Loading..

খবর-দার

০৭ জুলাই, ২০২০ ০৭:২৭ পূর্বাহ্ণ

আমি একজন কণ্ঠশ্রমিক: এন্ড্রু কিশোর

কবির বকুল


অনেক জনপ্রিয় গানের শিল্পী তিনি। অথচ নিজেকে একজন কণ্ঠশ্রমিক মনে করেন তিনি। শুধু তা–ই না, তিনি বলেছেন, কথা কিংবা সুরের ওপর তাঁর এতটা জ্ঞান নেই। জ্ঞান শুধু গায়কীতে। তাই তিনি গীতিকার কিংবা সুরকারের ব্যাপারে মাথা ঘামাতেন না। কথা হলো তাঁর সঙ্গে।

এন্ড্রু কিশোর। ছবি: প্রথম আলোচারদিকে এখন নববর্ষের আমেজ, আপনার কাছে জানতে চাই বাংলা সংস্কৃতি নিয়ে আপনার ভাবনা।

আমি একজন কণ্ঠশ্রমিক। বৃহত্তর কোনো বিষয় নিয়ে ভাবনা কিংবা আশা করার কাজ আমার নয়। তবে একজন শিল্পী হিসেবে কিছু ভাবনা তো অবশ্যই আছে। শুধু এই মুহূর্তে বলতে চাই, আমরা যেন আগামী প্রজন্মের কাছে বাংলা সংস্কৃতিকে নিরাপদভাবে পৌঁছাতে পারি।

নতুন বছর এলেই বাংলা সংস্কৃতি কিংবা এর অনুষঙ্গ অন্য বিষয়গুলো নিয়ে সবাই মেতে ওঠে। সবকিছুতেই একটা বাঙালিয়ানা ভাব। কিন্তু এই মনোভাবটা আমরা বেশি দূর টেনে নিয়ে যেতে পারি না কেন?

এটা তো আমরা প্রবাদ বাক্যে পাই, ‘হুজুগে বাঙালি’। স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে শুরু করে সবকিছুতেই আমরা দেখেছি, শুরুর দিকটা খুবই ভালো। কিন্তু এর পরবর্তী পর্যায়ে আমরা সেই ভালোটা ধরে রাখতে পারিনি। একুশের মাসের কথা বলি। একুশের মাসের যে উদ্দাম, সেটা যদি সারা বছর ধরে রাখা যায়, তাহলে আমাদের মনোভাব অনেক পাল্টে যেত। যদিও ব্যাপারটা খুব কঠিন।

আপনি নিজেকে একজন কণ্ঠশ্রমিক হিসেবে দাবি করেন। শ্রমিক তো তার শ্রম দিয়ে ফসল ফলানোর চেষ্টা করে। এখন কথা হলো সেই ফসলটাকে সঠিকভাবে আমরা ঘরে তুলতে পারছি কি?

অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিক শুধু ফসলই ফলায়। লগ্নি করে না। লগ্নি করেন অন্য কেউ।

অডিও শিল্পে আপনার গ্রহণযোগ্যতা আছে, সবাই আপনার আলাদা মূল্যায়ন করে। দেখা গেছে, যেকোনো সংকট মুহূর্তে আপনার পরামর্শ বা সহযোগিতা চায় সবাই।
আমি জীবনকে সব সময় কাছ থেকে দেখার চেষ্টা করি। জীবনের সুখ, শান্তি সূক্ষ ভাবে দেখার চেষ্টা করি। এ কারণে হয়তো আমার ওপর অনেকের বিশেষ আস্থা তৈরি হয়েছে। তা ছাড়া বয়সও তো কিছুটা বেড়েছে। একসময় যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে আমরা সবাই হাদী (সৈয়দ আবদুল হাদী) ভাইয়ের মুখাপেক্ষী থাকতাম।

এখন সেই দায়িত্বটা অনেকটা আপনার ওপর পড়েছে।
আমি কিন্তু দায়িত্ব নিতে চাই না। কারণ দায়িত্ব নিলে জীবন অন্যরকম হয়ে যায়। জীবনটাকে খুব কাছে থেকে দেখি। খুব ক্ষুদ্র আকারে চিন্তা করি। বউ, বাচ্চা আর ঘরেই সীমাবদ্ধ আমার চিন্তা। আমাকে এ ব্যাপারে স্বার্থপর বলা যায়। আমি আমাতেই সুখী।

সংসারের কথা বললেন। সেখানেও কি সব বিষয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হয়?
না। সবই আমার স্ত্রী দেখে। আমার কোনোকিছু নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। আমি শুধু চিন্তা করি ক্যারিয়ার নিয়ে।

অনেকেই বলেন, এই প্রজন্মের শিল্পীর মধ্যে সময়জ্ঞান কিংবা পেশাদারিত্ব মনোভাব নেই।
আসলে সারা দেশেই এমনটি হচ্ছে। অস্থির সময় কাটছে। রাস্তাঘাটে বেরোলে বোঝা যায় না কতক্ষণে গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে।

অন্য শিল্পীরা যেমন তার অ্যালবামের ব্যাপারে খুবই সচেতন, সেটা গানের কথা, সুর কম্পোজিশন সবকিছুতেই। আপনার ক্ষেত্রে এটা দেখি না।
আসলে আমি নিজেকে এত জ্ঞানী মনে করি না। কথা কিংবা সুরের ওপর আমার এতটা জ্ঞান নেই। আমার জ্ঞান শুধু গায়কীতে। তাই আমি গীতিকার কিংবা সুরকারের ব্যাপারে মাথা ঘামাই না। এটা পেশাদারিত্বের মধ্যেও পড়ে। আর আমি চাই, একটা অ্যালবামে সব ধরনের সুরকার বা গীতিকারের গান থাকা উচিত। তাহলে সব শ্রেণীর শ্রোতার কাছে পৌঁছানো যাবে। একটা ঘটনা বলি। রাজশাহীর একটা প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামে এক বন্ধুর বিয়ে খেতে গিয়েছিলাম। হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিলাম গ্রামের পথ ধরে। রাস্তায় একটা নেংটা ছেলে খেলছিল আর আমারই একটা গান গাইছিল। সত্যিকার অর্থে ওইদিনই শিল্পীজীবনের সার্থকতা পেয়েছিলাম।

জীবনে অনেক গানই গেয়েছেন। এমন কোনো গান কি আছে, যে গানটি গাইতে গিয়ে খুবই কষ্ট হয়েছিল?
একটা গানের কথা বলতে পারি। তুমি যেখানে আমি সেখানে ‘নাগ পূর্ণিমা’ ছবির গান এটি। আলম খানের সুর, মনিরুজ্জামান মনিরের লেখা। ছবিটি সোহেল রানার। ফোক ফ্যান্টাসি ছবি হলেও তিনি চেয়েছিলেন একটা ব্যতিক্রমী গান করতে। উঁচু স্কেলের। তখন ছিল সরাসরি রেকর্ডিং। গানটি গাইতে গিয়ে আমার খুবই কষ্ট হচ্ছিল। মজিদ ভাই রেকর্ডিস্ট ছিলেন। তিনি বললেন, ‘আলম ভাই ওকে একটু বিশ্রাম দেন। ও তো মারা যাবে।’ আমিও মনে করেছিলাম, এটাই বুঝি আমার জীবনের শেষ গান। ৩০-৩২ বার টেক নেওয়ার পর ‘ওকে’ হলো। হলো আরেকটি অনবদ্য সৃষ্টি। পরে যেখানেই গিয়েছি, সেখানেই এ গানটি গাইতে হয়েছে।

কোন ধরনের গান এখনো গাইতে পারেননি?
রাগপ্রধান গান আমি খুব একটা করিনি। তবে তৃষ্ণা আছে দেশাত্মবোধক গান নিয়ে। আমার গাওয়া তেমন কোনো দেশাত্মবোধক গান নেই।

আপনার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট কী?
আমি ছোটবেলায় ক্লাসিক্যাল গাইতাম। একসময় ভারতে চলে যাই। ওই সময় আধুনিক গান কিংবা ছবির গানের প্রতি মন চলে গেল। দেশে ফিরে আবার শুরু করলাম। কিন্তু আমার ওস্তাদজি বুঝে গেলেন যে, আমার ক্লাসিক্যালের প্রতি মনোযোগ নেই। আমি আধুনিক গানে নিয়মিত হয়ে গেলাম। আমার প্রথম টার্নিং পয়েন্ট ছিল ক্লাসিক্যাল থেকে আধুনিক গানে চলে আসা। আরেকটা টার্নিং পয়েন্ট ছিল আরডি বর্মণের কাছে যাওয়া, উনি যে আমাকে কী স্নেহ করতেন বলে বোঝাতে পারব না, এটা ছিল আমার জীবনের স্মরণীয় একটি অধ্যায়।

অডিও বাজারে আসার কথা বলবেন?
প্লেব্যাকে ভীষণ ব্যস্ত হলেও আমি খুব ভয়ে ভয়ে অডিও বাজারে এসেছিলাম। তখন তপন, বিশ্বজিৎ, শুভ্রর জোয়ার। ওদের মাঝে শ্রোতারা আমাকে গ্রহণ করবে কি না। এ রকম একটা সংশয় ছিল। তাই অডিওতে নিয়মিত হইনি। দীর্ঘদিন পর ‘ফিরে ফিরে আসি’ অ্যালবাম নিয়ে অডিওতে এলাম। শ্রোতারাও আমাকে আস্তে আস্তে গ্রহণ করল।

আপনাকে অনেক আনাড়ি শিল্পীর সঙ্গেও গাইতে দেখা যায়। এটা কি পেশাদার শিল্পী হওয়ার কারণে?
হয়তো তাই। তা ছাড়া আজ যে নতুন, কাল সে একটা অবস্থানে আসতেই পারে। আমি একসময় নতুন ছিলাম। রুনা আপা, সাবিনা আপা আমাকে সুযোগ দিলেন তাদের সহশিল্পী হিসেবে গাইতে।