Loading..

প্রকাশনা

০১ মার্চ, ২০১৪ ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

স্বাধীনতা ও বজলু চোর
জামাল একে একে তিনটা ম্যাচের কাঠি ফুরিয়েও চুরটটা ধরাতে পারলো না। চতুর্থ কাঠিতে সে সফল হলো। পাক সেনা অফিসার বিরক্ত হয়ে রেগে বলল- ব্যাটা একটা চুরুট ধরাতে পারিস না। দেশ স্বাধীন করবি তোরা। শালা বাঙ্গালী কাজের বেলা নাই মুখে বড় বড় বুলি। জামালের রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে জলন্ত ম্যাচের কাঠি হনুমানটার বড় বড় মুছে জ্বালিয়ে দিতে। শালাদের বিচিত্র সখ চুরুট খাবে নিজে আর ধরিয়ে দিতে হবে তার বাঙ্গালী বাপকে। নন্দকুজা নদীর উপর আহমেদপুরের ব্রিজ পাহারা দেবার জন্য আজ নবীনকৃষ্ণপুর গ্রামের প হতে জামালকে আসতে হয়েছে। ব্রিজ পাহারা দেবার জন্য প্রতিদিন আসে পাশের সকল গ্রাম থেকে এক জন করে লোক দিতে হচ্ছে পাক হানাদার বাহিনীদের সাথে। মুক্তি বাহিনী যাতে এই ব্রিজ ভেঙ্গে ফেলতে না পারে এই জন্য পাহারা। এই ব্রিজই উত্তর বঙ্গের সাথে যোগাযোগের এক মাত্র সড়ক পথ। পাক অফিসার চুরুট টানতে টানতে বলল- জামান তুই লেখা পড়া জানিস। জামাল : জানি। এবার ডিগ্রীতে নাটোর কলেজে পড়ি। আমার নাম জামাল স্যার জামান না। পাক অফিসার : আমি বলছি জামান। অতএব তোর নাম জামান। জামাল আর কোন কথা বলল না। চুপ থাকাই তার কাছে ভাল মনে হচ্ছে। পাক অফিসার : তোর কি জিওগ্রাফি বিষয় আছে। জামাল : না। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র। পাক অফিসার : না থাকলেও এ্যাসট্রোনমি সম্পর্কে জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। অনেক কাজে লাগে। আমার ছোট বেলা থেকেই এ্যাসট্রোনমি এর প্রতি ঝোক ছিল। আমার পাঠ্য না থাকলেও আমি ব্যাপক পড়াশুনা করেছি এ্যাসট্রোনমি সম্পর্কে। আমি পৃথিবী থেকে কোন গ্রহ কত দূরে, কতদিন পূর্বে সৃষ্টি, কোন গ্রহে কি কি উপাদান আছে, কত বড়, গতিবেগ কত সবই এক নিঃশ্বাসে বলতে পারি। কোন গ্রহের প্রভাবে কি হয় তাও বলতে পারি। আমি রাতের তারা দেখে যে কোন যায়গায় দিক সঠিক করে নির্নয় করতে পারি। তুই কি শুনতে চাস। জামাল কিছু বলল না। তার বিরক্ত লাগছে। শালারা যুদ্ধ করতে এসে এ্যাসট্রোনমি নিয়ে গল্প করছে। ভাবটা এমন মনে হচ্ছে উনি শশুর বাড়ি এসে শালা শালীদের সাথে খোশ গল্প করছেন। পাক অফিসার : আমি গ্রহ পর্যবেণ করে দেখলাম তোদের বাঙ্গালীদের কপালে স্বাধীনতা নেই আছে গোলামী। সাথে সাথে অন্য সাত জন পাক সেনা বলে উঠল ঠিক স্যার। জামালর মনে হচ্ছে হারামজাদার বুকের উপর এক লাথি মেরে এখনই ব্রিজের রেলিং এর উপর থেকে ফেলে দিয়ে বাঙ্গালীকে গোলম বলার সাধ মিটিয়ে দিতে। অনেক কষ্টে দাঁতে দাঁত চেপে রাগ নিয়ন্ত্রনে রাখছে। ইতোমধ্যে ক্যাম্প থেকে দুই জন সেনা এসে বলল- স্যার আপনার গোস্ত পরটা আর কফি র‌্যাডি। চল বলে সে তাদের সাথে চলে গেল। জামাল ব্রিজের উপর থেকে পানিতে জোসনার আলোর খেলা দেখতে লাগলো। চাঁন্দের আলোর টুকরো ঝরে ঝরে পড়ে নদীর পােিত মিশে এক অপূর্ব দৃশ্য তৈরী করছে। আজ মনে হয় পূর্নিমা। যুদ্ধ শুরু হয়াতে চাঁদের হিসাব ঠিক রাখতে পারছে না। চাঁদের আলো যার উপর পরে তারই সৌন্দর্য বেড়ে যায়। কিন্তু পানির সাথে চাঁদের আলোর মিশ্রনটা মনে হয় সব চেয়ে বেশি আকর্ষনীয়। :কিরে কালকা কুন সময় আইলি ব্রিজতে। বলল রশিদ। জামাল : সহাল- ৯ ডার দিগে। ইব্রাহিম : কালকা আমারে যাইতো কইছে করিম প্রধানে। জামাল : হুনলাম শামসু মুহুরিরে দইরা নিছে আজকা ১০ টার দিগে। রশিদ : ঠিকই হুনছত। তয় ছাইরা দিছে দুপুরের আগে। জামাল মওলানা আর করিম প্রধান গেছিন। পাক সেনারা মওলানাগো কতা রাহে। জামাল : শামসু মুহুরিতো খুব বালা মানুষ। তারে দরলো ক্যা? ইব্রাহিম : ইছব্যায় শত্র“তা কইরা দরাইছে হুনলাম। একটা বড় খাসি লইয়া গ্যাছে। তিন বন্ধু বিকালের দিকে নদীর দয়ের ধারে বসে গল্প করছিল। হঠাৎ কয়েকটা ছোট ছেলে দৌরাচ্ছে আর বলছে- পাক বাহিনী আইতাছে, পাক বাহিনী আইতাছে। তারা তিন জন রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখে ঠিকই আসছে। এখনো বেশ দুরে আছে। তারা রস্তা পার হয়ে একটু আরালে চলে গেল। তিন জন যুবক ছেলে এক সাথে দেখলে আর রা নাই। তাদের আক্রোশ শুধু জুয়ান পুলাপানের উপর আর লোভ চ্যাংরা মেয়েছেলেদের উপর। তাই গ্রামের মাতব্বর করিম প্রধান কইছে- কোন ক্রমেই জুয়ান ছেলে আর চ্যাংরা মেয়েছেলেদের পাক সেনাদের সামনে পরা যাবে না তাইলে রা নাই। তাদের সামনে দিয়ে করিম প্রধান ও পূর্বপাড়ার ইছব সহ ১০ জন পাক সেনা পূর্ব পাড়ার দিকে যাচ্ছে। তার কিছুন পরই তারা- চোর গেল, চোর গেল চিৎকার শুনতে পেল। তারা আলাদা হয়ে এক জন এক জন করে পূর্ব দিকে গেল। সামনে আগাতেই জামাল দেখল কিছু লোক বজলু চোরকে তারা করছে। এর মধ্যে সামনের দিক থেকেও কিছু লোক তাকে ধাওয়া করলো। নিরুপায় হয়ে বজলু নদীতে নামতে লাগলো। ইতোমধ্যে পাক সেনারও পাকরাও পাকরাও বলে চলে এলো। বজলুর পিছনে পিছনে সবাই ধাওয়া করল। বজলু জীবন বাঁচাতে পানিতে ঝাঁপ দিল। বজলু হাত জোর করে সকলের কাছে প্রাণ ভিা চাইছে। কিন্তু তাও তাকে রেহাই দেয়া হলো না। হইচই শুনে নদীর ওপারের মানুষও লাঠি সোটা নিয়ে বের হলো। নিরুপায় বজলু ভরা নদীর পানিতে হাবুডুবু খেতে লাগালো। দুুই পারের কিছু লোক চোরে বিচারের পৈচাশিক নেশায় হইচই করতে লাগলো। দুই জন পাক সেনা পর পর কয়েকটি গুলি করলো। সাথে সাথে বজলু চোরের রক্তে গেটা নদী লাল হয়ে গেল। বজলুর মা পাগলের মত গগন ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগলো- আমার বজলুরে তোমরা কেরে মারলা। হেয় তো আইজগা চুরি করে নাই। বজলুর রক্তে গোটা নদীর পানি লাল আর বজলুর মায়ের চিৎকারে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠল। পাক সেনারা যখন সবাইকে চলে যাবার জন্য তারা করল তখন জামাল চেতনা ফিরে পেল। এতন যা ঘটেছে তা যেন তার অবচেতনেই ঘটেছে। পাক সেনার চলে যাবার পর বজলু করিম প্রধানকে বলল- বজলুকে মেরে আমাদের কি লাভ হলো? করিম প্রধান : তুই কি বুঝস? খালি তো আতে পায়ে লম্বাই অইছত। পাক বাহিনী মনে করবো এই গ্রামের সবাই তাদের প।ে তার যা বলবে তাই করবে সবাই। আমাদের গ্রামের সবাই বিশৃংখলার বিপ।ে বজলু মইরা গ্রামে চুরিরও বন্দ আবার গেরামও নিরাপদ অইল। বলেই করিম প্রধান হাটা ধরল। ১৯৭১ সালের ২০শে ডিসেম্বর ফজরের পর পর জামাল তার সহযোদ্ধা তিন মুক্তি সেনা নিয়ে তার বাড়ীতে এলো। গ্রামের সবাই জামালের সাথে দেখা করতে আসছে আর বাহবা দিচ্ছে। করিম প্রধান ও ইছব রাজাকারও এসেছিল। এসে কত কথা, কত প্রশংসা। কিন্তু জামাল এরই মধ্যে খবর পেয়েছে যে, করিম প্রধান ও ইছব তাদেরকে বীর মুক্তি যোদ্ধা বলে প্রচার করছে। জামাল দুপুরে খাবার পর ঘুমিয়েছিল তা ভাঙ্গলো ছোট বোন রোকেয়ার দুষ্টুমিতে। রোকেয়া যখন জামালের কানে সুরসুরি দিল তখন সে লাফিয়ে উঠে ধমক দিয়ে বলল- তোর অত্যাচারে একটু শান্তি মত ঘুমাতেও পারলাম না। কতদিন বিছানায় ঘুমাই না। রোকেয়া : দেহ কেডা আইছে। বলেই রোকেয়া বাইরে চলে গেল। জামাল তাকিয়ে দেখে দরজায় শাহানা দাড়িয়ে আছে। জামাল বলল- দারাইয়া আছো ক্যা বস। শাহানা : বইতো পারতাম না। অনেকন ওইছে আইছি। আপনে ঘুমাইয়া আছিলেন তাই দেরি অইল। তার পর কেমুন আছেন। জামাল : আমার আর থাকা বল। তুমি কেমুন আছো। শাহানা উত্তর না দিয়ে হাত বাড়িয়ে একটা কাগজ দিল। এর মাঝেই রোকেয়া এসে বলল কি হচ্ছে? শাহানা কাগজ জামালের হাতে দিয়েই দ্রুত ঘর হতে বের হতে লাগলো। রোকেয়া বলল- শাহানা আপা যাইতাছো ক্যা। পায়েস খাইয়া যাও। কিন্তু ততনে শাহানা চলে গেছে। রোকেয়া : ও বাইছা তোমারেতো কইনাই যে শাহানা আপার বিয়া হইছে। জামাল : কি? রোকেয়া : জোর কইরা বিয়া দিছে করিম প্রধানের মেজ পুতের লগে। শাহানা আপা কত কান্দা কাটি করলো। বলেই রোকেয়া তার মায়ের ডাক শুনে বাহিরে গেল। জামাল তার হাতের কাগজ চোখের সামনে ধরে- জামাল ভাই, আমি জানি আপনে আমারে ক্ষমা করবেন না। কিন্তু আমি নিরুপায় ছিলাম। যাক ক্ষমা না করলেও কিছু করার নাই। দেশ স্বাধীন অইছে অনেকের অনেক কিছুর বিনিময়ে। আর আমার স্বাধীনতার বিনিময় হইছে আপনের লগে। আমি স্বাধীনতা পাইছি আপনেরে হারায়ে। -শাহানা শাহানার চিরকুট পড়ে জামাল স্মৃতির সাগরে ডুব দিয়েছিল। চেতনা ফিরে পেল এক বৃদ্ধ মহিলার বিলাপ শুনে। বাইরে এসে দেখে বজলু চোরের মা বুক চাপরাচ্ছে আর বলছে-কি করছিল আমার বজলু। জামালকে দেখে বলে-জামাল বাবা আইছ। আমার বজলুতো আইয়ে না। কাঁদতে কাঁদতে বজলুর মা বের হয়ে গেল। জামাল কি বলবে বুঝতে পারছেনা। তার মা এসে বলল- বজলুর মা পাগল হয়ে গেছে সারাদিন খালি বজলু বজলু করে। বজলুর মায়ের আর্তনাদ শুনে জামাল চিন্তা করতে লাগলো- দেশের স্বাধীনতার জন্য তার চেয়ে বজলুর অবদানই মনে হয় বেশি। অগত্য এই নবীনকৃষ্ণপুর গ্রামের সকল মানুষ তার কাছে ঋনী। তার কথা কেহ স্মরণ করবে না। ইতিহাসের পাতায় হয় নাম উঠবে করিম প্রধান ও ইছব এর মতো বর্ণচোরাদের শুধু নাম থাকবে না বজলু চোরদের। কারন তার পরিচয় বজলু চোর।

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি