সহকারী শিক্ষক
৩০ জানুয়ারি, ২০২০ ১২:১৭ পূর্বাহ্ণ
হরিশংকর জলদাসের ‘জলপুত্র’ জলমগ্ন মানুষের হাসি-কান্না আর জন্ম-মৃত্যুর দুঃখগাথা
হরিশংকর জলদাসের ‘জলপুত্র’
জলমগ্ন মানুষের হাসি-কান্না আর জন্ম-মৃত্যুর দুঃখগাথা
বাংলাসাহিত্যে জেলেদের যাপিত জীবন নিয়ে খুব বেশী যে সাহিত্যচর্চা হয়েছে, তা কিন্তু নয় । এই প্রান্তিক সমাজকে নিয়ে এ পর্যন্ত পাঁচটি উপন্যাস লেখার সন্ধান পাওয়া যায় । এগুলো হলো- মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’, অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, সমরেশ বসুর ‘গঙ্গা’, সাধন চট্টোপাধ্যায়ের ‘গহিন গান’ এবং ঘনশ্যাম চৌধুরীর ‘অবগাহন’ । পাঁচটি উপন্যাসই নদীভিত্তিক । উপরিউক্ত উপন্যাসগুলোর মধ্যে ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ও ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ দুইটিতে জেলেজীবন এসেছে নদীর পলির গভীরতা ছুঁয়ে; প্রবল ঢেউয়ের সঙ্গে যুদ্ধজয়ী মানুষের ঘামের কটু গন্ধ আর মাছের আঁশটে গন্ধ মেখে; নদীর মতো সরল বিশ্বাসের সংগ্রামী মানুষ আর সুবিধাবাদী ব্যক্তিদের লড়াই ঘিরে। তাই এ দুই উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের এক অমর কীর্তিগাথা। কিন্তু হরিশংকর জলদাসের ‘জলপুত্র’ উপন্যাসটি কিছুটা ভিন্ন। এর ব্যাপ্তি আরো অনেক বেশি। কারণ উপরিউক্ত উপন্যাসগুলোয় জেলেজীবন নদীকেন্দ্রিক। আর ‘জলপুত্র’ সাগরকেন্দ্রিক। জেলেজীবন নির্ভর সমুদ্রভিত্তিক উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে আর নেই । হরিশংকর জলদাসের জন্ম বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষা চট্টগ্রামের উত্তর পতেঙ্গা গ্রামে । তিনি কাছ থেকে সাগরকে দেখেছেন । সাগরের সাথে সংগ্রাম করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন । তাই তো তাঁর লেখায় উঠে আসে ধীবরশ্রেণীর আনন্দ-কান্না, জন্ম ও মৃত্যুর কথা ।
হরিশংকর জলদাসের ‘জলপুত্র’ উপন্যাসটি জেলেদের নিয়ে লেখা । ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের স্রষ্টা অদ্বৈত মল্লবর্মণ একজন জেলে । তাঁর পরে আর কোনো জেলে কৈবর্তদের নিয়ে উপন্যাস লেখেননি । হরিশংকর জলদাসই দ্বিতীয় জেলে, যিনি জেলে সম্প্রদায় নিয়ে উপন্যাস রচনা করলেন । হরিশংকর জলদাসের ‘জলপুত্র’ উপন্যাসে জেলে সম্প্রদায়ের অপ্রাপ্তির বেদনা, প্রাপ্তির উল্লাস, শোষণের হাহাকার, অশিক্ষার অহংকার কিংবা শিক্ষার জন্য তীব্র আকাঙ্খা –সবই অসাধারণ নৈপুণ্যের সঙ্গে অঙ্কিত হয়েছে ।
‘জলপুত্র’ এক নারীর জীবন সংগ্রামকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা কাহিনী। বালিকা বধূ হয়ে আসা ভুবনেশ্বরীর গল্প এটি। মাত্র উনিশ বছরে স্বামীহারা হন তিনি। স্বামী চন্দ্রমনিকে টেনে নিয়ে গেছে দইজ্যা দরিয়া। এক উথাল-পাথাল ঢেউয়ের দিনে তার স্বামী আর ফেরেনি। লাশ পাওয়া যায়নি। তাই রীতিমাফিক ১২ বছর সধবার বেশে অপেক্ষায় কাটাতে হয় তাকে। একমাত্র শিশুপুত্র গঙ্গাপদ আর বৃদ্ধ শ্বশুরকে নিয়ে তার জীবন। কখনো মুখ বুজে মার খাওয়া, কখনো তেড়ে ওঠা, শেষ পর্যন্ত অনাগত জলপুত্রের প্রত্যাশায় তার জীবন বহমান। এ বহমান জীবনে জড়িত প্রত্যেক ব্যক্তি এখানে খোলস ছেড়েছে বা গুটিয়েছে যে যার চাহিদামাফিক আর উপন্যাসকে সমৃদ্ধ করেছে বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপটে। ভূবনেশ্বরী যখন স্বামী হারিয়ে দিশেহারা, আয় রোজগারের কোনো পথ নেই, তখন বংশীর মা ত্রাতা হয়ে পাশে দাঁড়ালেন । ভুবন’কে নিজ হাতে মাছ বিক্রি করা শেখালেন। নিয়ে গেলেন হাটে । উপন্যাসের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে বংশীর মা, জয়ন্ত কিংবা আব্দুল গফুরের মতো উপকারী মানুষদের খোঁজ মিলবে । আবার আব্দুস শুক্কুর ও শশীভূষণের মতো দাদন ব্যবসায়ীদেরও সন্ধান মিলবে; যারা স্বার্থের জন্য মানুষ মারতেও দ্বিধা করে না । উপন্যাসটিতে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার প্রাধান্য সর্বত্র । হরিশংকর জলদাস নিখুঁতভাবে এ ভাষা তুলে এনেছেন, আর সেই সঙ্গে যোগ করেছেন একেবারে শিক্ষাবিবর্জিত এ জনপদের সব অশ্রাব্য বুলি। জেলেদের স্থানীয় ভাষার নিপুণ ব্যবহার এ উপন্যাসের এক বিশেষ দিক। নিখুঁত বর্ণনায় উঠে এসেছে গঙ্গা আর মনসা মায়ের পূজা, পুঁথি পাঠের আসরের সঙ্গে অবশ্যম্ভাবী ‘নাউট্যাপোয়া’দের কথা। যেখানে নাউট্যাপোয়াদের পালা করে ভোগ করে জেলেদের সমাজের একটু উঁচু অবস্থানের মানুষ। উপন্যাসের শেষ অংশে আমরা দেখি, প্রিয়পুত্র গঙ্গার মৃতদেহের পাশে জল-কাদায় বসে আছে ভুবনেশ্বরী- স্তব্ধ, নিথর, পাথরের মতো। কিন্তু দৃষ্টি তার উঠানে-জড়ো হওয়া অসংখ্য মানুষকে ছাড়িয়ে দূরে-বহুদূরে প্রসারিত । পাঠক আবার প্রস্তুতি নেয় নতুন সংগ্রামের, দিনবদলের নতুন আশায়।
জেলেজীবন সম্পর্কে জানার আরেকটি কালজয়ী উপন্যাস ‘জলপুত্র’। পড়ুয়াদের এ উপন্যাসটি ভালো লাগবে, তা নিশ্চিত।
লেখকঃ পংকজ কান্তি গোপ, সংস্কৃতিকর্মী ও সহকারি শিক্ষক, পুটিজুরী এস.সি.উচ্চ বিদ্যালয়, বাহুবল, হবিগঞ্জ ।