Loading..

শিক্ষায় অগ্রযাত্রা

২৯ মে, ২০২০ ০৭:৩৮ পূর্বাহ্ণ

শিক্ষক প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ।

আসলে দার্শনিকদের কাজ-কারবারই অন্যরকম। উল্টোভাবে বলা যায়, এ রকম কাজ-কারবার করেন বলেই তারা দার্শনিক। বিখ্যাত দার্শনিক প্লেটো মানুষের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বললেন-

মানুষ হচ্ছে পালকবিহীন দ্বিপদ একটি প্রাণী। এ সংজ্ঞা শোনার পর দার্শনিক ডায়োজেনিস একটি মুরগি জবাই করে সব পালক ফেলে দিয়ে প্লেটোর কাছে পাঠালেন। সঙ্গে একটি কাগজে লিখলেন-

এটাই তোমার সংজ্ঞায়িত মানুষ?

মানুষ হয়ে জন্ম নেয়ার এটাই দারুণ ব্যাপার যে, মানুষকে পুনরায় মানুষ হতে হয়। অন্য প্রজাতির কাউকেই কিন্তু তা হতে হয় না। প্রজাপতি হলেই প্রজাপতি, পাখি হলেই পাখি; কিন্তু মানুষ হলেই মানুষ নয়। মানুষ হওয়ার জন্য চেষ্টা করতে হয়। আর মানুষ হওয়ার প্রক্রিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিদ্যা অর্জন। অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই গরিব দেশগুলোর আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে তা সবার জন্য সম্ভব হয় না। তবে বিদ্যা অর্জনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার বাছাই চরিত্র হলেন বিদ্যা যিনি দেন, আর যিনি সেটি গ্রহণ করেন। রবীন্দ্রনাথ কী বলেছেন একটু দেখি-

বিদ্যা যে দেবে এবং বিদ্যা যে নেবে, তাদের উভয়ের মাঝখানে যে সেতু সেই সেতুটি হচ্ছে ভক্তিস্নেহের সম্বন্ধ। সেই আত্মীয়তার সম্বন্ধ না থেকে যদি কেবল শুষ্ক কর্তব্য বা ব্যবসায়ের সম্বন্ধই থাকে, তা হলে যারা পায় তারা হতভাগ্য, যারা দেয় তারাও হতভাগ্য। (বিশ্বভারতী)

দেশের সম্মানিত শিক্ষকদের উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অথচ সে সম্পর্কে শিক্ষা আইনে কতটা কী বলা হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। শিক্ষক প্রশিক্ষণকে আমাদের দেশে পেশাগত উন্নয়নের জন্য অতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে না বোধহয়! যদিও বিষয়টি ফলপ্রসূ শিক্ষাদান ও সৃজনশীল নাগরিক হিসেবে শিক্ষার্থীদের তৈরি করার একটি অন্যতম প্রয়োজনীয় বিষয়। প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ ছাড়া ভালোভাবে অনেক কিছুই হয় না। আমার জন্ম বি-বাড়িয়া জেলার প্রত্যন্ত গ্রামে। এক সময় সেখানে বিদ্যুতের আলো জ্বলত না। রাত নামলে হারিকেন বা কুপিবাতি জ্বালাতে হতো। ছোটবেলায় দেখেছি, সন্ধ্যায় যে হারিকেনটি জ্বালানো হবে, সেটি আমার মা দুপুরবেলা বা বিকালবেলা ঠিক করে রাখতেন। দেখতেন- তেল ঠিক আছে কিনা, সলতে ঠিক আছে কিনা, চিমনি ঠিকঠাক আছে কিনা। বস্তুত এ ধরনের প্রস্তুতির কারণেই সন্ধ্যে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্থাৎ সঠিক সময়ে তিনি সেটি জ্বালতে পারতেন। প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণবিহীন একজন শিক্ষক কতটা ফলপ্রসূ ও আধুনিক শিক্ষাদান করবেন, সে সম্পর্কে বোধকরি এ যুগের কোনো সচেতন ব্যক্তি কোনো প্রশ্ন তুলবেন না। প্রস্তুতি না থাকলে সঠিক সময়ে আলো জ্বলবে না, এটাই স্বাভাবিক।

একটা সময় ছিল, যখন এ দেশের শিক্ষকরা ছিলেন অনেক বেশি নিবেদিতপ্রাণ। এখন যুগ পাল্টেছে। শিক্ষা নিয়ে দেশে-বিদেশে বহু গবেষণা হচ্ছে, গবেষণার ফলাফল শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। এগুলো শিক্ষকদের সঙ্গে শেয়ার করা হয় প্রশিক্ষণে। শ্রেণিকক্ষে এগুলো চর্চার মাধ্যমে আধুনিক শিক্ষাদান নিশ্চিত করা সম্ভব। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জানা যায়, কোন ধরনের শিক্ষার্থীর সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হবে। কোন ধরনের পরিবেশে কিভাবে শিক্ষাদান করতে হবে। প্রশিক্ষণ ছাড়া যেমন কোনো গাড়ি চালানো যায় না, কোনো অস্ত্র বা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা যায় না, তেমনি শিক্ষকতার মতো কঠিন কাজটিও ভালোভাবে করা যায় না। কিভাবে ভাষাশিক্ষার একটি ক্লাস ফপ্রলপ্রসূ হবে, কিভাবে আনন্দদায়ক হবে একটি শ্রেণীকক্ষ, কিভাবে স্বল্পব্যয়ে বিজ্ঞান শিক্ষার উপকরণ ব্যবহার করা যায়, কিভাবে শিক্ষার্থীদের গণিত ভীতি ও পরীক্ষা ভীতি দূর করা যায়, ইত্যাদি বিষয় প্রশ্রিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকরা জানতে পারেন। অথচ দুঃখজনক হল, শিক্ষক প্রশিক্ষণ শিক্ষকদের প্রকৃত পেশাগত উন্নয়নের জন্য একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে ধরা হয় না।

সরকারের কোনো প্রজেক্ট কিংবা বেসরকারি কোনো সংস্থা যদি শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণের আয়োজন করে, তাহলে শিক্ষকরা সেখানে আসেন। প্রশিক্ষণ থেকে তারা কিছু অর্থনৈতিক সুবিধা পান। এটিই হচ্ছে নিয়ম। শিক্ষকরা কিছু পাবেন, এটা অবশ্যই আমরা আশা করি। কিন্তু একটু গভীরে গিয়ে দেখলে দেখা যাবে, প্রকৃত পেশাগত উন্নয়নের জন্য এসব প্রশিক্ষণে আসা শিক্ষকদের সংখ্যা হাতেগোনা দু’একজন হবে। সকল শিক্ষককে প্রশিক্ষনের আওতায় আনতে হবে। আশার কথা, আমাদের শিক্ষকরা এখন দেশের পরিবর্তিত অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে আগের চেয়ে অনেকটা ভালো অবস্থায় আছেন। কাজেই তাদের পক্ষে প্রয়োজনে নিজ দায়িত্বে প্রশিক্ষণ নেয়া সম্ভব। আমার প্রস্তাব হচ্ছে, শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিষয়টি শিক্ষা আইনে সুন্দরভাবে যুক্ত করা হোক। মনে রাখতে হবে, প্রশিক্ষণ মানে শুধু অর্থনৈতিকভাবে কিছু সুবিধা পাওয়ার বিষয় নয়।

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি