Loading..

ম্যাগাজিন

৩১ জুলাই, ২০২২ ১২:৫৪ পূর্বাহ্ণ

সাইকেল নিয়ে বিশ্ব ভ্রমণ, শত বছর আগে বাঙালিই প্রথম শুরু করেছিল?
সাইকেল নিয়ে বিশ্ব ভ্রমণ, শত বছর আগে বাঙালিই প্রথম শুরু করেছিল???

বর্তমানে মানুষের মধ্যে বিশ্ব ভ্রমণের ঝোঁক অনেক বেশি। কেউ করছেন নেশায়, কেউবা পেশায়। তবে বয়স এখানে একেবারেই বাঁধা নয়। তরুণ থেকে বয়োবৃদ্ধ মনের জোড় আর ইচ্ছাতেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন দেশ বিদেশ। অনেকে সাইকেল, নিজের গাড়ি নিয়েই বেড়িয়ে পড়ছেন বিশ্বভ্রমণে। একবিংশ শতাব্দীতে আধুনিক এবং সহজলভ্য যোগাযোগ ব্যবস্থায় এটি একেবারেই কঠিন কিছু নয়।

তবে আজ থেকে শত বছর আগের কথা ভাবুন তো কেমন ছিলো সেই সাইকেল নিয়ে বিশ্ব ভ্রমন! বলছি  হবিগঞ্জের সেই ছেলেটির কথা যার নাম রামনাথ বিশ্বাস। 
রামনাথ ১৮৯৪ সালের ১৩ জানুয়ারি অসমের সিলেট জেলার বানিয়াচং গ্রামের বিদ্যাভূষণপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। যেটি বর্তমানে বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত।  

সময়টা ১৯৩১ সাল। যেই ভাবা, সেই কাজ। বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে সিঙ্গাপুর থেকে প্যাডেল চালাতে শুরু করলেন রামনাথ। সবার চোখ বড় বড় করে নানা রকম কথা তোয়াক্কা করে ছুটে চললেন গন্তব্যে। গন্তব্য বিশ্বের শেষ প্রান্ত! অনেকেই বলতে লাগলেন, সাইকেলে করে কী করে বিশ্বজয় করা যায়? তবে একথা রামনাথের মনে কিন্তু একফোঁটাও সংশয় তৈরি করতে পারে নি। পুরো সময়ে রামনাথের সম্বল ছিল দুটী চাদর, চটি, আর সাইকেল মেরামতের বাক্স।

দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশই তিনি ঘুরলেন। তবে এখানেই থেমে রইল না যাত্রা। ১৯৩৪ এবং ১৯৩৬ সালে আরও দুবার সাইকেল বের হয় রাস্তায়। আফগানিস্তান, সিরিয়া, লেবানন হয়ে প্রায় গোটা ইউরোপ, এবং শেষমেশ আফ্রিকা আর আমেরিকা। রামনাথের কাছে হার মেনেছিল সমস্ত বাধা-বিপর্যয়। রামনাথ ছিলেন প্রচণ্ড অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষ। এক উদাহরণেই তা বুঝতে পারবেন আপনিও! 

তখন তিনি আফ্রিকা ভ্রমণে ব্যস্ত। সেখানে তার সঙ্গী হয়েছেন দুজন স্থানীয় মানুষ। রামনাথ ততদিনে খেয়াল করেছেন আফ্রিকায় কালো মানুষদের দুর্দশা। সে সময়টাতে আফ্রিকায়, বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের রমরমা। শ্বেতাঙ্গ সাহেবরা ভারতীয়দের যেমন অশ্রদ্ধা করতেন, ভারতীয়রাও তেমনি স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের দেখলে নাক কুঁচকে থাকত। তারপরও এই তথাকথিত পিছনে পড়ে থাকা মানুষরাই রামনাথের সঙ্গী হয়েছিল। 

আফ্রিকার জঙ্গলে ঢুকে, সেখানকার সৌন্দর্য দেখে মোহিত হয়ে যান তিনি। হঠাৎই খেয়াল হল, পকেটে কড়কড় করছে বেশ কিছু পাউন্ড। প্রকৃতির বিশুদ্ধ বাতাসে বিমোহিত হয়ে কিছুটা ভাবুক হয়ে যান রামনাথ। সন্ন্যাস জীবনের ব্রত বোধহয় মনে মনে নিয়েই নিয়েছিলেন। যে কারণে পকেট থেকে টাকা পয়সা বের করে সঙ্গী দুই আফ্রিকানদের বিলিয়ে দিলেন রামনাথ বিশ্বাস। এমন কাণ্ড দেখে বাঙালিবাবুটিকে ‘পাগল’ই ভেবেছিলেন কালো যুবকরা।  

হ্যাঁ, পাগলই ছিলেন রামনাথ বিশ্বাস। তাই নিজের শর্তে বেঁচেছেন প্রতিটা মুহূর্তে। নিজের যুক্তিতে, বুদ্ধিতে, আদর্শের চোখে দেখেছেন গোটা পৃথিবী। ম্যাপ বইয়ের পৃথিবী নয়; একেবারে বাস্তব জগত-সংসার। বহুবার বিপদে পড়েছেন, শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন, পা ভেঙেছেন; কিন্তু মনোবল হারাননি এতটুকুও। আফ্রিকার মানুষদের কথা তুলে ধরেছিলেন নিজের বইতে। ‘দেশ’ পত্রিকাতেও ভ্রমণকাহিনী লিখতেন রামনাথ। সেই লেখা পৌঁছে গিয়েছিল স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছেও। আজকের পুঁজিসর্বস পৃথিবীতে বোধহয় এমন বাউণ্ডুলে মানুষদেরই প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি। 

শেষ জীবনে বাংলায় থিতু হয়েছিলেন তিনি। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হলে অসমের সিলেট জেলা পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। রামনাথ বানিয়াচঙ্গেই থেকে যান।  নিজের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা লিখেই কাটিয়ে দেন সময়। তবে তার ভ্রমণকাহিনী নিয়ে বই প্রকাশ করতে চাইলে কোনো  প্রকাশক এগিয়ে আসেনি। অগত্যা তিনি নিজেই পর্যটক প্রকাশনা ভবন নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা খুলে নিজের বই প্রকাশ করতে শুরু করেন। এরপর তিনি পূর্ব পাকিস্তানের পাট চুকিয়ে দিয়ে পাকাপাকিভাবে কলকাতায় চলে যান। বসবাসকালে রামনাথের ভ্রমণকাহিনী আনন্দবাজার পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হত। পরে তা গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হয়। তার রচিত গ্রন্থের সংখ্যা তিরিশের উপর। ১ নভেম্বর ১৯৫৫ সালে তিনি মারা যান।

লেখা:- প্রথম আলো হতে সংগৃহীত।।

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি