Loading..

ম্যাগাজিন

২২ জুন, ২০২০ ০৪:২৬ অপরাহ্ণ

বাবা মার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত হয়ত অনাকাঙ্খিত অনেক মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে দিবে অনেক অয়নকে।

      অনুভবের সীমানা পেরিয়ে


           ইশরাত জাহান


                   অনুভবের সীমানা পেরিয়েও অদিতি তোর কাছে পৌঁছতে পারি আামি, জানিস তুই! তোকে স্পর্শ করতে আমার তোকে লাগে না অদিতি, আমি চোখ বন্ধ করে তোর মুখ স্পর্শ করতে পারি, তোর শরীরের গন্ধে তোকে চিনে নিতে পারি। তোর কাছে না হয় আমার ভালোবাসা তুচ্ছ ছিলো,কিন্তু আমিতো তোকে মন প্রাণ দিয়েই ভালোবেসেছি। সেখানেতো কোন মিথ্যে ছিলো না অদিতি! কেনো তুই আমার সাথে এমন করলি!  আমার জীবনটা কী তোর কাছে খেলনা ছিলো! দেখ আমার জীবনটাকে তোর জন্য আজ খেলনা বানিয়ে ফেললাম, তুই খুশি হয়েছিস অদিতি! জানিস মা বাবা আমাকে বিয়ে করতে বার বার চাপ দিচ্ছে, কিন্তু তোর জায়গাটা মরে গেলেও যে আমি কাওকে দিতে পারবো না। আমার ভালোবাসা, আমার হৃদয়ের উষ্ণতা শুধু তোর। কী করে বুঝাই মা বাবাকে, আমি আর কাওকে ভালোবেসে স্পর্শ করতে পারবো না।কেনো ফেলে রেখে চলে গেলি আমায় অদিতি! কেনো! কী অপরাধ ছিলো আমার! তোকে খুব ভালোবেসেছি, এটাইতো আমার অপরাধ! ঠিক আছে তোর দেওয়া শাস্তি মাথায় নিয়ে আমি এ পৃথিবী থেকে চললুম! এমনই লেখা ছিলো অয়নের ডায়েরীতে!   অনেকগুলো কীটনাশক খেয়েও সেদিন অয়নের মৃত্যু হয়নি, জমে মানুষে টানাটানি করে ৩ দিনের মাথায় জ্ঞান ফিরে অয়নের। বোবা আর ফ্যালফ্যাল করে সে চারিদিকে তাকিয়ে কাকে যেনো খুঁজে! অয়নের বসবাস এখন পাগলা গারদে।


                     সবাই বাস্তবতাকে মেনে নিতে পারে না। কারও কারও জীবনে শুধু একজন ভালোবাসার মানুষই থাকে। তাকে ঘিরেই তার জীবন আববর্তিত হতে থাকে। জীবন থেকে যখন সে মানুষটি চলে যায় তখন তার বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই আর থাকে না। থাকে না তার সময়জ্ঞান, থাকে না তার দিন রাত্রি। কখনও কখনও ঘুমের ঔষধ হয় বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল।কেও কেও নেশাও করে। অথচ অদিতির কোনও অধিকার ছিলো না অয়নের জীবনটা নষ্ট করার! এর দায় কী অদিতির নয়!অসহায় মা বাবা এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না।


                  অয়ন আজও খুঁজে ফিরে তার অদিতিকে। কখনও কখনও অয়নকে সামলাতে না পেরে ডাক্তার থেরাপি দেন। ভালোবাসার আদরের বদলে ইলেকট্রিক শকের আদরে কাটছে অয়নের জীবন। হায় ভালোবাসা!প্রায়ই অসহায় আর বোবা কান্না নিয়ে অয়নের মা বাবা তাকে দেখতে আসে। আজ কতদিন হলো প্রাণপ্রিয় ছেলে তাকে মা বলে জড়িয়ে ধরে না, বাবার কাছে কোনও কিছু কেনার বায়না করে না।প্রতিদিন সকালে ছেলের মা বাবাকে নাস্তার টেবিলে চাই-ই চাই।মা -বাবাকে একটু হলেও নাস্তা খাইয়ে তবেই মা বাবার মুক্তি! আজ কত দিন ছেলে বাড়িতে নেই,খাবার টেবিলে তাই মা বাবার এখন আর নাস্তা খাওয়া হয় না।শূণ্য টেবিলটা শূণ্য কোল হয়ে করুণ চোখে যেনও ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে! ছেলের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মা চোখের নোনা জল মোছে, আর বাবা তীব্র কষ্টে নীল হয়ে যেতে যেতে চোখ মুখ শক্ত করে বসে থাকে।আর অয়ন কাওকে আজ চেনে না,শুধু উদভ্রান্তর মতো কাওকে পাগলের মতো খুঁজে চলে, আপন মনে কথা বলে আর কখনওবা ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠে। একমাত্র সন্তানের দুর্দশা বাবা মা আর দুচোখে সহ্য করতে পারছিলেন না! কবে আবার সুস্হ অবস্হায় কাছে ফিরে পাবেন তাদের সন্তানকে।


               

                            ডক্টর এলে চিন্তিত মুখে বাবা জিজ্ঞেস করেন,  ছেলে সুস্হ হবেতো! ডক্টর কোনও জবাব দিলেন না, কারন সুস্হতা সময় সাপেক্ষ। আদৌ সুস্হ হবে কি- না সন্দেহ!মানুষের ব্রেন দুটি বলয়ের সমষ্টি। এ বলয় দুটো আড়াআড়ি ভাবে সংযুক্ত থাকায় ডান বলয় নিয়ন্ত্রণ করে বাম অংশকে আর বাম বলয় নিয়ন্ত্রণ করে ডান অংশকে।বাম বলয় নিয়ন্ত্রণ করে কথা, শ্রতি,অংক,যুক্তি,ভাষা,  ক্ষুধা, ও বৈষয়িক ভাবনা আর ডান বলয় নিয়ন্ত্রণ করে কল্পনা,আবেগ, বিশ্বাস,ঘুম,স্বপ্ন,সংগীত,সৃজনশীলতা ইত্যাদি।সাধারণত দুই বলয় যুক্ত থাকে কর্পাস কলোসাম নামে স্নায়ুতন্ত্রের গোছা দ্বারা।যদি কোনও কারনে এই সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয় তখন দুটি বলয় স্বাধীনভাবে তাদের কাজ শুরু করে। মানুষের বোধ বুদ্ধি লোপ পায়। মানুষ মানুষিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। ডক্টরের কথা শুনে জোরে অয়নের মা কাঁদতে থাকে। অয়নের বাবা দীর্ঘনিশ্বাস চেপে অয়নের মাকে সামলাতে সামলাতে রিক্ত মনে বাড়ী ফেরে।


             এভাবেই দিন কাটতে থাকে। হঠাৎ ডক্টর একদিন অয়নের বাবা মাকে খবর দেয়। তারা ছুটতে ছুটতে অয়নকে দেখতে আসে। কিন্তু নিজের ছেলেকে দেখে নিজেই থমকে দাঁড়ান বাবা। এ কাকে দেখছে? জায়গায় জায়গায় কেটে রক্ত জমাট বেঁধে আছে! নতুন আর পুরাতন অনেক ক্ষত! আজকাল প্রায়ই খুব অস্হির আচরণ করতে থাকে অয়ন। নিজেকে নিজেই শেষ করে দিতে উদ্যত হয়। তবে আশ্চর্যের বিষয় অয়ন অন্য কারও গায়ে একটা আঁচড়ও দেয় না। অন্যদের মতো দা বা হাতের কাছে যা পায় তাই দিয়ে মারতে আসে না। ডক্টর বললেন,যেভাবে পারেন অদিতিকে খুঁজে বের করেন। তা না হলে অয়নকে সুস্হ করে তোলাতো দূরের কথা, বাঁচানোই সম্ভব হবে না। 


                       বড় চিন্তিত মনে বাবা মা ডক্টরের চেম্বার থেকে বের হয়ে আসে।সন্তানের চিন্তায় ২ বছরে তাদের বয়স বহু বছর বেড়ে গেছে।কোথায় খুঁজবে ওরা অদিতিকে।কিছুইতো জানে না তেমন অদিতির বিষয়ে।যদি মেয়েটার বিয়ে হয়ে গিয়ে থাকে, ও কী আসবে অয়নের কাছে? বা আসেও যদি তাতে খুব বেশী কী লাভ হবে! ভালো যদি হয়েও যায় অয়ন তবে অদিতি তখনও ছেলের পাশে থাকবে???তবুও ছেলের জীবন সবার আগে! অদিতিকে খুঁজতে হবে! অয়নের বন্ধুদের কাছে কিছু জানা যায় কী-না সে চেষ্টা অয়নের মা বাবা প্রথমে করল কিন্তু কোনও লাভ হলো না।অয়ন বরাবরই চাপা স্বভাবের! অদিতির খোঁজ পেতে ব্যর্থ হলো অয়নের মা বাবা।অয়নের মা বাবা যদি অয়নের আজ বন্ধু হতো, তাহলে হয়তো আজ মা বাবা অয়নের সবকিছু জানত। ছেলের সাথে কেনও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল না- এটা নিয়ে অয়নের মা বাবা দুজন দুজনকে দোষ দিতে লাগল।অয়নের মা বাবা দুজনেই বুঝতে পারলো তাদের সন্তানের খোঁজ খবর রাখা তাদের দায়িত্ব ছিল।


                       কী করবে কোনও কূল কিনারা পাচ্ছিলেন না অয়নের মা বাবা! একমাত্র সন্তানের স্মৃতি পুরো ঘর জুড়ে! ছেলেটা নিজ হাতে টবে গোলাপ গাছ লাগিয়েছে,খুব যত্ন করতো গাছগুলোর।কলি আসা থেকে ফুল ফোটা পর্যন্ত একেকটা মুহূর্ত ও একেকভাবে বর্ণনা করতো! নিজের সন্তানের স্পর্শ আছে ভেবে গাছগুলোকে পরম আদরে হাত বুলাতে থাকেন অয়নের মা আর চোখে নেমে আসে সমুদ্রের বাঁধ ভাঙা জল!এরকম আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে এলো সেই টেলিফোন। টেলিফোনটা তুলতেই ঝন ঝন শব্দে টেলিফোনটা হাত থেকে পরে গেলো বাবার আর চিৎকার করে অয়নের মাকে ডেকে বলল, ছেলে চিরদিনের মতো মুক্তি দিয়ে আমাদের চলে গেছে!


                       এভাবে কতো অয়ন আজও খু্ঁজে ফিরে অদিতিকে। বুকের কষ্টে নীল হতে হতে অভিমান ভরা হৃদয়ে মনে মনে বলে আমি মরে গেলেইবা তোমার কী!! আর মুখে বলে, তোমায় ছাড়া আমিতো বেশ আছি।অয়নের মা বাবার কী অপরাধ ছিল! সন্তান হিসেবে এত বড় শাস্তি দেওয়া কী মা বাবাকে অয়নের উচিত হলো?একটা মেয়ে জীবনের সব হয়ে গেল! আর মা বাবা! জন্ম থেকে শুরু করে প্রতিমুহূর্তে যাঁরা বড় করল তাঁদের ভালোবাসা একটা মেয়ের ভালোবাসার কাছে মিথ্যা হয়ে গেল! এরকম অসহায় না পাওয়া অনেক প্রশ্নের উত্তর অয়নের নির্বাক ছবির দিকে তাকিয়ে আজও খুঁজে চলেন অয়নের মা বাবা!


ইশরাত জাহান

সহকারী শিক্ষক

বাংলাবাজার সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়,ঢাকা।


আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি