Loading..

খবর-দার

২৮ মার্চ, ২০২০ ০১:৪০ অপরাহ্ণ

করোনা : ধূমপানে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে

করোনাভাইরাস (COVID-19) একটি তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ। এটি গুরুতর সংক্রমণ, যা সাধারণ শ্বাস-প্রশ্বাসকে প্রভাবিত করে এবং ভাইরাস সংক্রমণের কারণ হয়ে থাকে। ধূমপানের ধোঁয়া ফুসফুস টিস্যু এবং সারা শরীরে প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে। এটি করোনাভাইরাসের সংক্রমণের বিরুদ্ধে দেহের সুরক্ষা করতে পারে না। শনিবার (২৮ মার্চ) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, ধূমপানের ফলে শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। সংক্রমণের মাত্রা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। ধূমপান করে না এমন ব্যক্তির চেয়ে সংক্রমণের ঝুঁকি আরও বেশি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সিগারেটের ধোঁয়া এবং বাষ্পীয় অ্যারোসল অথবা ই-সিগারেট ফুসফুসের প্রদাহের সঙ্গে সম্পৃক্ত রোগব্যাধির প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধূমপান বা ই-সিগারেট ধূমপায়ীদের করোনাভাইরাস দ্বারা মারাত্মক সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, ধূমপান ফুসফুসের প্রতিরোধ ক্রিয়াকে দমন করে এবং প্রদাহ সৃষ্টি করে। দীর্ঘমেয়াদি ধূমপায়ী এবং ই-সিগারেট ব্যবহারকারীরা উভয়েই ফুসফুসের দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণের তীব্র ঝুঁকিতে রয়েছেন, যা নতুন ভাইরাসজনিত রোগ হিসেবে কোভিড-১৯-এর ক্ষেত্রে আরও মারাত্মক হতে পারে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, ধূমপান এবং সম্ভবত ই-সিগারেটের বাষ্প করোনাভাইরাস থেকে মারাত্মক সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে। চীনের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার চেয়ে নারীর হারের চেয়ে পুরুষের হার কিছুটা বেশি। চীনের একটি মেডিকেল জার্নালে দেখা গেছে, ধূমপানের ইতিহাস রয়েছে এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে নিউমোনিয়া হওয়ার আশঙ্কা ১৪ গুণ বেশি।

প্রচুর বৈজ্ঞানিক প্রমাণ রয়েছে- ধূমপান ফুসফুসে প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে। নিয়মিত ধূমপান করার ফলে এটি বায়ুপথে সিলিরি ক্লিয়ারেন্সকে বাধা দেয়। বাতাস থেকে টক্সিন এবং শ্লেষ্মা বের করে আনার জন্য এবং কাশির সময় ফুসফুস পরিষ্কার করার জন্য এরা দায়বদ্ধ এবং ধূমপান করলে তখন তা প্রভাবিত হয়। ফুসফুসে শ্বাসকষ্টের সংক্রমণের সময়, নিউট্রোফিল নামক শ্বেতরক্ত কোষের প্রদাহ দেখা দেয়। গবেষণা থেকে এটি স্পষ্ট, ধূমপান করোনাভাইরাসের প্রভাবকে আরও খারাপ করে তোলে।

যদি কেউ ধূমপান ত্যাগ করতে চান, তবে এটি খুব ভালো সময়। আমরা এ সংকটের মধ্য দিয়ে যতটা সম্ভব মানুষকে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর রাখতে এবং ফুসফুসের অবস্থার উন্নতি, ক্ষত নিরাময়সহ শরীরের অন্যান্য বিষয়ে উন্নতি করতে সহায়তা করে পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাব কমিয়ে আনতে পারি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, যেসব শিশু ধূমপায়ীর সংস্পর্শে আসে, তাদের তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। অতএব ধূমপায়ী ধূমপান বন্ধ করলে পরিবারের ধূমপান সম্পর্কিত অসুস্থতার ঝুঁকি হ্রাস পাবে।

পরোক্ষ ধূমপান এক্সপোজার হ্রাস করা, বিশেষত বাচ্চাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ফুসফুসের অন্যান্য ভাইরাস দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে মারাত্মক অসুস্থতার কারণ হতে পারে। করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে এটি একই রকম হতে পারে। এ জন্য ধূমপায়ীদের যদি দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে, তবে অতিরিক্ত যত্ন নেয়া উচিত। সুতরাং এখনই যারা ধূমপান ছাড়তে চান, তাদের নিকোটিনের ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নিকোটিন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপির (এনআরটি) সন্ধান করা প্রয়োজন। এটি আমাদের সবার জন্য উদ্বেগজনক সময় এবং মানুষ নিজের সুরক্ষা এবং অন্যকে সুরক্ষার উপায় সন্ধান করছে। এ সময় ধূমপান বন্ধ করা বা থামানো সেরা কাজগুলোর মধ্যে একটি হতে পারে।


অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (এএনইউ) থেকে প্রফেসর সানজায়া সেনানায়াকে বলেছেন, ধূমপায়ীরা করোনাভাইরাস থেকে খারাপ পরিণতি ভোগ করতে পারে। ধূমপান ছেড়ে দেয়া এবং শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগ থেকে নিজেকে রক্ষা করার কয়েকটি উপায়-

১. ধূমপান ছাড়ার জন্য কারণগুলোর একটি তালিকা তৈরি করুন। ধূমপান ছেড়ে দেয়ার প্রচুর কারণ রয়েছে; তবে আপনি কি কখনও এগুলো লিখে রেখেছেন? তাহলে এখনই লিখুন। এটি আপনাকে ধূমপান ছাড়তে সহায়তা করবে।

২. ধূমপান ছাড়ার ‘তারিখ’ নির্ধারণ করুন এবং তারপর এটি দেয়ালের ক্যালেন্ডারে আটকে দিন এবং আজই করুন; যেমন আপনার জন্মদিন অথবা শুভ কোনো একটি দিন।

৩. আপনার ডায়েট পরিবর্তন করুন। এমন কেউ কি আছেন যে, রাতের খাবারের পর সিগারেট উপভোগ করেন? ধূমপান বাদ দিয়ে পনির, ফল এবং শাকসবজির মতো জিনিসগুলো ভিন্ন বা নতুন স্বাদ তৈরি করতে পারে। সুতরাং ধূমপানের পরিবর্তে পুষ্টিকর বা ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করুন। আপনি আপনার প্রিয় বইটি পড়তে পারেন, টিভিতে আপনার পছন্দসই অনুষ্ঠানটি উপভোগ করতে পারেন বা ঘরের অন্য কোনো স্থানে ফিরে যেতে পারেন, যেখানে আপনি ধূমপানের সঙ্গে জড়িত নন।

৪. আপনার পানীয় পরিবর্তন করুন। গবেষকরা বলছেন যে, নির্দিষ্ট কিছু পানীয় ধূমপানকে আরও উৎসাহিত করে। অ্যালকোহল, কোলা, চা এবং কফি সবই ধূমপানকে আরও আকর্ষণীয় করে। সুতরাং বেশি জল এবং ফলের রস পান করুন বা আপনার পছন্দের অ্যালকোহলমুক্ত পানীয়টি গ্রহণ করুন।

৫. বন্ধুদের এড়িয়ে চলুন। বন্ধু-বান্ধব এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ধূমপান গ্রহণ করা অনেকের অভ্যাস। তারা হয় আপনার সবচেয়ে বড় সমর্থক, নতুবা তারা আপনার সঙ্গ চায়। অতএব ধূমপান করে না, এমন লোকের সঙ্গে মিশুন এবং ধূমপায়ীদের সঙ্গ বর্জন করুন।

৬. গবেষণায় দেখা গেছে, প্যাচ এবং লজেন্সের মতো নিকোটিন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি ধূমপান ছাড়ার সম্ভাবনা ১.৫ গুণ বাড়িয়ে তোলে। ঘজঞ হল নিকোটিন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি, যা ধূমপান বন্ধ করতে সহায়তা করতে পারে। এর মধ্যে নিকোটিন প্যাচ চুইংগাম এবং মুখের স্প্রে ধূমপান ছাড়ার জন্য সহায়ক হতে পারে।

৭. নিকোটিন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপির পাশাপাশি ধূমপান ত্যাগের জন্য শরীরচর্চায় যতটা সম্ভব সক্রিয় হওয়া ভালো। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ২৫ মিনিট হেঁটে যাওয়া বা ব্যায়াম করার অভ্যাসটি ধূমপান ছাড়তে কার্যকর। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; কারণ ধূমপান ছাড়ার প্রথম পর্যায়ে বিরক্তি দেখা দিতে পারে। তাই তখন ইয়োগা বা ব্যায়াম করা জরুরি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মাত্র কয়েক মিনিটের পথচলা বা ব্যায়াম মস্তিষ্কে অ্যান্টি-ক্র্যাভিং কেমিক্যাল তৈরি করার কারণে ধূমপানের অভ্যাসটি কাটাতে সহায়তা করতে পারে।

৮. নিজের জন্য শুধু নয়, পরিবারের প্রতিও সদয় হোন। ধূমপানের কারণে নিজেকে হারাবেন না। আপনি কেবল নিজের জন্য নয়, আপনার পরিবার-সন্তানের জন্য আরও শক্ত হয়ে সিদ্ধান্ত নিন। ধূমপান এবং ই-সিগারেট ছাড়ার মাধ্যমে করোনাভাইরাসজনিত মারাত্মক ফুসফুসের রোগের ঝুঁকি হ্রাস করুন।

একটি গবেষণায় ধূমপান এবং ইনফ্লুয়েঞ্জার মধ্যকার সম্পর্কের একটি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ধূমপায়ীদের আইসিইউতে থাকা এবং ভর্তি হওয়ার আশঙ্কা বেশি ছিল। যেহেতু করোনাভাইরাস ফুসফুসে আক্রমণ করে, তাই তাদের জন্য এটি মারাত্মক হুমকি হতে পারে; বিশেষত, যারা তামাক বা গাঁজা সেবন করেন। কোভিড-১৯ থেকে গুরুতর জটিলতার ঝুঁকি কীভাবে হ্রাস করা যেতে পারে, সে সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করার জন্য কাজ করা প্রয়োজন; যেমন, ধূমপান বন্ধ করা।

ধূমপান সম্পর্কিত আইন ও নীতিগুলো শক্তিশালী করা এবং ই-সিগারেটসহ ধূমপান ও অ্যারোসলের প্রভাব থেকে অধূমপায়ীদের রক্ষা করার এখন একটি ভালো সময়।

ড. অরূপরতন চৌধুরী : অধ্যাপক, বারডেম হাসপাতাল; প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মানস (মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা); একুশে পদকপ্রাপ্ত।