সহকারী শিক্ষক
১৭ এপ্রিল, ২০২১ ০১:২৪ অপরাহ্ণ
স্বপ্নের বিদ্যালয় যেমন চায় ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা
স্বপ্নের বিদ্যালয় যেমন চায় ক্ষুদে
শিক্ষার্থীরা
অভিজিৎ ভট্টাচার্য : কারো মতে বিদ্যালয়টি হতে
হবে সুন্দর, পরিপাটি, থাকবে বাগান ও খেলার মাঠ। কারো চাওয়া শিক্ষকরা খুব আদর করে
পড়াবেন। একটি বেঞ্চে তিন-চারজন নয়, বসবে দুজন করে শিক্ষার্থী। কেউ বলেছে-
বিদ্যালয়ে ক্লাসের সময় হতে হবে সকাল ৯টা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত, যাতে খেলার
সুযোগ পাওয়া যায়। কারো চাওয়া শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত কমানো ও
মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে ক্লাস করানো।
আবার কেউ কেউ বলেছে- শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকরা পড়া
দিয়ে চলে যান, এ জন্য ঠিকমতো ক্লাস হয় না, মজাও লাগে না। আবার কারো বই পড়ার ইচ্ছা
থাকলেও লাইব্রেরির অভাবে পড়তে পারে না। এ জন্য লাইব্রেরি চায় তারা। একজন
শিক্ষার্থী জানায়, দুপুরের পর বিশ্রাম নিতে পারে না, এ জন্য তার মাথাব্যথা করে। এ
ছাড়া স্কুলে পড়তে গিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতার কথাও বলে তারা। মতামত দেয় কীভাবে
প্রাথমিক শিক্ষাকে শিশুদের উপযোগী করা যায় তা নিয়েও। গতকাল বুধবার রাজধানীর হোটেল
সোনারগাওয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় আয়োজিত দিনব্যাপী ‘মানসম্মত প্রাথমিক
শিক্ষা’ শীর্ষক জাতীয় সম্মেলনে শিশু শিক্ষার্থীরা এসব মতামত তুলে ধরেন। আয়োজনের
শুরুতেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মো. মোস্তাফিজুর রহমান সম্মেলনের উদ্বোধন
করেন। এর পর সারা দিনে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে ‘আমাদের স্বপ্নের স্কুল এবং
মানসম্মত শিক্ষা’ অভিভাবকদের অংশগ্রহণে ‘আমাদের সন্তান ও তাদের দ্বিতীয় নিবাস’
শিক্ষা ব্যবস্থাপকদের অংশগ্রহণে ‘মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থাপনা প্রতিবন্ধকতা এবং
উত্তরণ’ ও শিক্ষকদের অংশগ্রহণে ‘আমরা ক্লাসরুমের কবি’ শিরোনামে আলোচনা চলতে থাকে।
শিক্ষার্থীদের কথার রেশ ধরে গণস্বাক্ষরতা
অভিযানের প্রধান নির্বাহী রাশেদা কে চৌধুরী সাফ জানালেন, আজকের এ অনুষ্ঠানে শিশুরা
তাদের চাওয়ার যে তালিকা দিয়েছে, তা-ই মানসম্মত শিক্ষা। তিনি বলেন, আমরা তো মানসম্মত
শিক্ষা কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায় তার জন্য বিশাল সম্মেলন করছি। শিশুরাই আমাদের বলে
দিল মানসম্মত শিক্ষা কি? আমরা যদি আজকে শিশুদের কথাগুলোর তালিকা তৈরি করি, তাহলেই
মানসম্মত শিক্ষার পরিবেশ তৈরি হবে। এ জন্য কনসালটেন্ট লাগবে না, টাকা লাগবে না।
ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা নিজেদের স্বপ্নের বিদ্যালয়ের জন্য এমন অনেক কিছুই চায়। আর এরা
সবাই দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
আলোচনা শেষে গৃহীত সুপারিশে বলা হয়েছে, প্রাথমিক
পর্যায়ে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক,
স্কুল সময় কমানো, শহরের বিদ্যালয়গুলোতে উপবৃত্তির
টাকা প্রদান ও ছাত্র-শিক্ষকের আনুপাতিক হার কমানো জরুরি বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন
ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। দেশের ৬৪ জেলা
থেকে ২৫৬ জন ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা
দিনব্যাপী এ সম্মেলনে অংশ নেন।
সবকটি আলোচনার মধ্যে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে
‘আমাদের স্বপ্নের স্কুল এবং মানসম্মত শিক্ষা’ বিষয়টি ছিল প্রাণবন্ত। ক্ষুদে
শিক্ষার্থীরা যেভাবে তাদের বক্তব্য তুলে ধরেছে তা ছিল চমৎকার। নিজের স্বপ্নের
স্কুলের কথা জানাতে গিয়ে সিলেটের পিটিআই সংলগ্ন পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির
শিক্ষার্থী মনিষা রায় অমি বলে, আমার স্বপ্নের স্কুল হবে সাজানো-গোছানো। শিক্ষকরা
হবে বন্ধুর মতো, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করবেন। কোনো
পড়া বুঝতে না পারলে তা নির্ভয়ে তা শিক্ষকদের জানাতে পারব। স্কুলে থাকবে সংস্কৃতি
চর্চার সুযোগ।
শুধু লেখাপড়া নয়, পাশাপাশি খেলাধুলা করার জন্য
সময় চায় পঞ্চগড়ের ২নং পঞ্চগড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী
নিশাত জান্নাত ছোটন। তারমতে, সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকেল সোয়া ৪টা পর্যন্ত স্কুল,
মধ্যে আধাঘণ্টার বিরতি। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে খাওয়া-দাওয়ার পর আর খেলাধুলা করার
সময় থাকে না। স্কুলের সময়টা এমনভাবে করেন যেন আমরা খেলতে পারি। এ সময় ইউরোপীয়
ইউনিয়নের শিক্ষা উপদেষ্টা লায়লা বাকী তার কাছে স্কুল শুরু এবং শেষের সময় কত হওয়া
উচিত জানতে চান- ছোটন জানায়, ৯টা থেকে দুপুর ১টা।
পিরোজপুর সদরের পালপাড়া সরকারি প্রাথমিক
বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দিবা দেবনাথ জানায়, সবগুলো স্কুলে মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে
পড়ালেখার সুযোগ চায়। মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে পড়ানো হলে তা সহজেই বুঝতাম। ল্যাপটপ বা
কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ থাকলে ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের সব তথ্য জানা
আমাদের জন্য আরো সহজ হতো।
নিজের স্বপ্নের স্কুলটি নিরাপদ হবে এমনটাই চায়
চাঁদপুরের ৫৬ নম্বর খলিশাডুলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শিফরিন
হৃদিতা। তার মতে, আমাদের স্কুলে কোনো নিরাপত্তা দেয়াল নেই। ফলে বখাটে ছেলেরা
স্কুলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। আমাদের বিরক্ত করে। এ জন্য বিদ্যালয়ে দেয়াল দিয়ে
নিরাপত্তা বেষ্টনী দেয়ার দাবি তার। একই সঙ্গে বিদ্যালয়ের জন্য পুলিশ চায় সে।
গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার একটি স্কুলের
শিক্ষার্থী অর্পণ জানায়, স্কুলের মিড-ডে মিলে যে বিস্কুট দেয়া হয় তা খেতে ভালো
লাগে না। এই বিস্কুট বেশি ভালো না। প্রতিদিন এক প্যাকেট দেয়। তার মতে, বিস্কুটের
পরিবর্তে মাঝে মধ্যে কেক দিলে ভালো হয়।
গাজীপুরের শ্রীপুরের এক ছাত্র বলল,
মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে ক্লাস নেয়া হলে তাদের বুঝতে খুব সুবিধা হয়। এ সময় সে
কিছুদিন আগে বায়ুদূষণ নিয়ে মাল্টিমিডিয়ার ক্লাসের উদাহরণ তুলে ধরে।
মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার গাড়াডোর সরকারি
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তরিফা নাজনীনা প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় জোর দেয়া
এবং দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিশুদের হাতে বই তুলে না দেয়ার আহ্বান জানান। স্কুল
থেকে শিশুদের ঝরেপড়া রোধে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কারিগরি শিক্ষা পাঠ্যক্রমে
অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানান তিনি। তিনি বলেন, আমরা প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে
সরাসরি বই তুলে না দিয়ে জুতোর ফিতা বাঁধা, পরিচ্ছন্নতা, আচরণ- এমন জীবন ঘনিষ্ঠ
শিক্ষা দিতে পারি। সেসব বিষয়ের মূল্যায়ন করে তাদের তৃতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করা যায়।
স্কুলের শিক্ষকদের সময়মতো ক্লাসে উপস্থিত থাকা
বলে জরুরি মনে করেন খুলনা টুটপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির
সভাপতি এসএম মাসুদ মাহমুদ। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা বন্ধ করে দেয়ার আহ্বান
জানান তিনি। স্কুলের সময়সূচিতে পরিবর্তন আনার আহ্বান জানান তিনি। বর্তমান সময়সূচি
কমিয়ে সকাল ৮টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত করা উচিত। দুপুরের পর শিক্ষার্থীরা
ক্ষুধার্ত এবং ক্লান্ত হয়ে পড়ে তারা। স্কুলে থাকতে চায় না, চলে যায়।
সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান জানান, মানসম্মত
শিক্ষার জন্য বন্ধুর মতো শিক্ষক দরকার। শিক্ষক হবেন বন্ধুর মতো। তিনি পড়াবেন,
আমাকে স্বপ্ন দেখাবেন। আবার স্বপ্ন বাস্তবায়নে পথ দেখাবেন।
শিক্ষার্থীদের স্কুলের উপস্থিতি বেশি মানেই
মানসম্মত শিক্ষা নয় বলে জানান বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক
সাব্বির বিন শামস। শিক্ষার মানোন্নয়নে পরামর্শ দিতে গিয়ে দাতাদের ওপর থেকে
নির্ভরশীলতা কমানোর পরামর্শ দেন তিনি। শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে হলে
দাতাসংস্থার সব পরামর্শ মানা যাবে না। এটা করা হলে কোনোদিন মানসম্মত শিক্ষার
লক্ষ্যপূরণ কোনোদিন সম্ভব নয়।
জাতীয় সম্মেলনে আসা বিভিন্ন পরামর্শ ও মতামত
আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করবে বলে জানান প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর
রহমান। আন্তরিকতা দিয়ে সীমিত বাজেটের মধ্যেই মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব
বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, সবাই সাজেশন দিচ্ছে খরচ বাড়ানোর জন্য। শিক্ষা খাতের
সবাই যদি নিবেদিতপ্রাণ হয় তাহলে সীমিত সুযোগ-সুবিধার মধ্যে থেকেই মানসম্মত শিক্ষা
দেয়া সম্ভব। তিনি প্রশ্ন করেন, বেশি টাকা বেতন দিলে কি দেশপ্রেম বেশি হবে?
প্রাথমিক শিক্ষায় যে বরাদ্দ হয় তাও ঠিকমতো
ব্যবহার হয় না বলে জানান প্রাথমিক ও গণশিক্ষাবিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি মোতাহার
হোসেন। প্রাথমিক শিক্ষার সব পর্যায়ে নজরদারি দুর্বল বলে অভিযোগ করেন তিনি।
তথ্য সূত্রঃ ভোরের কাগজ