Loading..

প্রকাশনা

০১ মার্চ, ২০১৪ ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাংলার শ্রেষ্ঠ দানবীর হাজী মুহাম্মদ মহসীন
গৃহকর্তা ঘরেই ছিল। এমন সময় গৃহে প্রবেশ করল এক চোর। ঘরের সব কিছু নিতে লাগলো হাতিয়ে। সহসা ঘুম ভেঙে গেল গৃহকর্তার। তিনি জেগে ওঠে দেখলেন চোর তাঁর ঘরের সব জিনিষপত্র নিয়ে যাচ্ছে। জেগে উঠে তিনি চোরকে ধরে ফেললেন হাতে নাতে। চোর ধরা পড়ে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলেন। গৃহকর্তার পা ধরে কাঁদলেন। আর বলল আজ পাঁচদিন যাবত আমার ছেলেমেয়েরা অনাহারে আছে, তাদের মুখে দু’মুঠো খাবার তুলে দিতে পারিনি। ওদের কান্না সহ্য করতে না পেরে চুরি করতে এসেছি হুজুর। আমাকে ক্ষমা করে দিন। তার কথা শুনে দয়া হল গৃহকর্তার। লোকটির করুণ কাহিনীতে মন গলে গেলো তাঁর। তিনি বুঝলেন লোকটি সত্যি হয়তো পেশাদার চোর নয়। তিনি তখন চোরটিকে কোন রকম শাস্তি না দিয়ে বরং আরো অনেক জিনিষপত্র এবং খাবার তুলে দিলেন চোরটির হাতে। তারপর আবার বলেন, এগুলো নিয়ে যাও, অভূক্ত সন্তানদের খেতে পরতে দিও। আর কখনও চুরি করবে না। ওপরের গল্পের যে গৃহকর্তা, তিনিই দয়ার সাগর হাজী মুহম্মদ মহসীন। এই মহান মানুষটির নাম না জানে এমন মানুষ হয়তো বাংলাদেশে পাওয়া যাবে না। আজও সবার কাছে শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত। পুরো বাঙালী জাতি মুসলিম হিন্দু সকলের কাছে সমান শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। দান, দয়া এবং মানবতার ইতিহাসে তিনি এক কিংবদন্তি পুরুষ। তাঁর দয়া ও মহানুভবতার কথা আজও প্রচলিত আছে রূপকথার মত। হাজী মুহম্মদ মহসীনের জন্ম ১৭৩২ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে হুগলী শহরে। পিতা ছিলেন আগ মুহম্মদ ফয়জুল্লাহ। মায়ের নাম জয়নব খানম। হাজী ফয়জুল্লাহর আদি নিবাস ছিল সুদূর পারস্যে। সেখান থেকে মহসীনের পূর্ব-পুরুষেরা ভাগ্যের অন্বেষণে এসেছিলেন এ দেশে। তারপর স্থায়ী আবাস গড়ে তুলেছিলেন পশ্চিশবঙ্গে এই হুগলী শহর। হাজী ফয়জুল্লাহ যে সময় হুগলীতে এসে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। তখন আগা মোতাহার নামে অপর এক ধনী ব্যবসায়ীও এখানে বসবাস শুরু করেন। তিনিও একদিন ভাগ্যের অন্বেষণে এসেছিলেন ভারতবর্ষে। তখন দিল্লির বাদশা ছিলেন আওরঙ্গজেব। তিনিও ছিলেন খুব সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান। প্রথমে দিল্লিতে এসে বাদশার অধীনে খাজাঞ্চির পদে নিযুক্ত হন। তাঁর কর্মদক্ষতায় বাদশাহ্ শীঘ্রই তাঁর প্রতি খুশি হলেন। বাদশা তখন তাঁকে যশোর এবং নদীয়া জেলার অনেকগুলো জায়গীর দান করেন। এই জায়গীরদারি পেয়ে আগা মোতাহারও দিল্লি থেকে চলে আসেন হুগলীতে এবং এখানে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। তারপর জায়গীরদারির পাশাপাশি শুরু করলেন লবনের ব্যবসা। এখানে আসার পর মোতাহার দোরদানা খানম নামের এক রমনীকে বিয়ে করেন। সুখেই কাটছিল তার সংসার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুখ দীর্ঘ স্থায়ী হল না। তাঁদের ঘরে কোন সন্তান এলো না। তাই মোতাহার সন্তান লাভের আশায় আরেকটি বিয়ে করেন। দ্বিতীয় পতœীর নাম ছিল জয়নব খানম। দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে হয়তো কোন সন্তান হবে এই আশায় তিনি আবারো দিন গুনতে লাগলেন। কিন্তু তারও সহসা কিছু হলো না। অবশেষে সব দিকে নিরাশ হয়ে তিনি পোষ্য পুত্র গ্রহণ করলেন। কিন্তু তাতেও তাঁর মন ভরলো না। এরপর শুরু হল দুই স্ত্রীর ঝগড়া। মোতাহারের মন উঠলো বিষিয়ে। মোতাহারের মনের যখন করুণ অবস্থা তখন ছোট স্ত্রীর গর্ভে জন্ম নিল ফুটফুটে এক কন্যাসন্তান। এই কন্যার নাম ছিল মনুজান। ক্রমে মনুজানের বয়স বাড়তে লাগল। এক সময় পদাপর্ণ করল যৌবনে। একদিন পিতা কন্যাকে ডেকে বললেন, তোমার গলায় আমি একটি মাদুলি পরিয়ে দিয়ে গেলাম। এর অনেক দাম। আমার মৃত্যুর পর খুলে দেখো। পিতার ইচ্ছাই ছিলো মনুজানের কাছে আদেশের চেয়েও বেশি মূল্যবান। তাই তিনি পিতার আদেশ পালন করে চললেন। তার পর পিতার মৃত্যুর পর তিনি মাদুলিটি ভেঙে দেখলেন। দেখা গেল মোতাহার তাঁর সমস্ত সম্পত্তিই দান করে গেছেন কন্যা মনুজানকে। জয়নব খানম দেখলেন স্বামী তাঁকে বঞ্চিত করে সব সম্পত্তি কন্যাকে দান করে গেছেন। তাতে তিনি খুব ক্ষুব্ধ হলেন। তাই সম্পত্তির লোভে তিনি কন্যাকে হাতে রাখার জন্য পারস্য থেকে আগত হাজি ফয়জুল্লাহ নামে এক সভ্রান্ত ব্যক্তিকে বিয়ে করলেন। মনুজানের তখন ১৩ বছর বয়স। তখনি ১৭৩২ খ্রিষ্টাব্দে মুহম্মদ মহসীনের জন্ম হয়। বংশে একটি পুত্র সন্তান হওয়াতে সবাই খুশি। সবচেয়ে বেশি খুশি হলেন মনুজান। তিনি সৎ ছোট ভাইকে নিয়ে যেন আনন্দে হাবুডুব খেতে লাগলেন। স্নেহ ও আদরে ভরিয়ে তুলতে লাগল মহসিনকে। মনুজান নিজেই একদিন ভাইকে নিয়ে গেলেন স্থানীয় মক্তবে। মক্তবের পাঠ শেষ করে মহসীনকে ভর্তি করা হল মাদ্রাসায়। সেখান তিনি আরবি, ফারসি ভাষা শিখতে লাগলেন। ছোট বেলা থেকে পড়ালেখা খুব ভাল ছিল মহসীন। তাঁর উন্নতি দেখে মা-বাবা এবং বড় বোন মনুজান সকলেই খুব খুশি। এবার আরো উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য তাঁকে পাঠানো হল মুর্শিদাবাদ শহরে। এখানে এসে তিনি একটি নাম করা মাদ্রাসায় ভর্তি হলেন। অল্প দিনের মধ্যে মহসীনের মনের গভীরতার পরিচয় পেয়ে মাদ্রাসার ওস্তাদগণ অবাক বনে গেলেন। চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল তাঁর নাম-সুনাম। অবশেষে মহসীনের গুণের কথা মুর্শিদাবাদের নবাবের কানে গেলো। তিনি ডেকে পাঠালেন এই প্রতিভাবান ছেলেকে। তারপর নবাবের অধীনে একটি উচ্চ সরকারি পদ গ্রহণের প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু মহসীন তা গ্রহণ করলেন না। ইতিমধ্যে পিতামাতার মৃত্যু হয়েছে। বাড়িতে বোন একা রয়েছে। তাই মাতৃতূল্য বোনকে একা রেখে তিনি অন্য কোথাও আটকে থাকতে রাজি হলেন না। এদিকে হুগলীতে মনুজানের ওপর বিপদ ঘনিয়ে আসতে শুরু করলো। হুগলীর বিশাল বাড়িতে থাকেন একলা যুবতী মেয়ে মনুজান। অপর দিকে বিশাল সম্পত্তি তাঁর হাতে। তাই কিছু দুষ্টু লোক তাঁর সম্পত্তি আত্মসাতের ষড়যন্ত্র পাকাতে লাগল। এই ষড়যন্ত্রের কথা টের পেয়ে ভয় পেয়ে গেলেন মনুজান। তিনি তখনই সবকিছু লিখে পত্র দিলেন মহসীনের কাছে। পত্র পেয়ে বিপন্ন বোনকে রক্ষার জন্য দ্রুত হুগলী চলে এলেন মহসীন। দীর্ঘ কয়েক বছর পর আবার ভাইবোনের মিলন হল। মহসীনকে কাছে পেয়ে মনুজান হাতে যেন চাঁদ পেলেন। মনুজান তখন ভাই মহসীনকে হুগলীতে থেকে বিষয় সম্পত্তি দেখাশোনার জন্য অনুরোধ করল। বোনের আদেশে আর মুর্শিদাবাদ ফিরে যাওয়া হল না মহসীনের। তিনি হুগলীতে থেকে সম্পত্তির দেখাশোনা করতে লাগলেন। তখন তার প্রধান কাজ হল বিবাহযোগ্য বোনকে সু-পাত্রের হাতে দান করা। অতঃপর তিনি বরের তালাশে বের হলেন। একদা শুভক্ষণে নবাবের নিযুক্ত হুগলীর ফৌজদার সালাহউদ্দিনের সঙ্গে বোনকে বিয়ের ব্যবস্থা করলেন তিনি। বোন উপযুক্ত পাত্রের হাতে সমর্পন করতে পেরে মহসীন এবার নিশ্চিন্ত হলেন। কিন্তু বিষয় সম্পত্তির প্রতি কোন লোভ ছিল না মহসীনের। বড় বোনের বিয়ের পর আবার তিনি বের হলেন ঘর থেকে। শুরু হল দেশ ভ্রমণ। যখন তাঁর বয়স মাত্র ৩৫ বছর। তখন তিনি পায়ে হেঁটে চলে এলেন মক্কায়। পালন করলেন হজ্ব। তারপর মক্কা থেকে আবার যাত্রা শুরু করলেন ইরান, ইরাক, তুরস্ক, সিরিয়া, মিশরের পথে। ঘুরে বেড়াতে লাগলেন এক দেশ থেকে আরেক দেশে। মুসলিম দেশগুলো তিনি ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন। এমন করে কেটে গেল সাতাশ বছর। তারপর ফিরে এলেন স্বদেশে। কিন্তু বিয়ে করে সংসার পাততে তাঁর আর মন চাইলো না। এরপর আবার বোনের অনুমতি নিয়ে এলেন মুর্শিদাবাদে। তখন তাঁর বয়স ষাট বছর। এদিকে মনুজানের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তাঁর স্বামী মারা গেছে। কিন্তু মনুজানের কোনো সন্তানাদি নেই। তা ছাড়া তিনিও তখন বার্ধক্যে উপনীত। স্বামীকে হারিয়ে সন্তানহীনা মনুজান এবার নিজেও একবারে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন। তিনি তাই আবার চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তাহলে এই বিশাল সম্পত্তি কে রক্ষা করবে? অনেক ভেবে তিনি কাতর হয়ে পড়লেন। অতঃপর তিনি আবার ডেকে পাঠালেন তাঁর প্রাণপ্রিয় ভাই মহসীনকে। বোনের ডাকে মুর্শিদাবাবদ থেকে আবার মহসীন ফিরে এলেন হুগলীতে। বোন মনুজান বললেন, সংসারের এই ঝামেলা থেকে এবার আমাকে মুক্তি দাও ভাই। যে ক’টা দিন আছি, আমি আল্লাহর ধ্যানে কাটাতে চাই। এই বলে বড় বোন মনুজান তাঁর নিজের সমস্ত সম্পত্তি লিখে দিলেন স্নেহের ছোটো ভাই মহসীনের নামে। এর মাত্র কয়েক বছর পর ১৮০৩ খ্রিষ্টাব্দে মনুজানের মৃত্যু হয়। মহসীন ছিলেন সংসারবিরাগী মানুষ। ঘর-সংসার, ধন -দৌলতের প্রতি তার কোন লোভ ছিল না। কিন্ত বোনের এই বিশাল সম্পত্তি নিয়ে তিনি এখন কি করবেন। তাঁর তো ঘর নেই, সংসার নেই এ সম্পত্তি ভোগ করার মত কোন বংশধরও নেই। তাছাড়া তিনি নিজেও এখন বৃদ্ধ। বয়স সত্তর বছর। আর ক’দিনইবা বাঁচবেন। তাই তিনি স্থির করলেন এই বিশাল সম্পত্তি তিনি মানব জাতির কাজে ব্যয় করবেন। দেশের দ্বীন-দুঃখী ও দুস্থদের সেবায় তিনি নিজের সব কিছু বিলিয়ে দেবেন। তার সম্পত্তির অধিকাংশই তিনি ব্যয় করেন শিক্ষার উন্নয়নের জন্য। তৎকালীন অনগ্রসর মুসলিম সমাজে শিক্ষাবিস্তারের জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন অনেকগুলো স্কুল, কলেজ। মুসলমান ছেলে মেয়েদের জন্য প্রবর্তন করলেন মহসীন বৃত্তি। গঠিত হল মহসীন ফান্ড। ভারতের মুসলমান ছেলে মেয়েরা এই ফান্ড থেকে আজো বৃত্তি পেয়ে থাকে। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন হুগলীর ইমামরারা, হুগলী মহসীন কলেজ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও অনাথদের জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন কয়েকটি দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র। তাঁর দান কর্ম নিয়ে প্রচলিত আছে অনেকগুলো গল্প। তিনি রাতে সাথে টাকা নিয়ে ছদ্ম বেশে শহরের অলি-গলিতে ঘুরে বেড়াতেন। দ্বীন-দুঃখী, অন্ধ, যাকে সামনে পেতেন তাকে মুক্ত হস্তে দান করতেন। তিনি অনেক অভাবী পরিবারের যাবতীয় ব্যয় তিনি বহন করতেন। তাঁর মত দয়ার সাগর পৃথিবীতে খুব কমই জন্মেছেন। এই দয়ার সাগর হাজী মুহম্মদ মহসীন পরিণত বয়সে এখন থেকে প্রায় দু’শ বছর আগে ১৮১২ খ্রিষ্টাব্দে নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন।

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি