Loading..

খবর-দার

০৬ মে, ২০২০ ১২:৪৭ পূর্বাহ্ণ

করোনাকাল ও আমাদের দীনতা --- পংকজ কান্তি গোপ

করোনাকাল ও আমাদের দীনতা --- পংকজ কান্তি গোপ

বিশ্বাস করি, অমিত এক সম্ভাবনা নিয়ে অচিরেই নতুন সূর্য উঠবে। পাখির কলকাকলীতে আবারো মুখরিত হয়ে উঠবে ধরিত্রী। নতুন একটি ভোর আমাদের সকল দুঃখ ঘুচিয়ে দেবে। হ্যা, করোনোকাল শেষ হবে একদিন। বিশ্বে ইতিপূর্বে ঘটে যাওয়া প্রতিটি মহামারীই একসময় বিজ্ঞানের কাছে পরাস্ত হয়েছে। করোনা'র তাণ্ডবও একসময় থেমে যাবে। কিন্তু, করোনো আমাদের যা দেখিয়ে দিয়ে গেল তা থেকে সকলের শিক্ষা নেয়া এখন সময়ের দাবী। করোনা প্রতিরোধে ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখা, শিষ্টাচার মেনে চলা ও ঘরে থাকার কথা বলা হচ্ছে বারবার। রেডিও-টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিনিয়ত ওই বার্তাগুলো প্রচার হচ্ছে। কিন্তু, আমরা বেশীরভাগ মানুষই তা মানছি না। লকডাউনের কথা বলা হলেও এড়িয়ে চলছি। বরং প্রশাসন কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে একধরনের 'চোর-পুলিশ' খেলায় মেতে উঠেছি আমরা। আইন না মানার একধরনের প্রবণতা আমাদের মাঝে কাজ করে প্রতিনিয়ত। এই দুর্যোগকালে অসহায়-দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কথা সকলের। সরকারি সাহায্য সঠিক ভাবে বিতরণ করার কথা রাজনীতিবিদ ও দায়িত্বশীলদের। কিন্তু হতাশার কথা হলো তথাকথিত কিছু সংখ্যক জনপ্রতিনিধি গরীবের ত্রাণটুকুও লুটেপুটে খাচ্ছে। অথচ এরাও তো মানুষ! গরীব অসহায় জনগণ যেখানে একমুঠো ভাতের জন্যে সরকারী সাহায্যের দিকে অপলক চেয়ে থাকেন; সেখানে ওই সরকারি ত্রাণ সামগ্রীই পাওয়া যায় ওইসব জনপ্রতিনিধির ঘরের মেঝেতে। আমাদের মূল্যবোধ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে, ভাবা যায়? এসব বিষয় নিয়ে ভাবার সময় এখনই। যে যার অবস্থান থেকে আরো বেশী দায়িত্বশীল ও যত্নশীল হলেই কেবল একটি মানবিক, মূল্যবোধ সম্পন্ন জাতি গঠন করা সম্ভব। আর এক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারে। ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করলে সম্ভাবনাময় একটি বাংলাদেশ গড়া সম্ভব। দেশের সকল স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেই কিছু প্রতিবন্ধতা আছে। ওইসব সমস্যা সমাধান করলেই আমাদের ভবিষ্যৎ আরো সুন্দর ও সাবলীল হয়ে উঠবে। একটি উদাহরণ দেয়া যাক, দেশের এমন কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই, যেখানে শৌচাগার নেই। কিন্তু ওইসব শৌচাগারের অধিকাংশই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। মফস্বল অঞ্চলের অবস্থা তো আরো করুণ। অথচ প্রাথমিক স্তর থেকেই যদি শিক্ষার্থীদের পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা কিংবা হাত ধুয়া'র অভ্যাসটি রপ্ত করানো যেতো, তবে এখন আর 'হাত-ধুয়া' নিয়ে এতো ব্যতিব্যস্ত হতে হতো না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শুধু সিলেবাস শেষ করা আর ফলাফলের দিকে নজর দেয়ার পাশাপাশি আরো কিছু বাড়তি দায়িত্ব নিতে পারে। যেমন- শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষাদান, জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার শিক্ষা, সামাজিকীকরণ, মূল্যবোধ সৃষ্টি, পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, নেতৃত্ব প্রদান, মমত্ববোধ সৃষ্টি, মানবিক হওয়া সহ আরো কিছু বিষয়ে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলা সম্ভব। তবে এসব অর্জন কেবল শিক্ষকদের একার পক্ষে বাস্তবায়ন করা কঠিন। এজন্য অভিভাবকদের সচেতনতা আর জ্ঞানার্জন আবশ্যক। কারণ ওইসব গুনাবলী একদিনেই আয়ত্বে আনা যায় না। দীর্ঘদিন চর্চার ফলেই কেবল এগুলো অর্জিত হয়। তাহলে প্রশ্ন হতে পারে, কীভাবে ছাত্রছাত্রীদেকে গুণাবলি সম্পন্ন প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়বো? এর উত্তরে বলবো, অনেকগুলো বিষয় এতে জড়িয়ে আছে। প্রতিটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করলে এ নিবন্ধটি দীর্ঘ হয়ে যাবে বিধায় শুধু পয়েন্টগুলো উল্লেখ করছি। শুরুতেই প্রয়োজন শিক্ষক ও অভিভাবকদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলে বাকী অর্জন খুব সহজে হয়ে যায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে 'বই পড়া'র কথাই ধরা যাক। শুধু ছাত্রছাত্রীদেরকে বই পড়তে উৎসাহিত করলেই হবে না, এ অভ্যাস শিক্ষক-অভিভাবকদের মধ্যেও থাকতে হবে।আর তখনই এটি কার্যকর ভূমিকা রাখবে।এ রকম প্রতিটি শুভ উদ্যোগের সাথে শিক্ষক-অভিভাবকদের সম্পৃক্ততা জরুরী। এবার আসা যাক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক আর কি কি কার্যক্রম নেয়া যেতে পারে। কিছু বিষয় আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। ওইগুলো ছাড়াও ভালো বই পড়া, সিনেমা দেখা, পাঠচক্র করা, নেতৃত্বের গুণাবলি তৈরি করা, সহপাঠীদের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি করা, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, জীবন দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষা দেয়া, স্কুল এবং নিজের চারপাশকে সুন্দর রাখা, সামাজিক কাজে অংশ নেয়া (নিজের পাড়া/মহল্লায় ভালো কোনো উদ্যোগ নেয়া), শিষ্টাচার মেনে চলা, ভালো কাজ দিয়ে অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করতে দেয়া ইত্যাদি। এরকম আরো বহুবিদ কাজ ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে করানো যেতে পারে। ওইসব কার্যক্রমের জন্য আলাদা মার্কস দেয়া যেতে পারে, যা পরীক্ষায় যোগ হবে। তবে এসব বাস্তবায়নের পেছনে প্রথমেই প্রয়োজন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। কেবল শিক্ষক নয় অভিভাবক ও যথাযথ কর্তৃপক্ষেরও এতে সদিচ্ছা থাকা প্রয়োজন। শুধু শিক্ষার্থীদের মাঝে এসব চাপিয়ে দিলেই হবে না, মনিটরিংও দরকার। আরেকটি বিষয় দরকার। সেটি হলো ওইসব কার্যক্রম বাস্তবায়নকারী শিক্ষকগণের যথাযথ মূল্যায়ন। তাতে কাজের গতি বাড়বে। তবে আশার কথা হলো সরকারও এসব বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন। ধারাবাহিক মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থায়। প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শুভ কাজের অনুশীলন করলে ধীরে ধীরে তা অভ্যাসে পরিনত হবে। যা আমাদেরকে সত্য ও সুন্দরের পথে নিয়ে যাবে। চেতনাগত পরিবর্তন আসলেই কেবল প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব।

লেখকঃ পংকজ কান্তি গোপ, সহকারী শিক্ষক, পুটিজুরী এস.সি.উচ্চ বিদ্যালয়, বাহুবল, হবিগঞ্জ।