Loading..

প্রকাশনা

১২ ডিসেম্বর, ২০২০ ০৭:৪৩ অপরাহ্ণ

হয়তোবা ইতিহাসে নাম লেখা রবে না। এটি কোন কাল্পনিক গল্প নয়। আমার শহিদ মুক্তিযোদ্ধা জেঠুর কাহিনি। আমি গল্পের মতো লিখলাম।

হয়তোবা ইতিহাসে নাম লেখা রবে না

এটি কোন কাল্পনিক গল্প নয়।

আমার  শহিদ মুক্তিযোদ্ধা জেঠুর কাহিনি আমি গল্পের মতো লিখলাম।

  ************************************       

"আব্বা আমাদের একটা ডিকশনারি কিনতে হবে৷" ছেলে বলল তার বাবাকে৷

 বাবা বলল, আচ্ছা টাকা নিয়ে যাস৷ কিনে নিস৷"   

লালমতি বেগম, শুনতে পেয়েছিল বাবা - ছেলের কথা৷  

দিনটা ছিল ঊনসত্তরের কোন এক শুক্রবার৷

"ডিকশনারি! এটা কী জিনিস? লালমতি বেগমের মাথায় ঘুরতেছে৷ এটা কী!

"কাকে জিজ্ঞাস করা যায়? ছেলেকে জিজ্ঞাস করব? না থাক৷,লজ্জা লাগে৷ ছেলে বাবাকেই জিজ্ঞাস করি!

লালমতি, বেগমের স্বামী হাইস্কুলের শিক্ষক! সবাই ডাকে বিএন স্যার৷ লালমতি বেগমের  কখনও স্কুলে যাওয়ার সৌভাগ্ হয়নি৷ অক্ষর জ্ঞানও নেই৷ কিন্তু তার স্বামী শিক্ষিত৷

শিক্ষিত মানে সত্যিকারের শিক্ষিত৷  স্ত্রী কোন কিছু না পারলে কখনও অবজ্ঞা করেননি৷ বরং নিজ হতে বুঝিয়ে দিয়েছেন ৷ কোন কাজ না পারলে নিজেই করে দিয়েছেন৷

লালমতি বেগমের মনে পড়ল, শুধু মাত্র বংশ মর্যাদা দেখেই তাঁর শ্বাশুড়ী মিয়া বাড়ীর মেয়ে,  তাঁকে বউ করে ঘরে তুলেছেন৷ লালমতি বেগম ও তার মূল্য দিয়ে যাচ্ছেন ৷ শ্বশুর - শ্বাশুড়ি ,আত্মীয়- স্বজনের সেবায় নিজেকে ব্যস্ত রাখছেন৷  

একদিন লালমতি বেগমের স্বামী তাঁকে জামা ধুতে দিয়েছিল৷ বাড়িতে মেহমান আসায় খুব ব্যস্ত দিন কাটছিল৷ তাড়াহুড়া করে ধুয়েছে যে, কখন জামায় হলুদ লেগে গেল, খেয়ালই করেননি৷ তার স্বামী তাঁকে বকেননি৷ বরং এর পর থেকে প্রায়ই নিজের জামা নিজেই ধোয় ।

গ্রামের পুরুষদের মধ্যে কুসংস্কার , বাচ্চা হলে স্বামী কিংবা পুরুষরা আঁতুড়ে ঘরে যেতে পারবে না৷ রসুই ঘরে কিংবা গোয়াল ঘরে রাখা হয় প্রসূতি মা ও সন্তানকে৷ কিন্তু লালমতি বেগমের শিক্ষক স্বামী এসব কুসংস্কার মানতেন না৷ তিনি বলতেন, আরে এসব কোন কথা নয়! তিনি খোঁজ খবর নিতেন, পুষ্টিকর খাবারের তদারকি করতেন৷

বড় ঘরে রাখতেন৷ লালমতির শ্বশুর মশাই এজন্য রাগ হয় যেতেন৷ কিন্তু বাবাকে কিছু বলত না ছেলে৷ তর্কে ও করত না৷

তাই ঠিক করলেন লালমতি বেগম  ছেলের বাবাকেই জিজ্ঞাস করবেন,  ডিকশনারি কী?

গৃহিনী লালমতি বেগম আর শিক্ষক সৈয়দ আহমদের তিন ছেলে চার মেয়ের ৷ এক মেয়ের পর,  তিন ছেলে ৷  তারপর তিন মেয়ে ৷ বড় ছেলে যখন জম্মগ্রহন করেছে , তার শ্বশুর -শ্বাশুড়ি কী যে খুশি হয়েছিল! শ্বাশুড়ির সাত মেয়ের পর লালমতির স্বামীই একমাত্র ছেলে৷ তাই নাতি দেখে খুশি৷ দাদা-দাদীই নাম রেখেছেন সফিকুর রহমান৷ ডাকে সফিক বলে৷

বেশ কালো হল ছেলেটা ৷ওর বাবার মত গায়ের রং৷ কালো হলে কি হবে, বেশ মায়াবী চেহারা৷ ভোজন বিলাসী ও৷ তাঁর তিন ছেলে তিন ধরনের ৷ বড়টা কাল,  ভোজন বিলাসী৷ মেঝটা ফর্সা লালমতি বেগমের মত, কিন্তু খুব বেঁছে বেঁছে  খাবে৷  ছোটটা শ্যাম বর্ণ কিন্তু খুব দুষ্ট৷

তবে, তিনটাই অসম্ভব মেধাবী৷ ওর বাবার মত৷ লেখাপড়ার জন্য কখনও বলতে হয়নি৷  অতিথি ঝামেলা যাই হোক ওরা ওদের লেখাপড়া ঠিক রাখবে৷

আর হবেই বা না কেন? লালমতি বেগম নিজের শরীরের দিকে তাকান না ছেলে মেয়েদের খাবার তৈরি করতে৷ ছেলের বাবা একদিন বলেছিল, বাচ্চারা স্কুলে যাওয়ার আগে এবং স্কুল থেকে এসে যেন সব সময় খাবার পায়, সে ব্যবস্থা রেখ৷ ডিম পাড়া মুরগির যেমন খাবার বেশি খায়৷ উঠতি বয়সের বাচ্চাদেরও তেমনি খাবার বেশি লাগে"৷

নিজের কষ্ট হলেও তাই সব ঠিক করে রাখেন৷ কষ্ট শুধু মেয়েগুলোর জন্য৷ হাইস্কুল দূরে ৷ সাঁকো পার হয়ে,  লুঙ্গী ভিজিয়ে ছেলেরা হাই স্কুল শেষ করে কলেজে গেছে৷ মেয়েরা প্রাইমারি শেষ করে আর অতদূরে হাইস্কুলে যেতে পারেনি৷ তাই ঘরের কাজে সাহায্য করে৷ ভাইদের সাহায্য করে ৷ ভাইয়েরাও  ওদের জন্য দুঃখিত৷ তবু বই পুস্তক দেয় পড়তে৷

ছোট ছেলেটা ওর বাবার স্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষা দেবে৷বড় আর মেঝটা চৌমুহনী কলেজে ভর্তি হয়েছে ৷লজিং থেকে পড়ালেখা করে৷ বড়টা সামনে  কলেজে পরীক্ষা দেবে৷  মেঝটা এবার ভর্তি হয়েছে৷

শুক্রবার দেখে ছেলে দুটো বাড়ি এসেছে৷ ভালমন্দ রান্না করেছে ছেলেদের জন্য৷ লজিং বাড়ীর খাবার ভাল লাগেন না ।মাঝে মাঝে ওর বাবা তাই  প্রায়ই রান্না করে নিয়ে যায় ৷

ছেলে তিনটা আর মেয়েরা খেতে বসছে৷ ওদের বাবাকে বাইরে কে যেন ডাকছে,  সেখানে গেল৷

খেতে বসে মেঝটা বলল, মা একদিন লজিং বাড়ীওয়ালা শুধু শুঁটকী মাছ দিয়ে ভাত দিল ৷ আমি নাক বন্ধ করে খেলাম৷ সবাই খিলখিল করে হেসে উঠল৷ মেঝটা শুঁটকী মোটেই খেতে পারে না৷

বড়টা ছেলে হেসে বলল, কিরে! ঐ সেদিন নাকি!

এবার বলতে শুরু করল, মা শুনবেন  সেদিন কী হল!

কলেজে গন্ডগোল হয়েছিল৷ পুলিশে গুলি করেছিল৷ অনেক ছেলেকে ধরে নিয়ে গেল৷ আমি কোন মতে, পালিয়ে এসেছি৷ আমার লজিং বাড়ী হতে হোসেনের লজিং বাড়ী তো খুব বেশি দূরে নয়৷ জামা কাপড় বদলিয়ে ওর লজিং বাড়ী গেলাম৷ দেখি ও নাই৷ পথে ওর এক বন্ধুর সাথে দেখা৷ বলল, ওর পিঠে রক্ত দেখেছে৷ শুনে আমি তো ভয়েই আধমরা ৷ কোথাও খবর না পেয়ে, আমার লজিং বাড়ী এসে,  পুরান জামা একটা পরে এলোমেলো চুলে পাগল সেজে ক্যাম্পে গেলাম৷ যেখানে পা না দেওয়ার, সেই ময়লাতে পা দিয়ে পাগল হয়ে ওকে  খুঁজেছি৷ পুলিশ একটা রাইফেল দিয়ে ঠেলা দিয়ে বলল, এই পাগল !

এই দেখেন বলে, বাহুতে খোঁচার চিহ্ন দেখাল সফিক৷ শিহরে উঠেন মা বোনেরা৷ তারপর?

অনেকক্ষণ  চেষ্টা করেও, ওকে দেখতে পেলাম না৷ অগত্যা আবার আমার লজিং বাড়ীতে সন্ধ্যার দিকে গিয়ে জামা পাল্টিয়ে ওর লজিং বাড়ী আবার গেলাম৷ সেখানে গিয়ে দেখি ও আসল৷

" কোথা ছিলে হোসেন? মায়ের প্রশ্ন৷

"কোথায় ছিলে মেঝ ভাই? " বোনদের আর ছোট ভাইয়ের জিজ্ঞাসা৷

"আরে   গোলাগুলি মাঝে পিঠে রক্ত লেগে গেল৷ এ শার্ট নিয়ে বাড়ী যাওয়া যায়?

দেওয়াল টপকে পার হয়ে শার্ট খুলে ফেললাম৷ আমার লজিং বাড়ীর আগেই লজিং বাড়ী সূত্রে পরিচিত একজনের বাড়ী ছিল, ওর বাড়ীতে গেলাম৷ ওরা আসতে দেয়নি৷ বলে, বাইরে শান্ত হোক৷

 মা বার বার মানা করে দিয়েছে এসব ঝামেলায় যাবি না৷

ছেলেদের খাওয়া শেষ হলে,  ছেলের  বাবা আসল৷ তাকে ভাত দিল৷ ওর বাবা আবার এক তরকারি দিয়ে ভাত খেতে পারে না৷ কয়েক রকম তরকারি লাগে৷ আজ রান্না করেছেন ও বেশি৷ পাতে তরকারি দিতে দিতে বলেন, সফি সকালে কি কেনার কথা বলল?

-ডিকশেনারি! একটা বই!"

"ও" মনে মনে হাসলেন লালমতি৷ আমি ভেবেছি, জলচৌকি না হয়, চেয়ার জাতীয় কিছু হবে!

দেখতে দেখতে চৌমুহনী কলেজ হতে বড় ছেলে সফিক ভাল ফলাফল করে, চট্টগ্রাম ভার্সিটিতে ভর্তি হয়৷

রেজাল্ট যেদিন বেরুল, সেদিন আসতে সুন্দর একটা শাড়ী নিয়ে এসে বলল, মা সারাজীবন তো মোটা কাপড় পরলে, কষ্ট করলে ৷ এই আস্তে আস্তে দিন ফিরবে৷ আমি চাকুরি পেলে,  হোসেন আইএ পাশ করে যেখানে ইচ্ছে ভর্তি হতে পারবে ৷ ছোটটা তো কুমিল্লা বোর্ডে স্ট্যান্ড করল, ও চৌমুহনী কলেজে ভর্তি হোক৷ এরপর দেখা যাবে!

যুদ্ধের ডামাডোল চারিদিকে৷ এ অজপাড়া গ্রামে এসেও লেগেছে৷ ছেলেদের বারবার নিষেধ করলেন এসবে যাবিনা৷

একাত্তরের একদিন, বাড়ি এসেছে সফিক৷ মাকে ঝিঙে পেড়ে দিল৷ পুকুর হতে মাছ ধরে দিল৷ মা ও বোনেরা মিলে রান্না করেছে, হঠাৎ দুপুরে আগ মূহুর্তে কোথায় জানি বেরুচ্ছে সফিক৷

মা বললেন, কোথায় যাস? ভাত খেয়ে যাস৷

" এই তো মা, আসি৷" বলে চলে গেল সফিক ৷ আর কোন খবর নাই৷ এক বন্ধু খবর দিল, মুক্তি বাহিনীতে যাবে বলল তাকে৷ কোথায়? কেউ জানেনা৷ হঠাৎ কয়েকদিন পর খবর পেল ,যুদ্ধে মারা গেছে সফিককে। কোথায় , কিভাবে কেউ  সঠিক বলতে পারেনি।  

" আমি এত টাকা দিয়ে নৌকা গড়ালাম কেরে আমার সে নৌকা ডুবাল!" বলে ধপাস করে পড়ে গেলেন ছেলের শিক্ষক বাবা ৷ জ্ঞান ফিরল একদিন পর । যুদ্ধের ভেতর কোথায় ডাক্তার?

সবাই বলে, কলিজায় (স্টোক ) ধরছে

একমাস বেঁচেছিলেন কোন  কথা ছাড়াই৷ তারপর নীরব নিথর৷ চলে গেলেন অজানা রাজ্যে৷

পর পর বড় ছেলে হারিয়ে,  স্বামী হারিয়ে ঝাপসা চোখে লালমতি বেগম তাকায় শূন্যতায়৷

আবার বুক বাঁধে৷ দেশ স্বাধীন হয়েছে৷ যুদ্ধ শেষ হয়েছে৷ আরেকটা যুদ্ধ বাকি৷ দুই  ছেলে আর মেয়েদের নিয়ে  এগিয়ে গেছেন আরও বড় যুদ্ধে- জীবন যুদ্ধে৷

সেই যুদ্ধে ও প্রায় জিতেছিলেন তিনি৷ মেঝ ছেলেকে মানুষ গড়ার কারিগর -শিক্ষক, আর ছোট ছেলেকে বুয়েট ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার বানিয়েছেন৷  তবু দুনিয়ার সুখ দেখার আগে চলে গেছেন আসল সুখের ঠিকানায়৷

 এই লালমতি বেগম আমার দাদী ১৯৮৮ সালে মারা যান ৷ সফিক আমার শহিদ জেঠু। না ,মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নেননি আমার  দাদী। বলেছেন ছেলে উৎসরগ হল দেশের জন্য, কোন প্রতিদান চাই না।

 

  আমার   জম্মের পূর্বেই চলে  গেলেন জেঠু। তবু  জাতীয় দিবসগুলোতে মনে পড়ে। তার প্র্যাকটিক্যাল খাতা দেখে আমি এঁকেছি। রচনা, ব্যাকরণ, Eassy, Grammer নোট  খাতা পড়েছি।আল্লাহ যেন জান্নাতে পৌঁছায়।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি