Loading..

খবর-দার

১৭ এপ্রিল, ২০১৯ ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ম্যান এন্ড সুপারম্যান।
জীবনের সহিত যার সম্পর্ক, তা-ই সাহিত্য। স্বাভাবিকভাবেই যে-কোনো দেশের সৎ-সাহিত্য সে-দেশের মাটি ও মানুষকে অবজ্ঞা করে রচিত হতে পারে না। সাহিত্যে তাই ধর্ম আসে, সংস্কৃতি আসে, আসে ঐতিহ্য ও গৌরবগাথা। একটি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপন, খাদ্যাভ্যাস, সুখদুঃখ, আবেগ, কল্পনা অনিবার্যভাবে তাই জায়গা করে নেয় সে-দেশের সাহিত্যে। এর ব্যত্যয় যদি ঘটে তাহলে তাকে সুসাহিত্য বলে গণ্য করা যায় না। এ ধরনের সাহিত্য কোনো দেশে সমাদৃত হয় না, বরং তা অনেকটা বিদেশি সাহিত্যের মতো অচেনা মনে হয়। দেশের যেমন একটা চেহারা আছে, সাহিত্যেরও তেমনি একটা নিজস্ব চেহারা আছে। বাংলাদেশের সাহিত্য পাঠ করে যদি বাংলাদেশকেই খুঁজে পাওয়া না যায় তাহলে সে-সাহিত্যসৃজন বৃথাই হয়েছে বলতে হবে। এই ভুলটা আধুনিককালে আমাদের দেশে অনেকেই করেছেন, তাঁরা রাজনৈতিক কিংবা মিডিয়াজনিত সুযোগ-সুবিধার কারণে বিখ্যাত হয়েছেন বটে কিন্তু একদিন তাঁরা উপেক্ষিত হবেন, আস্তে আস্তে মুছে যাবেন জাতির স্মৃতির পৃষ্ঠা থেকে যেহেতু তাঁরা এদেশে বসবাস করেও বিদেশি সাহিত্য রচনা করে গেছেন সারা জীবন। বিশ্বের বিখ্যাত কোনো কবি-সাহিত্যিকের মধ্যে এ ধরনের গলদ কখনও পরিলক্ষিত হয় না। সাহিত্য মূলত বিজ্ঞানের মতোই সচেতন-সৃজন; আন্দাজে কিংবা জোর করে এ জিনিস সৃষ্টি করা যায় না। আধুনিক আইরিশ সাহিত্যের কর্ণধারগণ এক্ষেত্রে একটা নমুনা হতে পারেন আমাদের জন্য। জর্জ বার্নার্ড শ বিংশ শতাব্দীর জগতকাঁপনো নাট্যকার-দার্শনিক। সাহিত্যিক-দার্শনিক-রাজনীতিবিদ নির্বিশেষে সব মহলে তাঁর বেশ কদর লক্ষ্য করা যায়। আধুনিক ইংরেজি নাট্যসাহিত্যের সম্রাট জি বি শ ১৮৫৬ সালের ২৬ জুলাই আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যুবরণ করেন ১৯৫২ সালের ২ নভেম্বর। তাঁর বিখ্যাত নাটকসমূহের মধ্যে আর্মস এন্ড দ্য ম্যান (১৮৯৪), ক্যানডিডা (১৮৯৪), সিজার এন্ড ক্লিওপেট্রা (১৮৯৮), ম্যান এন্ড সুপারম্যান (১৯০১) উল্লেখযোগ্য। তাঁকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দেয় তাঁর শ্রেষ্ঠ নাটক ম্যান এন্ড সুপারম্যান। ১৯২৫ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। বার্নান্ড শ-কে অনেকে প্রগতিশীল লেখকদের প্রতিভু বলে গণ্য করেন। তাঁর সম্পকে ক্রিস্টোফার কডওয়েল তাঁর ‘দ্য বুর্জোয়া সুপারম্যান’ প্রবন্ধে বলেন: “শ হলেন একজন নৈরাজ্যবাদী, একজন নিরামিষাশী, কৌশলাবলম্বী এবং শেষ বয়সে একজন সামাজিক ফ্যাসিবাদী; তিনি অনিবার্যভাবে একজন অবাস্তব স্বপ্নে বিভোর সমাজতান্ত্রিক।” এরকম একজন কট্টরপন্থী আধুনিকমনা লেখকও বিস্মৃত হন না কখনও তাঁর স্বদেশ ও সংস্কৃতির কথা। তিনি যাদেরকে নিয়ে নাটক রচনা করেন, তাদের দৈনন্দিন জীবন ও পারিপার্শ্বিকতাকে অবজ্ঞা করেন না তিনি, সচেতনভাবে তা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেন না কখনও, কারণ তিনি জানেন সাহিত্য বাস্তবিকই বাস্তব জীবনের উপরে দাঁড়িয়ে; বাস্তবজীবন থেকে চ্যুত হলে সাহিত্য মূলত সত্য থেকেই চ্যুত হয়। শ-র আর্মস এন্ড দ্য ম্যান নাটকের শুরুতেই আমরা দেখতে পাই শ তাঁর নাটকের নায়িকা রায়নার বেডরুমের বর্ণনা দিতে গিয়ে এক পর্যায়ে বলছেন, তার রুমে হাতির দাঁতের তৈরি যিশু খ্রিস্টের একটি ছবি টাঙানো। প্রথমেই প্রশ্ন ওঠে, যিশু খ্রিস্টের ছবি আনার কী দরকার ছিলো এখানে? শ তো ধর্মে-কর্মে বিশ্বাস করেননি কখনও। যিশুকে নিয়ে বিদ্রƒপ করার জন্যও যিশুর ছবি হাজির করেননি শ; বরং রায়নার সরল ধর্ম-বিশ্বাসকে শ্রদ্ধার সাথেই উপস্থাপন করেছেন তিনি। তাহলে শ যিশু কিংবা ধর্মকে কেন বা তুলে ধরলেন এখানে? এটা এ কারণে যে, শ একজন জীবনবাদী খাঁটি নাট্যকার; যা সত্য, তা-ই তুলে ধরেছেন তিনি দর্শকদের সামনে। শেভিয়ান সাহিত্যের প্রখ্যাত গবেষক ডেভিড ক্লেয়ার বলেন, “বার্নার্ড শ-র নাটক ও পত্রসাহিত্যসমূহ গভীরভাবে পাঠ করে আমার কাছে এটাই প্রতীয়মান হয়েছে যে, শ সবসময়ই তাঁর প্রায় সমস্ত নাটকে আইরিশ, বিদেশে অবস্থানকারী আইরিশ ও আইরিশ-বংশোদ্ভুত ব্যক্তিদেরকেই উপস্থাপন করেছেন; এটা এজন্য যে, যাতে এ্যংলো-আইরিশ কিংবা খাঁটি আইরিশ চারিত্র্য তাঁর সাহিত্যে তুলে ধরা যায়।” শ জানতেন, সাহিত্য চেনাজগতের বাইরে হয় না। সাহিত্য ফিকশন; কল্পনার সৃজন বটে; কিন্তু এ সৃজন বাস্তবের মধ্য দিয়েই হয়। আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস (১৮৬৫-১৯৩৯)। একাধারে তিনি ছিলেন কবি ও নাট্যকার। কাব্যস্বভাবের দিক দিয়ে রবীন্দ্রনাথের সাথে তাঁর প্রচুর মিল পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি কাব্যসংগ্রহ গীতাঞ্জলি-র এক হাস্যকর ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন এই ইয়েটস। তিনি হয়তো জানতেন না যে, রবীন্দ্রনাথ স্বভাবে তাঁর প্রায় সমগোত্রীয়; পার্থক্য হলো, বরীন্দ্রনাথ হলেন রোমান্টিক কবি আর ইয়েটস আধুনিক কবি। তাঁদের মিল এইখানে যে, তাঁরা দু’জনেই ছিলেন ইংরেজদের একনিষ্ঠ পূজারী; নাম, যশ ও খ্যাতির জন্য ইংরেজদের দ্বারস্থ হয়েছেন বারবার কিন্তু একটা জায়গায় তাঁরা কখনও আপস করেননি, সেটা হলো তাঁদের সাহিত্য। রবীন্দ্রনাথ যেমন তাঁর সাহিত্যেÑকাব্য বলি, নাটক, উপন্যাস কিংবা ছোটগল্পÑ বাংলাকেই তুলে ধরেছেন হৃদয়-বিস্ফোরিত আবেগ ও দরদ দিয়ে; ইয়েটসও তেমনি তাঁর সাহিত্যে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর প্রিয় জন্মভূমি আয়ারল্যান্ডকে। ইয়েটস-এর সাহিত্যে যে-দেশ পাওয়া যায় তা ইংল্যান্ড নয়, আয়ারল্যান্ড। তাঁর বিখ্যাত কবিতার একটি ‘দ্য লেক আইল অব ইনিসফ্রি’। এই কবিতায় স্বদেশের প্রতি তাঁর তীব্র আবেগ ও স্মৃতি-কাতরতা ফুটে উঠেছে অত্যন্ত মর্মস্পর্শীভাবে, যেমনটি আমরা লক্ষ্য করি বাংলার মহাকবি মধুসূদনের বিখ্যাত সনেট ‘কপোতাক্ষ নদ’-এ। ভার্সাই নগরীতে অবস্থানকালে মধুসূদন স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছিলেন তাঁর গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী কপোতাক্ষ নদকে নিয়ে; ডাবিøউ বি ইয়েটসও তাঁর শৈশব-কৈশোরের লেক আইল নিয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন লন্ডনে অবস্থানকালে। মধুসূদন সনেটের শুরুতে বলেন: “সতত হে নদ, তুমি পড় মোর মনে”; ইয়েটস তাঁর কবিতার শুরুতে বলেন: “আমি জেগে উঠবো এবং এখনই যাবো, যাবো আমার ইনিসফ্রি-তে।” মধুসূদন তাঁর সনেটের মাঝখানে বলেন: বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ-দলে কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে! ইয়েটস তাঁর কবিতার মাঝখানে বলেন: আমি সেখানে কিছু শান্তি পাবো, কারণ সেখানে শান্তি ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়ে সকালের অবগুণ্ঠন থেকে, যেখানে ঝিঁঝিপোকা গান গায়, যেখানে মধ্যরাত্রি জ্বলজ্বল করে জ্যোৎস্নায় এবং দুপুর গনগন করে জ্বলে আর সন্ধ্যা ভরে থাকে লিনেট পাখির ডানার শব্দে। বাংলা ভাষায় ইয়েটস-এর অন্ধ-অনুকারী জীবনানন্দ দাশ এরই পুনরুক্তি বুঝি করেছিলেন তাঁর ‘বনলতা সেন’-এ: “আমাকে দুদÐ শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন’! যে-কথাই বলি না কেন, আসল কথা হলো দেশপ্রেম; দেশ নেই তো কবিও নেই। কবিরা কখনও শূন্যে বাঁচে না; তাঁকে বাঁচতে হয় মাটি ও মানুষের মাঝে। হোমার তাঁর মহাকাব্য ইলিয়াড রচনা করেছেন তাঁর দেশেরই মহান বীরযোদ্ধাদের নিয়ে; ইলিয়াড প্রাচীন গ্রিক বীরযোদ্ধাদের জয়গাথা। তবে ইয়েটস অন্ধ-দেশপ্রেমিক ছিলেন না। দেশেরই কল্যাণে স্বদেশবাসীর সমালোচনা করতেও ছাড়েননি তিনি। বিপ্লবোত্তর নৈরাজ্য নিয়ে তিনি চাবুকাঘাত করলেন এভাবে: বিপ্লব ও কামানের গোলা জিন্দাবাদ! ঘোড়ার পিঠে বসে থাকা এক ভিক্ষুক চাবুক মারছে পায়ে হেঁটে চলা আরেক ভিক্ষুকের পিঠে। বিপ্লবের জয় হোক! ফিরে এসেছে আবার কামানের গোলা! ভিক্ষুকেরা বদলে দিয়েছে সমস্ত স্থান ঠিকঠিকই, কিন্তু চাবুক যেভাবে চলছিল সেভাবেই চলছে। ইয়েটস-এর কবিতায় প্রচুর আইরিশ মিথ-এর ব্যবহার পাই আমরা। গ্রিক মিথকেও আইরিশ কালার দিয়েছেন তিনি তাঁর নিজস্ব শৈল্পিক কৌশলে। ‘লেডা এন্ড দ্য সোয়ান’ কবিতায় কবি গ্রিক মিথকে ব্যবহার করেছেন প্রতীক করে। গ্রিক গড জিউজ লেডাকে ধর্ষণ করে রাজহাঁসের রূপ ধরে, যার ফলে লেডার গর্ভে জন্ম নেয় ট্রয়-সভ্যতা ধ্বংসের মূল নায়িকা হেলেন। ইয়েটস এখানে সোয়ানকে দেখিয়েছেন ইংল্যান্ডরূপে আর লেডাকে আয়ারল্যান্ডরূপে। ইয়েটস মূলত ছিলেন শান্তিবাদী কবি। মারামারি, কাটাকাটি, মৃত্যু, রক্তক্ষয়Ñ এসব করে স্বাধীনতা অর্জন করার পক্ষপাতী ছিলেন না তিনি। তিনি ছিলেন, অনেকটা মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের অনুসারীদের মতো। এ কারণে সহিংস আইরিশ স্বাধীনতা-আন্দোলনের পক্ষপাতী ছিলেন না তিনি। কিন্তু যখন আইরিশ মুভমেন্টের নামে এক রক্তক্ষয়ী ঘটনা ঘটে গেল ১৯১৬ সালে এবং বহু লোকের প্রাণহানি ঘটলো, তখন তিনি লিখতে বাধ্য হলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘ইস্টার ১৯১৬’। তিনি বললেন, ইস্টারে যেমন যিশুখ্রিস্ট পুনরুত্থিত হয়ে আসমানে চলে গেছেন, তেমনি আইরিশদের মধ্যেও পুনর্জন্ম ঘটেছে। তিনি বললেন: “এক ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যের জন্ম হয়েছে।” তিনি বুঝালেন, এ সৌন্দর্য মানে দেশপ্রেম; এটা ভয়ঙ্কর এ কারণে যে, এতে বহু নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। কবিতায় তিনি নোবেল পুরস্কার পান ১৯২৩ সালে। ইয়েটস সব ব্যাপারে আপস করলেও, তাঁর স্বদেশ ও স্বাদেশিকতা নিয়ে আপস করেননি কখনও। জন মিলিংটন সিঙ (১৮৭১-১৯০৯) একজন বিখ্যাত আইরিশ নাট্যকার। আধুনিক আইরিশ সাহিত্যের পুনর্জাগরণের অন্যতম পুরোধা তিনি। ডাবিøউ বি ইয়েটস-এর সঙ্গে এবি থিয়েটার প্রতিষ্ঠার পিছনেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সিঙ তাঁর নাটকে গ্রাম্য-আযারল্যান্ডের কৃষক-মজুর শ্রেণির মানুষদেরকেই সাধারণত তুলে ধরেছেন, বিশেষ করে আরান আইল্যান্ড-ই হলো তাঁর নাট্যসাহিত্যের পাদপীট। তাঁর বিখ্যাত নাটক দুটি: রাইডার্স টু দ্য সি (১৯০৪) ও দ্য প্লে বয় অব দ্য ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ড (১৯০৭)। জাতীয়তাবাদী চেতনা তাঁর নাটকে এত বেশি প্রবল যে, তাঁর প্লে বয় অব দ্য ওয়েস্টার্ন ওয়াল্ড যখন এবি থিয়েটারে প্রথম প্রদর্শিত হয়, ভয়াবহ জাতিগত সংঘাত শুরু হয়ে যায় ডাবলিনে। মিলিংটন সিঙের শান্ত-সুন্দর নাটক রাইডার্স টু দ্য সি। এটি একটি একাংকিকা। শাশ্বত মানবিক আবেদনে পূর্ণ এ একাংকিকাটি হয়ে আছে সাগরপাড়ে বসবাসকারী আরান আইল্যান্ডের কৃষক-জেলে শ্রেণির মানুষের সংগ্রামপূর্ণ দৈনন্দিন জীবনযাপনের দলিল। গ্রিক ট্রাজেডির মতো এটি একটি অসাধারণ আধুনিক ট্রাজেডি গোছের নাটক, যা ধারণ করে আছে সাধারণ আইরিশদের দুঃখ ও ভালবাসা। এই নাটকের কেন্দ্রিয় চরিত্র মারিয়া। এক সকালের কয়েক ঘন্টার চিত্রপটে লেখক সিঙ এখানে তুলে ধরেছেন মারিয়ার জীবনের ট্রাজেডি। সে সাগরের পাড়ে বাস করে। ক্ষুধার্ত সাগর তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সব মানুষকেই কেড়ে নিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে এক এক করে তার স্বামী, শ্বশুর ও ছয় পুত্রসন্তান। সাগরের উপর নির্ভরশীল মানুষগুলো কী করুণ জীবন যাপন করছে, তা সিঙ দেখিয়েছেন তাঁর নিখুঁত শৈল্পিক হাতে। তাঁর নাটকে তিনি তুলে ধরেছেন আইরিশ ডায়ালেক্ট, যা নাটকটিকে বিশেষ আইরিশ চারিত্র্য দান করেছে। একটা দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যায়। পরিবারের বেঁচে থাকা একমাত্র পুত্র বার্টলি যখন গ্যালওয়ে ফেয়ারে ঘোড়া বিক্রি করতে যাওয়ার জন্য দৃঢ়সংকল্প, মায়ের কথায় কিছুতেই কর্ণপাত করছে না সে, সাগর উত্তাল হলেও তাঁকে যেতেই হবে কারণ এটা ঘোড়া বিক্রির একটি উৎকৃষ্ট মেলা, তখন মারিয়া পুত্রের উদ্দেশে বলছে: ওভ রঃ ধিংহ’ঃ ভড়ঁহফ রঃংবষভ, ঃযধঃ রিহফ রং ৎধরংরহম ঃযব ংবধ, ধহফ ঃযবৎব ধিং ধ ংঃধৎ ঁঢ় ধমধরহংঃ ঃযব সড়ড়হ, ধহফ রঃ ৎরংরহম রহ ঃযব হরমযঃ. ওভ রঃ ধিং ধ যঁহফৎবফ যড়ৎংবং, ড়ৎ ধ ঃযড়ঁংধহফ যড়ৎংবং ুড়ঁ যধফ রঃংবষভ, যিধঃ রং ঃযব ঢ়ৎরপব ড়ভ ধ ঃযড়ঁংধহফ যড়ৎংবং ধমধরহংঃ ধ ংড়হ যিবৎব ঃযবৎব রং ড়হব ংড়হ ড়হষু? [এটা (মাইকেলের শরীর) যদি খুঁজে না-ও পাওয়া যায়, তাতে কি! সাগরে ঝড়ো বাতাস বইছে; কাল রাতে চাঁদের বিপরীত দিকে একটা তারা ছিলো এবং প্রতিরাতেই এটা উঠছে। তোমার যদি এক শ ঘোড়াও থাকে কিংবা এক হাজার ঘোড়ার মালিকও তুমি হও, বলো হাজার হাজার ঘোড়ার মূল্য একটি পুত্রের বিপরীতে কী বা হতে পারে যখন আমার পুত্র আছে মাত্র একটাই?] প্রথমত এখানে লক্ষণীয়, সিঙের ব্যবহৃত ভাষা; তিনি আইরিশ ডায়ালেক্ট ব্যবহার করছেন; দ্বিতীয়ত আইরিশ মানুষদের মধ্যে প্রচলিত কুসংস্কারÑ চাঁদের পাছপাছ একটা তারা উঠছেÑ এটাকে অশুভ লক্ষণ বলে গণ্য করছে মারিয়া; ফলে সে তার পুত্রকে বাড়িতে আটকে রাখতে চাচ্ছে, যাতে সাগর তার শেষ পুত্রকে ছিনিয়ে নিতে না পারে। আধুনিক কথাসাহিত্যের অন্যতম প্রতিভু জেমস জয়েস (১৮৮২-১৯৪১)। মহান এই আইরিশ কথাসাহিত্যিক অমর হয়ে আছেন তাঁর কালজয়ী উপন্যাস ইউলিসিস (১৯২২)-এর জন্য। তাঁর অন্যান্য রচনাবলির মধ্যে ছোটগল্প সংকলন ডাবলিনার্স (১৯১৪) ও উপন্যাস এ পোট্রেট অব দ্য আর্টিস্ট অ্যাস এ ইয়াং ম্যান (১৯১৬) উল্লেখযোগ্য। তাঁকে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী ও গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের অন্যতম গণ্য করা হয়। জেমস জয়েসের ইউলিসিস মূলত একটি রাজনৈতিক উপন্যাস; এটি একটি আইরিশ জাতীয়তাবাদী মহাকাব্য, যা রাজনৈতিক আলংকারিক ভাষায় রচিত। জয়েস নিজেই বলেন: “ইউলিসিস দুই জাতির মহাকাব্য: ইসরাইল ও আয়ারল্যান্ড।” এই উপন্যাসের কেন্দ্রিয় চরিত্র লিওপল্ড বøুম একজন আইরিশ, যে কিনা হাঙ্গেরিয়াম বংশোদ্ভুত ইহুদি। বøুম ও স্টিফেন চরিত্রদ্বয়ের মধ্য দিয়ে জেমস জয়েস আইরিশ জাতীয়তাবাদকেই মূলত ফুটিয়ে তুলেছেন এই উপন্যাসে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়, এ যেন হোমারের ওডিসির নায়ক ইউলিসিসের ট্রয় নগরীর যুদ্ধ শেষে সমুদ্রপথে ইথাকায় ফিরে আসার লোমহর্ষক কাহিনী। জয়েস এখানে মহাকাব্যের আদলে ফুটিয়ে তুলেছেন বøুমের জীবনসংগ্রামের কথা। জয়েস চেতনায় মূলত একজন খাঁটি আইরিশ। তাঁর বিখ্যাত ছোটগল্পসংকলন ডাবলিনার্স-এর গল্পসমূহে যে-জীবনচিত্র আমরা পাই তারা সবাই আইরিশ। আইরিশসাহিত্যের আধুনিকতম কবি ছিলেন সিমাস হিনি (১৯৩৯-২০১৩)। রবার্ট লোয়েল তাঁকে ডাবিøউ বি ইয়েটস-এর পর সবচেয়ে শক্তিশালী কবি বলে অভিহিত করেছেন। হিনির জন্ম উত্তর আয়ারল্যান্ডের এক খামারবাড়িতে। নয় ছেলেমেয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম। জীবনের অধিকাংশ সময়ই তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন ডাবলিনে। তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে আইরিশের গ্রাম ও প্রকৃতি নিবিড়ভাবে। স্বভাবে তিনি অনেকটা রবার্ট ফ্রস্টের মতো কিংবা বলা যায়, বাংলা ভাষার জসীম উদ্দীনের মতো। গ্রামে জন্ম নেয়া এই কবি সারাজীবন নগরজীবনে অতিবাহিত করলেও গ্রামীণ আইরিশ জীবনই তাঁকে প্রাণশক্তি দান করে এসেছে। তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতা ‘ডিগিং’। এই কবিতায় কবি বলছেন যে, তিনি যখন টেবিলে কবিতা লিখতে বসেছেন তখন তাঁর কানে এসে বাজছে তাঁর পিতার আলুর খেতে কোদাল চালানোর শব্দ। সে-শব্দে তিনি স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ছেন। তিনি যেন আবার ফিরে গেছেন তাঁর সেই গ্রামে যেখানে তাঁর পিতা কঠোর পরিশ্রম করছেন আলুর খামারে। কোদালের শব্দ তাঁকে তাঁর শিকড়ের কথা জানিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। কবি বলেন: আমার আঙুল ও মুঠোর মধ্যে বন্দুকের মতো ফেটে পড়বার জন্য যখন বিশ্রাম নিচ্ছে আমার কলম তখন জানালার নিচে আমি শুনতে পেলাম মাটি কাটার শব্দ। তাকিয়ে দেখলাম কোঁদাল দিয়ে মাটি খুঁড়ছে আমার পিতা। ‘ফলোয়ার’ কবিতায় কবি বলেন: আমার পিতা কাজ করতেন ঘোড়া আর লাঙল নিয়ে; লাঙলের ফাল ও ফেটে পড়া মাটির মাঝখানে তাঁর কাঁধদুটো গোল হয়ে উঠতো বাতাস লাগা নৌকার পালের মতো, আর পিঠ টান টান করে হাঁফাতো হালের ঘোড়াটা। কবিতার মাঝখানে কবি বলেন: আমি চেয়েছিলাম বড় হয়ে উঠতে; এক চোখ বন্ধ করে, বাহু টানটান করে লাঙল চালাতে; আমি যা করেছিলাম তা হলো: তার বিশাল ছায়ায় আমাদের খামারটি ঘিরে তাকে অনুসরণ করেছিলাম আমি। এ কবিতাতেও আমরা দেখতে পাই সিমাস হিনির নস্টালজিয়া। পিতার খামারে ছুটে গেছে তাঁর মন; তাঁর পিতাকে বিশাল ছায়াদানকারী বৃক্ষের মতোই মনে হচ্ছে তাঁর কছে। পিতাকে তিনি করে তুলেছেন আয়ারল্যান্ডের গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষের প্রতীক। সিমাস হিনির ডেথ অব এ ন্যাচরালিস্ট (১৯৬৬), ডোর ইনটু দ্য ডার্ক (১৯৬৯); উইনটারিং আউট (১৯৭২) নর্থ (১৯৭৫), ফিল্ড ওয়ার্ক (১৯৭৯) প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যসংকলন, যার অধিকাংশ কবিতাই ঘোষণা করছে আয়ারল্যান্ডের মাটি ও মানুষের কথা সগৌরবে। বাস্তবিকই স্বদেশের জয়গান না গেয়ে কোনো কবিই সমাদৃত হয়নি কোনো দেশে, না পৃথিবীতে। স্যামুয়েল ব্যাকেট (১৯০৬-১৯৮৯) প্রখ্যাত আইরিশ কথাসাহিত্যিক, কবি ও নাট্যকার। তিনি জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেন ফ্রান্সে। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান ১৯৬৯ সালে। তাঁর বিখ্যাত রচনাবলির মধ্যে মার্ফি (১৯৩৮), মলই (১৯৫১), মেলোনে ডাইস (১৯৫১), দ্য আননামাবেল (১৯৫৩), ওয়েটিং ফর গডো (১৯৫৩),এন্ডগেইম (১৯৫৭), ক্র্যাপস লাস্ট টেপ (১৯৫৮) ও হাউ ইজ ইট (১৯৬১) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ফ্রান্সে অবস্থান করলেও আইরিশ জাতীয়তাবাদকে তিনি ভুলতে পারেননি কখনও। স্বদেশকে যেমনটি পেয়েছেন সে-রূপেই তাঁদের সাহিত্যে তুলে ধরেছেন তাঁরা, এক চুলও এদিক ওদিক করেননি। স্বদেশও তাঁদেরকে মাথায় তুলে রেখেছে মহানায়ক বানিয়ে। আর যাঁরা স্বদেশে বিখ্যাত হন, বিশ্বও তাঁদেরকে মাথায় নিয়ে নাচে। এর ব্যত্যয় হয় না কোথাও, কোনো কালে। লেখক : কবি, সাহিত্য-সমালোচক