Loading..

প্রকাশনা

০২ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০১:২৫ অপরাহ্ণ

প্রণব মুখোপাধ্যায়

প্রণব কুমার মুখোপাধ্যায় (১১ ডিসেম্বর ১৯৩৫ ৩১ আগস্ট ২০২০[][]) ভারতের ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতি (জুলাই, ২০১২- কার্যভার গ্রহণকারী) ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক কর্মজীবন ছয় দশকব্যাপী। তিনি ছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা। বিভিন্ন সময়ে ভারত সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছিলেন। ২০১২ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে প্রণব মুখোপাধ্যায় ছিলেন ভারতের অর্থমন্ত্রী কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় সমস্যা-সমাধানকারী নেতা।

১৯৬৯ সালে তদনীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাহায্যে প্রণব মুখোপাধ্যায় ভারতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় কংগ্রেসের টিকিটে নির্বাচিত হন। এরপর রাজনৈতিক কর্মজীবনে তার দ্রুত উত্থান শুরু হয়। তিনি ইন্দিরা গান্ধীর একজন বিশ্বস্ত সহকর্মীতে পরিণত হন এবং ১৯৭৩ সালে ইন্দিরা গান্ধীর ক্যাবিনেট মন্ত্রিসভায় স্থান পান। ১৯৮২-৮৪ পর্বে তিনি ছিলেন ভারতের অর্থমন্ত্রী ১৯৮০ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত তিনি রাজ্যসভার দলনেতাও ছিলেন।

প্রণব মুখোপাধ্যায় বিভিন্ন সময়ে ভারতের বিদেশ, প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ, রাজস্ব ইত্যাদি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের দায়িত্ব পালনের বিরল কৃতিত্বের অধিকারী। ভারত-মার্কিন অসামরিক পরমাণু চুক্তি সাক্ষরের মতো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য। দলের প্রতি আনুগত্য অসামান্য প্রজ্ঞা এই বাঙালি রাজনীতিবিদকে কংগ্রেস দলে এমনকি দলের বাইরেও বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র করেছে। দেশের প্রতি অবদানের জন্য তাকে ভারতের সর্বোচ্চ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্ন  পদ্মবিভূষণ এবং শ্রেষ্ঠ সাংসদ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। ১৯৮৪ সালে, যুক্তরাজ্যের ইউরোমানি পত্রিকার একটি সমীক্ষায় তিনি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পাঁচ অর্থমন্ত্রীর অন্যতম হিসেবে বিবেচিত হন।

প্রণব মুখোপাধ্যায়ের জন্ম অধুনা পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার কীর্ণাহার শহরের নিকটস্থ মিরাটি গ্রামে। তার পিতার নাম কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায় মাতার নাম রাজলক্ষ্মী দেবী। বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী কামদাকিঙ্কর ১৯২০ সাল থেকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ব্রিটিশ শাসনকালে তিনি দশ বছর কারারুদ্ধ ছিলেন। পরে কামদাকিঙ্কর অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি এবং পশ্চিমবঙ্গ বিধান পরিষদের সদস্য (১৯৫২-৬৪) হন; তিনি বীরভূম জেলা কংগ্রেস কমিটির সভাপতির পদও অলংকৃত করেন।[] প্রণব মুখোপাধ্যায় সিউড়িরবিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র ছিলেন; এই কলেজটি সেই সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল।

প্রণব মুখোপাধ্যায় একজন কলেজশিক্ষক রূপে তার কর্মজীবন শুরু করেন। পরে তিনি সাংবাদিকের কাজও করেন কিছুকাল। এই সময় তিনি দেশের ডাক নামে একটি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এছাড়াও তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ট্রাস্টি পরে নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতিও হন।[] মাননীয় প্রণব মুখোপাধ্যায় কর্মজীবনে প্রথম দিকে হাওড়া জেলার বাঁকড়ায় অবস্থিত "বাঁকড়া ইসলামিয়া হাইস্কুল" বছর শিক্ষকতা করেছেন। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার আমতলার নিকটস্থ বিদ্যানগর কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন।[]

প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রায় পাঁচ দশক ভারতীয় সংসদের সদস্য। ১৯৬৯ সালে তিনি প্রথম বার কংগ্রেস দলের প্রতিনিধিস্বরূপ রাজ্যসভায় নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৭৫, ১৯৮১, ১৯৯৩ ১৯৯৯ সালেও তিনি রাজ্যসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে কেন্দ্রীয় শিল্পোন্নয়ন উপমন্ত্রী হিসেবে তিনি প্রথম ক্যাবিনেটে যোগদান করেন।

ক্যাবিনেটে ক্রমান্বয়ে পদোন্নতির পর ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালে ইউরোমানি পত্রিকার একটি সমীক্ষায় তাকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পাঁচ অর্থমন্ত্রীর মধ্যে অন্যতমের শিরোপা দেওয়া হয়।[][][] তার মন্ত্রীত্বকালের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল ভারতের আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের ঋণের শেষ কিস্তির . বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ না তোলা। তার এই মন্ত্রীত্বকালে . মনমোহন সিংহ ছিলেন ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর। ইন্দিরা হত্যার অব্যবহিত পরে একটি দলীয় গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব্ব্বের শিকার হন প্রণব মুখোপাধ্যায়। এই সময় রাজীব গান্ধী তাকে নিজের ক্যাবিনেটে স্থান দেননি কিছুকালের জন্য তাকে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছিল। এই সময় তিনি রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস নামে নিজস্ব একটি দলও গঠন করেছিলেন। তবে ১৯৮৯ সালে রাজীব গান্ধীর সঙ্গে মিটমাট করে নেওয়ার পর এই দল নিয়ে তিনি আবার কংগ্রেসে যোগ দেন।[] পরবর্তীকালে পি. ভি. নরসিমা রাও তাকে পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান নিযুক্ত করলে তার রাজনৈতিক কর্মজীবনের পুনরুজ্জীবন ঘটে। রাওয়ের মন্ত্রিসভায় পরে তিনি ক্যাবিনেট মন্ত্রীরূপেও যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৯৫-৯৬ সালে তিনি রাওয়ের মন্ত্রিসভায় বিদেশমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি শ্রেষ্ঠ সাংসদ পুরস্কারে ভূষিত হন।

প্রণব মুখোপাধ্যায় জাতীয় কংগ্রেসের পশ্চিমবঙ্গ শাখারও সভাপতি। ২০০৪ সালে, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত প্রগতিশীল জোট কেন্দ্রে সরকার গঠন করে। এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ রাজ্যসভার সদস্য হওয়ায়, প্রণব মুখোপাধ্যায়ের লোকসভায় কংগ্রেস দলনেতার দায়িত্ব পান। উল্লেখ্য, এই বছরই তিনি প্রথমবার জঙ্গীপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে লোকসভায় নির্বাচিত হন।

প্রণব মুখোপাধ্যায় বিভিন্ন সময়ে প্রতিরক্ষা, অর্থ, বিদেশ, রাজস্ব, জাহাজ-চলাচল, পরিবহন, যোগাযোগ এবং শিল্প বাণিজ্য মন্ত্রকের মতো একাধিক মন্ত্রকের দায়িত্ব গ্রহণের বিরল কৃতিত্বের অধিকারী। তিনি সারা দেশের কংগ্রেস সাংসদ বিধায়কদের নিয়ে গঠিত যথাক্রমে কংগ্রেস সংসদীয় দল কংগ্রেস বিধানসভা দলেরও প্রধান। পঞ্চদশ লোকসভা নির্বাচনের অব্যবহিত পূর্বে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের বাইপাস সার্জারির সময় তদনীন্তন বিদেশমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় রাজনীতি বিষয়ক ক্যাবিনেট কমিটির চেয়ারম্যান কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের অতিরিক্ত দায়িত্ব গ্রহণ করে ক্যাবিনেট পরিচালনায় বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেন।

২০০৮ সালের ১০ অক্টোবর প্রণব মুখোপাধ্যায়  ইউএস সেক্রেটারি অফ স্টেট কন্ডোলিজা রাইস সেকশন ১২৩ চুক্তি সই করেন। তিনি আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার, বিশ্ব ব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক  আফ্রিকান উন্নয়ন ব্যাংকের বোর্ড অফ গভর্নরসের সদস্য।

১৯৮৪ সালে প্রণব মুখোপাধ্যায় আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সংযুক্ত গ্রুপ অফ টোয়েন্টিফোরের সভাপতিত্ব করেন। ১৯৯৫ সালের মে থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত তিনি সার্ক মন্ত্রিপরিষদ সম্মেলনেও সভাপতিত্ব করেছিলেন।[১০]

এনডিএ প্রার্থী লোকসভার সাবেক স্পিকার মেঘালয়ের ভূমিপুত্র পিএন সাংমাকে ৭১ শতাংশের বেশি ভোটে হারিয়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে ইউপিএ প্রাথী প্রণব মুখার্জি নির্বাচিত হন। ২৫ জুলাই ২০১২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন তিনি। প্রণব পেয়েছেন পাঁচ লাখ ১৮ হাজার ৬৮৯টি ভোট, অন্যদিকে সাংমা পান দুই লাখ ৩২ হাজার ৫৫৮টি ভোট।

১৯৫৭ সালের ১৩ জুলাই প্রণব মুখোপাধ্যায় পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। শুভ্রা মুখার্জি বাংলাদেশের নড়াইল জেলার সদর উপজেলার ভদ্রবিলা গ্রামের মেয়ে।[১৬] তাদের দুই পুত্র এক কন্যা বর্তমান। তাঁর অবসরকালীন শখ বই পড়া, বাগান করা গান শোনা।[১৭]

প্রণব মুখোপাধ্যায় একাধিক সম্মান পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৮৪ সালে ইউরোমানি পত্রিকার সমীক্ষায় তাকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ অর্থমন্ত্রী বলা হয়েছিল।[১৮] ২০১০ সালে বিশ্ব ব্যাংক  আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের দৈনিক সংবাদপত্র এমার্জিং মার্কেটস তাকে '"ফাইনান্স মিনিস্টার অফ দ্য ইয়ার ফর এশিয়া" পুরস্কার দিয়েছিল।[১৯] ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে, দ্য ব্যাঙ্কার পত্রিকা তাকে "ফাইনান্স মিনিস্টার অফ দ্য ইয়াস" সম্মান দিয়েছিল।[২০] ভারত সরকার ২০০৮ সালে তাকে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান পদ্মবিভূষণ প্রদান করেছিল।[২১] ২০১১ সালে উলভারহ্যাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সাম্মানিক ডক্টর অফ লেটারস ডিগ্রি দেয়।[২২] ২০১২ সালের মার্চ মাসে অসম বিশ্ববিদ্যালয়  বিশ্বেশ্বরায়া প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সাম্মানিক ডি. লিট ডিগ্রি দেয়।[২৩][২৪]২০১৩ সালের মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সাম্মানিক ডক্টরেট অফ ডিগ্রি দেয়।[২৫] ২০১৩ সালের মার্চ তিনি বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার "বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা" পান।[২৬] ২০১৩ সালের ১৩ মার্চ মরিশাস বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডক্টর অফ সম্মান দেয়।[২৭] তিনি ২৫ জানুয়ারি ২০১৯ সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার ভারতরত্ন সম্মানে সম্মানিত হন।

অগস্ট ২০২০ রাতে নিজের দিল্লির বাড়িতে শৌচাগারে পড়ে গিয়েছিলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি। পর দিন সকাল থেকে তাঁর স্নায়ুঘটিত কিছু সমস্যা দেখা দেয়। বাঁ হাত নাড়াচাড়া করতে সমস্যা হচ্ছিল।[২৮] ১০ আগস্ট দিল্লীর সেনা হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি প্রণব মুখোপাধ্যায় হাসপাতালে তাঁর করোনা রিপোর্ট পজেটিভ আসে। এরপর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ এর কারণে ওনার ইমার্জেন্সী ব্রেন সার্জারি করা হয়। হাসপাতাল থেকে ওনাকে নিয়ে রোজই হেলথ বুলেটিন জারি করা হয়। আরেকদিকে, ওনার মৃত্যু নিয়ে প্রায়ই গুজব রটে। যদিও সমস্ত গুজবের জবাব দিয়েছিলেন প্রণব পুত্র এবং কন্যা। অবশেষে ৩১ আগস্ট ২০২০ তিনি জীবন যুদ্ধে হেরে যান। প্রণব পুত্র অভিজিৎ ওনার প্রয়াত হবার খবর টুইট করে দেশবাসীকে জানান।[২৯]

 

সংগৃহীত

 

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি