Loading..

প্রকাশনা

২২ ফেব্রুয়ারি , ২০১৪ ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আজ কপাল পুড়ল
লোহার কুঠারটা যে ফেরত পাবে ভাবতেই পারেনি কাঠুরিয়া। জলদেবতার অশেষ কৃপা। কাঠুরিয়া এক বার সোনার এক বার রুপোর কুঠারটার গায়ে হাত বুলোয়। তা হলে কি বড়লোক হয়ে গেল ও! কিন্তু তা কেমন করে হবে? এগুলো কোথায় বিক্রি করবে? যেখানে নিয়ে যাবে সেখানেই তো চোর সাব্যস্ত হতে হবে। আর বিক্রি করাটা কি আদৌ ঠিক হবে! সততার পুরস্কার হিসাবে পেয়েছে এগুলো। এখন লোভ এসে গেলে, দেবতা কুপিত হয়ে কেড়ে নেন যদি! ভাবতে ভাবতে বেলা গড়িয়ে গেল। আর কাঠ কাটা হল না। তিনখানা কুঠার বস্তার মধ্যে ভরে বাড়ি ফিরল কাঠুরিয়া। বউ প্রথমে প্রায়-খালি বস্তা দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিল। পরে সোনার আর রুপোর কুঠার দেখে আনন্দে মূর্ছা যাবার উপক্রম। তার পর কাঠুরিয়ার ধন্দ শুনে সে সব ধাঁধা সরল করে দেয়। বিক্রি করার যুক্তি হিসেবে বলে, ‘জলদেবতা তোমাকে কুঠার দু’টো কেন দিলেন, পুরস্কার হিসাবে তো? যদি এ দু’টো দিয়ে আমাদের দুঃখই না ঘোচে তো কীসের পুরস্কার!’ কিন্তু মুশকিল হল, বেচবে কার কাছে? সে যদি চোরাই মাল ভেবে পেয়াদাকে খবর করে? পর দিন সকালে উঠে কাঠুরিয়া দেখে বউ ঘরে নেই। একটু পরে কালিঝুলি মাখা অবস্থায় বউ ঘরে ফেরে। বলে, ‘এ বারে সোনার কুঠারটা নিয়ে যাও নগেন স্যাকরার কাছে। অসুবিধা হবে না।’ ‘কী রকম?’ ‘একটা শাঁকচুন্নি নগেনকে ঘরের বাইরে থেকে নাকি গলায় বলে এসেছে, সোনার কুঠার নিয়ে ওর কাছে কাঠুরে আসবে, ও যেন সে কথা কিছুতে না রটায়!’ এ দিকে নগেন স্যাকরা ঘাগু লোক। শাঁকচুন্নিতে তার বিশ্বাসও নেই। কুঠারটা দেখে সে কাঠুরিয়াকে সঙ্গে সঙ্গে চেপে ধরল। ভয় দেখাল পেয়াদার। কাঠুরিয়া বুঝল বউয়ের কৌশল কাজে লাগেনি। সব খুলে বলল। পরের ঘটনাটা মাস তিনেক পরের। কাঠুরিয়া তত দিনে বড়লোক। নগেন স্যাকরা কাঠুরিয়ার কথা বিশ্বাস করে ওকে ঠকাতে পারেনি, জলদেবতার ভয়ে। তবে মনে মনে মতলব ভেঁজেছে, যদি ও-ও কাঠুরিয়ার মতো... এ দিকে কাঠুরিয়ার বউ কাঠুরিয়াকে জ্বালিয়ে মারছিল যেখান থেকে ওদের এমন দুর্লভ প্রাপ্তি, সে জায়গাটা দেখবে। একই দিনে নগেন স্যাকরা ও কাঠুরিয়া পরিবার এসে হাজির হল একই জায়গায়। তবে কিছুটা আগে-পরে। কাঠুরিয়ার বেশে নগেন স্যাকরা প্রথমে। এসেই লোহার কুঠার নিয়ে চড়ে বসল গাছটায়। তার পর কাঠ কাটার ছুতোয় কুঠার জলে ফেলে জলের ধারে বসে কাঁদতে লাগল। এ বারেও জলদেবতা উঠে এলেন, জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে? তার পর প্রথমে সোনার কুঠার এনে শুধোলেন, ‘এইটা তোমার?’ নগেন পুরো গল্পটা জানে। তাই চালে ভুল করতে রাজি নয়। বলল, ‘না’। জলদেবতা এ বার জলে ডুব দিয়ে রুপোর কুঠার আনলেন। নগেন ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, ‘এটাও না’। জলদেবতা জলে অন্তর্হিত হলেন। নগেনের কাছে এক সেকেন্ডও এক ঘণ্টা মনে হতে লাগল। দেবতা উঠে এলেন, হাতে নগেনের লোহার কুঠার। নগেন ছদ্ম-কাতর হয়ে বলে উঠল, ‘এটা, এটাই আমার!’ কাঠুরিয়ার কাছে শুনে নগেনের মুখস্থ জলদেবতার এ বারের সংলাপ। কিন্তু নগেনকে আশ্চর্য করে দিয়ে তিনি বললেন, ‘তুমি যে ভাবে নিজের কুঠারটার জন্য ব্যাকুল তাতে অন্য দু’টো কুঠার দিয়ে তোমাকে আর সমস্যায় ফেলতে চাই না। তুমি তোমার কুঠারটাই নাও।’ দেবতা জলে মিলিয়ে গেলেন। নগেনের মাথায় বজ্রাঘাত। এ কী হল! জলদেবতার পিছু পিছু ও ঝাঁপ দিল জলে। যদি বুঝিয়ে-সুঝিয়ে...। এই ঘটনার পরে পরেই কাঠুরিয়া আর তার বউ এসে পৌঁছল ওখানে। ‘কোন গাছটা গো?’ আহ্লাদী গলায় বউ শুধোল। কাঠুরিয়া আঙুল দিয়ে দেখাল। ‘আমি উঠব’, বায়না ধরল বউ। এত বছর বিয়ে হয়েও ছেলেপুলে হয়নি। বউটা তাই ছেলেমানুষই রয়ে গেছে। কেবল ঝগড়ার সময়েই যা একটু অন্য রকম। কাঠুরিয়া ঠেলেঠুলে বউকে তুলে দিল গাছে। তক্ষুনি অঘটন। ডাল ভেঙে বউ পড়ে গেল জলে। কাঠুরিয়া ‘বউ’ ‘বউ’ করে েঁচচিয়ে উঠল। কিন্তু একে তো বউ সাঁতার জানে না, তার ওপর তীব্র স্রোত। কোথায় যে মুহূর্তের মধ্যে ভেসে গেল কাঠুরিয়া বুঝতেও পারল না। অগত্যা পা ছড়িয়ে সেই আগের মতো কাঁদতে বসল। কান্না শুনে আবার জলদেবতা উঠে এলেন, কাঠুরিয়ার কথা শুনে ডুব দিলেন। তার পর উঠলেন, সঙ্গে এক পরমা সুন্দরী মেয়ে। ‘এর জন্যই কি কাঁদছ তুমি? এ-ই কি তোমার বউ?’ ‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’ জলদেবতা স্তম্ভিত। এই লোকটার সততায় আগে মুগ্ধ হয়েছিলেন, এরই মধ্যে এত পরিবর্তন! কাঠুরিয়া যেন বুঝতে পারল জলদেবতার মনোভাব। বলে উঠল, ‘সে বার সততার পুরস্কার হিসেবে তিনটে কুঠারই দিয়ে দিয়েছিলেন— এ বারেও যদি তিনটে দিয়ে দেন— আসলে একটাকে নিয়েই জেরবার— সেখানে তিনটে—’ এই যুক্তিতে জলদেবতা খুশি হয়ে চলে গেলেন। নতুন বউ পেল কাঠুরিয়া। এ দিকে ভোরের দিকে এক বাঁধের গায়ে আটকে থাকা দুই অচেতন নারী ও পুরুষের জ্ঞান ফিরে এল। দু’জনে দু’জনকে দেখেই চিনতে পারল। কাঠুরিয়ার বউ ভাবল, নগেন স্যাকরা নিশ্চয়ই জলে ডুবে মরতে এসেছিল, টাকাপয়সা যতই থাক, একা একা জীবন কাটায়, বউ মরেছে কলেরায়। নগেন ভাবল, টাকার মুখ দেখতে পেলেই কি সব পাওয়া হয়, ছেলেপুলে না হওয়ার জন্য এই বউকে ত্যাগ দিয়ে কাঠুরিয়া নিশ্চয়ই অন্য কাউকে ঘরে আনতে চায়, হয়তো সেই দুঃখেই বেচারা বউটা জলে ডুবে...। এর পর আর কী ঘটতে পারে? নগেনের তো আপত্তি কিছু ছিলই না। কাঠুরিয়ার বউয়ের দিক দিয়ে আপত্তি একটু ছিল। কিন্তু ও ভেবে দেখল, সারা রাত বাঁধের গায়ে আটকে থাকা বউয়ের একটা খোঁজ যে নিতে আসে না, তার কথা ভেবে আপত্তির কোনও মানে হয় না। নগেন বলল, ‘তোমাকে তো এত কাল কাঠুরিয়ার বউ বলে জেনে এসেছি, নাম তো জানি না, কী বলে তোমায়—’ কাঠুরিয়ার বউ বলল, ‘আমাকে তুমি শাঁকচুন্নি বলেই ডেকো।’

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি