Loading..

উদ্ভাবনের গল্প

০৭ মে, ২০২০ ০৩:৪১ পূর্বাহ্ণ

ফলস নেগেটিভ' ১০ কারণে

তীব্র জ্বরে আক্রান্ত রাজধানীর শ্যামলীর একজন প্রসূতি নারীর দুই দফা নমুনা পরীক্ষায় নেগেটিভ রিপোর্ট এলেও মাত্র ১১ দিনের মাথায় তৃতীয় টেস্টে করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে। একইভাবে মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের একজন চিকিৎসকের প্রথম চার দফা পরীক্ষায় নেগেটিভ রিপোর্টের পর পঞ্চম দফায় করোনা পজিটিভ রিপোর্ট আসে। এ ছাড়া বেশ কয়েকজন রোগীর প্রথম টেস্টে করোনা পজিটিভ, দ্বিতীয় টেস্টে নেগেটিভ এবং তৃতীয় টেস্টে ফের পজিটিভ রিপোর্ট পাওয়ারও নজির রয়েছে।

স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেশ কিছু রোগীর করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট মাঝেমধ্যেই এমন বদলে যাচ্ছে যে, তারা নিজেরাই হতবাক। এ অবস্থায় সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হচ্ছে। বিশেষ করে যাদের করোনা 'ফলস নেগেটিভ' রিপোর্ট আসছে তাদের চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ত্রম্নটি হলেই বড় ধরনের বিপদে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সব রোগীকেই করোনায় আক্রান্ত ধরে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের।

তাদের ভাষ্য, যদি কারও নমুনা পরীক্ষায় ফলস পজিটিভ রিপোর্ট আসে তবে তা খুব বেশি উদ্বেগের কারণ হবে না। কেননা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি জ্বর, গলা ব্যথা কিংবা শ্বাসকষ্টসহ যেসব উপসর্গ নিয়ে করোনা টেস্ট করিয়েছেন, চিকিৎসায় তার এসব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তবে বিপুলসংখ্যক করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির ফলস নেগেটিভ রিপোর্ট এলে তা স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের বড় কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। কেননা এসব রোগীর মাধ্যমে চিকিৎসক-নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশাপাশি আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী ও প্রতিবেশীরা সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এদিকে এ ধরনের 'ফলস নেগেটিভ' বা 'ফলস পজেটিভ' রিপোর্ট কেন আসছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তারা জানান, 'প্রি টেস্ট প্রোবাবিলিটি'-র সঙ্গের্ যাপিড পলিমার চেন রিঅ্যাকশন (আরটি-পিসিআর) টেস্ট করলে তবে সঠিক ফল আসার সম্ভাবনা। 'প্রি টেস্ট প্রোবাবিলিটি' অর্থাৎ রোগীর শারীরিক উপসর্গ, রেডিয়োলজিক্যাল পরীক্ষার রিপোর্ট, রক্তে লিম্ফোপেনিয়ার সংখ্যা- এসব কিছুর সঙ্গে আরটি-পিসিআরকে মেলাতে হবে। তা না হলে রিপোর্ট ভুল আসতে পারে।

এ ছাড়া কারও দেহে কোভিড-১৯ এর উপসর্গ দেখা দেওয়ার ৪-৫ দিনের মাথায় লালারসের নমুনা সংগ্রহ করা উচিত। নমুনা সঠিক পদ্ধতিতে সংগ্রহ করা, তা ঠিকঠাক কোল্ড চেন রক্ষা করে পরীক্ষার জন্য নিয়ে যাওয়া ও চার ঘণ্টার মধ্যে ল্যাবে পরীক্ষা করাটাও জরুরি।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ, লালারস বা গলা থেকে রস নমুনা হিসেবে সংগ্রহের পাশাপাশি নাক থেকেও সোয়াব নেওয়া উচিত। তাতে রিপোর্ট ভাল মেলে। কোভিডের মতো উপসর্গ থাকলেও রিপোর্ট যদি নেগেটিভ আসে তা হলে রোগীকে কিছুদিন আইসোলেশন ওয়ার্ডে নজরদারিতে রেখে একাধিকবার তার নমুনা পরীক্ষা করতে হবে। তারপর নিশ্চিত হতে বুকের সিটিস্ক্যান করতে হবে। তাতেও নেগেটিভ এলে তবে বলা যাবে রিপোর্ট নেগেটিভ। তারা মনে করেন, রোগীর শরীরে ভাইরাল লোড সব সময় এক থাকে না। যখন খুব কম থাকে তখন টেস্ট করলে অনেক সময় 'ফলস নেগেটিভ' রিপোর্ট আসার সম্ভাবনা রয়েছে।

গত ১১ মার্চ জার্নাল অব আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। চীনের দুটি প্রদেশের ৩টি হাসপাতালের ২০৫ জন রোগীর ওপর করা ওই সমীক্ষা রিপোর্টে দেখা গিয়েছিল, শ্বাসনালির ভেতর থেকে সংগ্রহ করা রসে কোভিড পজিটিভিটি ৯৩ শতাংশ। নমুনা হিসেবে কফের পজিটিভিটির হার ৭২ শতাংশ। নাকের জলের নমুনা থেকে কোভিড ভাইরাস পাওয়ার হার ৬৩ শতাংশ। লালারসে ভাইরাস পাওয়ার হার ৩২ শতাংশ।

র্

যাপিড পলিমার চেন রিঅ্যাকশন (আরটি-পিসিআর) টেস্টে কেন ফলস নেগেটিভ ফলাফল মিলছে এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ড. মো. আবু সাঈদ আরও ৬টি কারণ তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, এই পদ্ধতিতে ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিয়িক এসিডের (ডিএনএ) [রাইবোনিউক্লিক এসিড (আরএনএ) থেকে ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিয়িক এসিড (ডিএনএ) করতে হয়, যাতে কম্পিলিমেন্টরি ডিএনএ (সিডিএনএ বলে)] লেভেল পরিমাপ করা যায়; এজন্য একে কিউআরটি-পিসিআর বলে। এই কিউআরটি-পিসিআর-এর কয়েকটি ধাপ আছে সেগুলো হলো- ১. স্যাম্পল সংগ্রহ: এই ধাপে এক জন স্বাস্থ্যকর্মী রোগীর কাছ থেকে স্যাম্পল সংগ্রহ করবে। স্যাম্পল সংগ্রহ করার পদ্ধতি সঠিক না হলে, রেজাল্ট 'ফলস নেগেটিভ' আসবে।

২. স্যাম্পল সংরক্ষণ: স্যাম্পল সংগ্রহ করার পর দ্রম্নত ২-৪ ডিগ্রি বা ২-৮ ডিগ্রি রক্ষা করতে হবে এবং সংরক্ষণ করতে হবে। যদি কোনো কারণে তাপমাত্রা বেশি হয়, তাহলে স্যাম্পল নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে 'ফলস নেগেটিভ' হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

৩. আরএনএ ইক্সট্রাকশন : এই স্টেপ খুব ক্রিটিক্যাল। আরএনএ সাধারণ রুম তাপমাত্রায় নষ্ট হয়ে যায়। আরএনএ ইক্সট্রাকশনের জন্য কিট আছে। আরএনএ ইক্সট্রাকশন প্রটোকল অনুযায়ী কয়েকটি পদক্ষেপ অনুসরণ করে আরএনএ করা হয়। এ সময় তাপমাত্রার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য আইস বক্স রাখতে হয়। আইস বক্সে তাপমাত্রা ২-৮ ডিগ্রি থাকে। আরএনএ আরএনএ ইক্সট্রাকশনের জন্য প্রয়োজন তরল নাইট্রোজেন, মর্টার, পেস্টল, সেন্ট্রিফিউজ টিউব, কালেকশন টিউব, মাইক্রো সেন্ট্রিফিউজ, পিপেট, ভটেক্স মিক্সচার অথবা সনিকেটর, পিপিই ইত্যাদি। স্যাম্পল মর্টারের মধ্যে নিয়ে তরল নাইট্রোজেন নিতে হয়। এর পর খুব ভালো মতো গ্রাইন্ডিং করা হয়। গ্রাইন্ডিং করা শেষ হলে, কিট দিয়ে বাকি স্টেপগুলো সম্পূর্ণ করতে হয়। আরএনএ সংরক্ষণ করতে হয় আরএনএসি ফ্রি ওয়াটারে। এরপর আরএনএ পাওয়া গেল কি না, তা পরিমাপ করা হয়। দুই পদ্ধতিতে পরিমাপ করা যায়- ন্যানোড্রপ ও জেল ইলেক্ট্রোফরেসিসের মাধ্যমে। পর্যাপ্ত আরএনএ (২০০-৫০০ ন্যানোগ্রাম) পেলে তা সংরক্ষণ করতে হবে মাইনাস ৮০ ডিগ্রিতে। এভাবে ১টি স্যাম্পল বা ১০টি স্যাম্পল একজন করলে তার প্রায় ২ থেকে ৩ ঘণ্টা সময় লাগতে পারে। এর বেশি স্যাম্পল একজন নিলে তিনি মনোযোগ হারাতে পারেন। এ অবস্থায় একটার সঙ্গে আর একটার মিশ্রণে গোলমাল হতে পারে। যদি মাইনাস ৮০ ডিগ্রি ফ্রিজার না থাকে, তাহলে অতি দ্রম্নত আরএনএ-কে সিডিএনএ রূপান্তর করতে হয়। এটাকে রিভার্স ট্রান্সক্রিপটেস (আরটি) বলে। এর জন্য আলাদা কিট আছে। সেই কিটের প্রোটকল অনুযায়ী সিডিএনএ করতে হয়। উলেস্নখ্য, আরএনএ ইক্সট্রাকশন এতটাই স্পর্শকাতর বিষয় যে, এখানে নিশ্বাস বা খালি হাতের ছোঁয়া লাগলে কিংবা তাপমাত্রা রক্ষা না হলে আরএনএ নষ্ট হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ফলস নেগেটিভ রেজাল্ট আসবে।

৪. আরএনএ থেকে সিডিএনএ রূপান্তর : এই স্টেপটিও বেশ ক্রিটিক্যাল। এখানে সব স্যাম্পলের আরএনএর-এর ঘনমাত্রা অবশ্যই সমান হতে হবে। ধরা যাক, ৯৬টি স্যাম্পলের আরএনএ আছে। সে ক্ষেত্রে ৯৬টি আরএনএর ঘনমাত্রা কিন্তু এক রকম থাকবে না। স্যাম্পল ভেদে ঘনমাত্রা ১০০-১০০০ ন্যানোগ্রাম হতে পারে। এখন সিডিএনএ করতে হলে ৯৬টি পিসিআর টিউব নিতে হবে। প্রত্যেকটি টিউবে হিসাব করে সমপরিমাণ আরএনএ নিতে হবে।

ধরা যাক প্রত্যেকটিতে ২৫০ ন্যানোগ্রাম আরএনএ নিতে হবে, তখন ঘনমাত্রা ভেদে কোনো আরএনএ ১ মাইক্রোলিটার, কোনোটা আবার ০.৫ মাইক্রোলিটার হবে। একটু অনুমান করলেই বোঝা যায় যে ৯৬টি স্যাম্পলের আরএনএ নিতে কত সময় লাগে। এ সময় কোনো ধরনের ভুল হলে ফলাফল ফলস নেগেটিভ আসবে।

এরপর আরটি কিট দিয়ে প্রটোকল অনুযায়ী আরএনএ থেকে সিডিএনএ করতে হবে, এক্ষেত্রে সাধারণ পিসিআর-এর প্রয়োজন হয়। সময় লাগে ৩০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা। যখন সিডিএনএ হয়ে যায়, সেটা আবার পরিমাপ করতে হয় ন্যানোড্রপ অথবা জেল ইলেক্ট্রোফরেসিসের মাধ্যমে। ঘনমাত্রা যদি সব স্যাম্পলের সমান হয়, তাহলে কিউআরটি-পিসিআর রান করতে সহজ হয়।

৫. আরটি-পিসিআর বা কিউআরটি-পিসিআর-এর জন্য স্যাম্পল প্রস্তুত : আগের পদক্ষেপগুলো যেমন ক্রিটিক্যাল ও সেনসিটিভ এই স্টেপগুলোও ঠিক একই রকম। কিউআরটি-পিসিআর রান করার জন্য এক ধরনের রিয়েজেন্ট বা ডাই (রং) আছে। এ স্টেপে কয়েকটি মিশ্রণ পরিমাণমতো পিসিআর টিউবে মিশ্রিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো মিশ্রণ বাদ পড়লে বা পরিমিত না হলে ফলস নেগেটিভ রেজাল্ট আসবে।

৬. কিউআরটি-পিসিআর রান : এই স্টেপে মিশ্রিত স্যাম্পলসহ টিউবগুলো আরটি-পিসিআরএ বসিয়ে দিয়ে কম্পিউটারের মাধ্যমে প্রোগ্রাম সেট করতে হয়। আরটি-পিসিআর সম্পূর্ণ হতে পৌনে এক ঘণ্টা থেকে দুই ঘণ্টা লাগতে পারে। আরটি-পিসিআর রান সম্পূর্ণ হলে কম্পিউটারে দেখা যাবে রেজাল্ট পজিটিভ অথবা নেগেটিভ। যেসব স্যাম্পল 'এস' শেপ কার্ভ থাকবে, সেগুলো পজিটিভ রেজাল্ট। যেগুলোতে তা থাকবে না সেগুলো নেগেটিভ। তাছাড়া কম্পিউটারে সিটি এর মান থাকে। যে স্যাম্পলের সিটি ভ্যালু বেশি, তার ভাইরাস বেশি অথবা আরএনএ বেশি ছিল। এ ক্ষেত্রে ভুলভ্রান্তিতে ফলস নেগেটিভ ফল আসার সম্ভাবনা রয়েছে।