Loading..

পাঠসংশ্লিষ্ট ছবি/ইমেজ

১৪ ডিসেম্বর, ২০২০ ০২:০৭ অপরাহ্ণ

আজ ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস জাতির সূর্য সন্তান শহীদদের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা

আজ ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস

জাতির সূর্য সন্তান শহীদদের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা

 

বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞাঃ প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী যারা দৈহিক শ্রমের বদলে মানসিক শ্রম বা বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রম দেন তারাই বুদ্ধিজীবী।

বাংলা একাডেমি প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থে বুদ্ধিজীবীদের যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তা হলো:

বুদ্ধিজীবী অর্থ লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, সকল পর্যায়ের শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, চলচ্চিত্র ও নাটকের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সমাজসেবী ও সংস্কৃতিসেবী।

হত্যাকান্ডের পরিকল্পনাঃ

মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি, পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী

২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনার সাথে একসাথেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। পাকিস্তানি সেনারা অপারেশন চলাকালীন সময়ে খুঁজে-খুঁজে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে ২৫শে মার্চের রাতেই হত্যা করা হয়। তবে, পরিকল্পিত হত্যার ব্যাপক অংশটি ঘটে যুদ্ধ শেষ হবার মাত্র কয়েকদিন আগে। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের প্রশিক্ষিত আধা-সামরিক বাহিনী আল-বদর এবং আল-শামস বাহিনী একটি তালিকা তৈরি করে, যেখানে এই সব স্বাধীনতাকামী বুদ্ধিজীবীদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ধারণা করা হয় পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে এ কাজের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি। কারণ স্বাধীনতার পর ধ্বংসপ্রাপ্ত বঙ্গভবন থেকে তাঁর স্বহস্তে লিখিত ডায়েরি পাওয়া যায় যাতে অনেক নিহত ও জীবিত বুদ্ধিজীবীর নাম পাওয়া যায়। এছাড়া আইয়ুব শাসনামলের তথ্য সচিব আলতাফ গওহরের এক সাক্ষাৎকার হতে জানা যায় যে, ফরমান আলীর তালিকায় তাঁর বন্ধু কবি সানাউল হকের নাম ছিল। আলতাফ গওহরের অনুরোধক্রমে রাও ফরমান আলি তাঁর ডায়েরির তালিকা থেকে সানাউল হকের নাম কেটে দেন। এছাড়া আল-বদরদের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা তিনিই করেছিলেন বলে তাঁর ডায়েরিতে একটি নোট পাওয়া যায়।

এছাড়া তাঁর ডায়েরিতে হেইট ও ডুসপিক নামে দুজন মার্কিন নাগরিকের কথা পাওয়া যায়। এদের নামের পাশে ইউএসএ এবং ডিজিআইএস লেখা ছিল। এর মধ্যে হেইট ১৯৫৩ সাল থেকে সামরিক গোয়েন্দা-বাহিনীতে যুক্ত ছিলেন এবং ডুসপিক ছিলেন সিআইএ এজেন্ট। এ কারণে সন্দেহ করা হয়ে থাকে, পুরো ঘটনার পরিকল্পনায় সিআইএ'র ভূমিকা ছিল।


হত্যাকান্ডের বিবরণঃ

ডিসেম্বরের ৪ তারিখ হতে ঢাকায় নতুন করে কারফিউ জারি করা হয়। ডিসেম্বরের ১০ তারিখ হতে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রস্তুতি নেয়া হতে থাকে। মূলত ১৪ ডিসেম্বর পরিকল্পনার মূল অংশ বাস্তবায়ন হয়। অধ্যাপক, সাংবাদিক, শিল্পী, প্রকৌশলী, লেখক-সহ চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীদের পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসরেরা জোরপূর্বক অপহরণ করে নিয়ে যায়। সেদিন প্রায় ২০০ জনের মত বুদ্ধিজীবীদের তাদের বাসা হতে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের চোখে কাপড় বেঁধে মিরপুরমোহাম্মদপুরনাখালপাড়ারাজারবাগসহ অন্যান্য আরো অনেক স্থানে অবস্থিত নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের উপর বীভৎস নির্যাতন চালানো হয়। পরে তাদের নৃশংসভাবে রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়।

 

বুদ্ধিজীবী দিবস ও সম্পর্কিত বিষয়ঃ-

১৯৭১ সালে বছরব্যাপী পাকিস্তান সেনাবাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। পরিকল্পিতভাবে ১৪ ডিসেম্বরে সবচেয়ে বেশীসংখ্যক বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়েছিল। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এই দিনকে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’ ঘোষণা করেন। বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ‘শহিদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ’ (১৯৯৪) থেকে জানা যায়, ২৩২ জন বুদ্ধিজীবী নিহত হয়েছেন। তবে তালিকায় অসম্পূর্ণতার কথাও একই গ্রন্থে স্বীকার করা হয়েছে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের ১৮, মতান্তরে ২৯ তারিখে বেসরকারীভাবে গঠিত বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি। এরপর “বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটি” গঠিত হয়। এই কমিটির প্রাথমিক রিপোর্টে বলা হয়, রাও ফরমান আলী এদেশের ২০,০০০ বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু এই পরিকল্পনা মতো হত্যাযজ্ঞ চলেনি। কারণ ফরমান আলীর লক্ষ্য ছিল শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদেরকে গভর্নর হাউজে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা। বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটির প্রধান জহির রায়হান বলেছিলেন, ‘এরা নির্ভুলভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনষ্ক বুদ্ধিজীবীদেরকে বাছাই করে আঘাত হেনেছে’। তবে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি জহির রায়হান নিখোঁজ হন।

তাজউদ্দিন আহমেদ একটি তদন্ত কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেন ১৯৭১ সালের ৩১শে ডিসেম্বর। কিন্ত, তার ঐ সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়নি। ১৯৭১ সালের ২৭ ডিসেম্বর দৈনিক আজাদের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরিকল্পনাটি পূর্বেই করা হয় আর এতে সহায়তা করে জামায়াতে ইসলামী ও এর ছাত্র সংগঠন ছাত্রসংঘ। এ হত্যাকাণ্ডে সবচেয়ে সক্রিয় ছিলেন ব্রি. জে. আসলাম, ক্যাপ্টেন তারেক, কর্ণেল তাজ, কর্ণেল তাহের, ভিসি প্রফেসর ডঃ সৈয়দ সাজ্জাদ হোসইন, ডঃ মোহর আলী, আল বদরের এবিএম খালেক মজুমদার, আশরাফুজ্জামান ও চৌধুরী মাইনুদ্দিন এদের নেতৃত্ব দেয় মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী।[৫]

১৯৯৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনায় রমনা থানায় প্রথম মামলা দায়ের করা হয় (মামলা নম্বর ১৫)। সেখানে আলবদর বাহিনীর চৌধুরী মাইনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকে আসামি করা হয়। মামলাটি দায়ের করেন অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিনের বোন ফরিদা বানু।

 


শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকাঃ

২৫শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত বেশ কয়েকজন স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী পাকবাহিনীর হাতে প্রাণ হারান। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক

1.      ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব (দর্শনশাস্ত্র)

2.     ড. মুনীর চৌধুরী (বাংলা সাহিত্য)

3.    ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (বাংলা সাহিত্য)

4.      ড. আনোয়ার পাশা (বাংলা সাহিত্য)

5.     ড. আবুল খায়ের (ইতিহাস)

6.     ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা (ইংরেজি সাহিত্য)

7.     ড. সিরাজুল হক খান (শিক্ষা)

8.     ড. এ এন এম ফাইজুল মাহী (শিক্ষা)

9.     হুমায়ূন কবীর (ইংরেজি সাহিত্য)

10. রাশিদুল হাসান (ইংরেজি সাহিত্য)

11.  সাজিদুল হাসান (পদার্থবিদ্যা)

12. ফজলুর রহমান খান (মৃত্তিকা বিজ্ঞান)

13.এন এম মনিরুজ্জামান (পরিসংখ্যান)

14.  এ মুকতাদির (ভূ-বিদ্যা)

15. শরাফত আলী (গণিত)

16. এ আর কে খাদেম (পদার্থবিদ্যা)

17. অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য (ফলিত পদার্থবিদ্যা)

18. এম এ সাদেক (শিক্ষা)

19. এম সাদত আলী (শিক্ষা)

20.সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য (ইতিহাস)

21. গিয়াসউদ্দিন আহমদ (ইতিহাস)

22.         রাশীদুল হাসান (ইংরেজি)

23.         এম মর্তুজা (চিকিৎসক)

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক

1.      ড. হবিবুর রহমান (গণিত বিভাগ)

2.     ড. শ্রী সুখারঞ্জন সমাদ্দার (সংস্কৃত)

3.    মীর আবদুল কাইউম (মনোবিজ্ঞান)

চিকিৎসক

1.      অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ফজলে রাব্বি (হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ)

2.     অধ্যাপক ডা. আব্দুল আলিম চৌধুরী (চক্ষু বিশেষজ্ঞ)

3.    অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দীন আহমেদ

4.      ডা. হুমায়ুন কবীর

5.     ডা. আজহারুল হক

6.     ডা. সোলায়মান খান

7.     ডা. আয়েশা বদেরা চৌধুরী

8.     ডা. কসির উদ্দিন তালুকদার

9.     ডা. মনসুর আলী

10. ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা

11.  ডা. মফিজউদ্দীন খান

12. ডা. জাহাঙ্গীর

13.ডা. নুরুল ইমাম

14.  ডা. এস কে লালা

15. ডা. হেমচন্দ্র বসাক

16. ডা. ওবায়দুল হক

17. ডা. আসাদুল হক

18. ডা. মোসাব্বের আহমেদ

19. ডা. আজহারুল হক (সহকারী সার্জন)

20.ডা. মোহাম্মদ শফী (দন্ত চিকিৎসক)

 

অন্যান্যঃ-

1.      শহীদুল্লাহ কায়সার (সাংবাদিক)

2.     নিজামুদ্দীন আহমেদ (সাংবাদিক)

3.    সেলিনা পারভীন (সাংবাদিক)

4.      সিরাজুদ্দীন হোসেন (সাংবাদিক)

5.     আ ন ম গোলাম মুস্তফা (সাংবাদিক)

6.     আলতাফ মাহমুদ (গীতিকার ও সুরকার)

7.     ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (রাজনীতিবিদ)

8.     রণদাপ্রসাদ সাহা (সমাজসেবক এবং দানবীর)

9.     যোগেশ চন্দ্র ঘোষ (শিক্ষাবিদ, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক)

10. জহির রায়হান (লেখক, চলচ্চিত্রকার)

11.  মেহেরুন্নেসা (কবি)

12. ড. আবুল কালাম আজাদ (শিক্ষাবিদ, গণিতজ্ঞ)

13.নজমুল হক সরকার (আইনজীবী)

14.  নূতন চন্দ্র সিংহ (সমাজসেবক, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক)

 

শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধঃ

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে ঢাকার মিরপুরে প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়। স্মৃতিসৌধটির স্থপতি মোস্তফা হালি কুদ্দুস। ১৯৯১ সালে ঢাকার রায়েরবাজারে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ নামে আরেকটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ শুরু হয় যা ১৯৯৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর নকশা করেন জামী-আল সাফী ও ফরিদউদ্দিন আহমেদ। বাংলাদেশ ডাকবিভাগ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে একটি স্মারক ডাকটিকিটের সিরিজ প্রকাশ করেছে।

 

 

মোঃ সাখাওয়াত হোসেন

প্রভাষক

ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ

আগানগর ডিগ্রি কলেজ,

বরুড়া, কুমিল্লা।

( তথ্য সূত্র অনলাইন ডেক্স)

 

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি