তাদের নোংরা নীতি থেকে সরে আসতে পারেনি- যাহা খুবই দুঃখজনক ।।

বস্তুত পদ্মা সেতু আমার কাছে একটি হৃদয় দোলানো কবিতার মতো মনে হয়। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদী নিয়ে কবিতা রয়েছে অসংখ্য; খোদ পদ্মা নদী নিয়েও কবিতা ও সংগীত কম নেই। সে তুলনায় সেতু নিয়ে কবিতা বিরল। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে শত প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষম হয়েছেন, তা এককথায় মহাকাব্যিক। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম পদ্মার ঢেউকে তার শূন্য হৃদয়-পদ্ম নিয়ে যেতে বলেছিলেন। শেখ হাসিনা দেখিয়েছেন, পদ্মা নদী বাঙালির শূন্য হৃদয়ের বাহন নয়; বরং বুকভরা গর্ব ও চোখভরা স্বপ্নের সাক্ষী।
জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর বছরের শেষ মাসে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হওয়া বাংলাদেশের জন্য এক দুর্লভ ও ঐতিহাসিক ঘটনা। করোনার যে ভয়াল গ্রাসের অন্ধকারে আমরা কাজ করছি, সেই তিমির রাত্রির শেষে আমরা এই ঘটনায় এক উদয় উষার সুসংবাদ শুনতে পেলাম মনে হয়। এই সেতু শুধু উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণ ও দক্ষিণ- পূর্ববঙ্গের সঙ্গেই প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ঘটাবে না, দেশে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেরও প্রসার বাড়াবে অভাবনীয়ভাবে। কয়েকশ ইঞ্জিনিয়ার, টেকনিশিয়ান, আর্কিটেক ও ওয়ার্কারের পাঁচ বছরব্যাপী অবিরাম শ্রমের ফল এই সেতু ।এ জন্য তাদের কাছেও জাতি চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার তিন মেয়াদের শাসনকালে একটি ইতিহাস তৈরি করে গেলেন। একটি ‘এরা’ বা যুগ সৃষ্টি করে গেলেন, তাকে ভবিষ্যতের ইতিহাস নাম দেবে’ শেখ হাসিনা এরা’ বা হাসিনা যুগ। তার সরকারের যত ভুলভ্রান্তি থাকুক, দুটি কারণে ইতিহাসে চিরকালের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেঁচে থাকবেন এবং মানুষ তাকে স্মরণ করবেন। অতীতের মোগল যুগের শাসক শায়েস্তা খানের মতো তিনি হবেন ইতিহাসের কিংবদন্তি। এই দুটি কারণের একটি হলো, ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দন্ডদান এবং অন্যটি হলো, উত্তাল পদ্মা নদীর বুকে সেতু নির্মাণ। এই দু’কাজেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে এবং দেশের বাইরে যে চ্যলেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে, অনেকেই ভাবতেন তিনি তা পারবেন না।
’৭১-এর ঘাতক দালাল এবং গণহত্যার সহযোগীরা যেভাবে ৪০ বছর বিচার ও দন্ড এড়িয়ে চলেছে এবং বিএনপির সহযোগিতায় ক্ষমতাতেও গিয়ে বসেছিল, তাতে কেউ মনে করেননি, তাদের বিচার ও দন্ড হওয়া সম্ভব। শেখ হাসিনা দেশ-বিদেশের সব বিরোধিতা অতিক্রম করে এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। ’৭১-এর ঘাতক, বঙ্গবন্ধুর ঘাতক এরা সবাই তাদের অপরাধ ও জাতিদ্রোহিতার শাস্তি পেয়েছে।

পদ্মা সেতু নির্মিত হবে এই আশায় পদ্মার এপারের-ওপারের মানুষ যখন আনন্দে উদ্বেল, সেই মুহূর্তে রাজনৈতিক চক্রান্তে তাদের আশার মূলে কুঠারাঘাত হানা হলো। বিশ্বব্যাংক হঠাৎ অভিযোগ তুলল, বাংলাদেশের পদ্মা সেতু প্রজেক্টে দুর্নীতি হচ্ছে। এই ব্যাপারে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রীকেও জড়ানো হলো। বিস্ময়ের কথা, তখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের কোনো অর্থ বাংলাদেশের যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের হাতে এসে পৌঁছেনি। তার আগেই বিশাল দুর্নীতির অভিযোগ। এই অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। এই অভিযোগ তোলার পেছনে রাজনৈতিক চাপ ছিল। শেখ হাসিনা দৃঢ়তার সঙ্গে এই চাপ মানতে অস্বীকার করেন এবং ঘোষণা করেন, বাংলাদেশ তার নিজস্ব সম্পদের দ্বারা পদ্মা সেতু নির্মাণ করবে। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা সত্তে¡ও অনেকের মনে সন্দেহ ছিল। বাংলাদেশের পক্ষে নিজস্ব সম্পদ দ্বারা এই সেতু নির্মাণ অসম্ভব। প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের কাছে নতজানু হওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে যে পরামর্শ দিয়েছিলেন, তিনি তা অগ্রাহ্য করেন এবং নিজস্ব সম্পদে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য পাঁচ বছর আগে কাজ শুরু করেন। তারপর অবশ্য চীন, ভারতসহ আরও কিছু বিদেশি সাহায্য এসেছে। কারিগরি সাহায্যও এসেছে। গত বৃহস্পতিবার (১০ ডিসেম্বর) সর্বশেষ অর্থাৎ ৪১তম স্প্যান বসিয়ে অবকাঠামো সেতুর নির্মাণকাজ অত্যন্ত সফলতার সাথে শেষ করা হয়েছে। আজ সেই স্বপ্নের পদ্মা সেতুর শুভ উদ্বোধন হল। উদ্বোধন করেন- দেশরত্ন, জাতির জনকের কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশের উন্নয়নের ইতিহাসে আরেকটি বিরাট মাইলফলক। এই প্রথম বিশ্বব্যাংকের ঔদ্ধত্য ও সাহায্য অগ্রাহ্য করে একটি ছোট উন্নয়নশীল দেশ এত বিশাল প্রজেক্টের কাজ শেষ করল। এই সেতু বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগান্তকারী উন্নয়ন ঘটাবে। সব কিছু মোকাবিলা করে মাওয়া আর জাজিরাকে সংযুক্ত করলে ৪২টি পিলারের উপর দাঁড়িয়ে থাকা ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের পদ্মা সেতু। এতদিন স্বপ্নের সেতু বলা হলেও আজ সেটা বাস্তব সত্য। এই সংযোগ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের ভাগ্য বদলে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের সঙ্গে ওই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হবে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর এ অঞ্চলে আসবে বিনিয়োগ ও হবে কর্মসংস্থানের সুযোগ, অর্থনীতিতে আসবে গতি। আর সাথে সুকান্ত ভাট্টাচার্যের ‘দুর্মর’ কবিতার এই লাইনটাই হোক আমাদের আজকের দিনটার শ্লোগান…
সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী,
অবাক তাকিয়ে রয়:
জ্বলে-পুড়ে-মরে ছারখার
তবু মাথা নোয়াবার নয়!
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে, এত সমস্যা মেকাবিলা করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের স্বপ্ন দেখা এবং সেটার বাস্তবায়নের জন্য একটা স্যালুট মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রাপ্য।।

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি