পৌষের মাঝামাঝি।হিমশীতল শিরশির বাতাস।ভোরের সূূর্য কুয়াশার আড়ালে মুখ লুকিয়ে আছে। পাতায় জমে থাকা শিশিরকণা টুপটুপ করে ঝরে পড়ছে।পথের দুধারে সবুজ গালিচার মতো ঘাসগুলো শিশির স্নানে ভেজা।ঘুঘুর মাতাল করা কোরাসে যেন দলীয় সঙ্গীতের রিহার্সাল যা ধবল কুয়াশা ভেদ করে শোনা যাচ্ছে।আগুনের কুণ্ডলিতে শরীরে তা নিচ্ছে এক শ্রেণির মানুষ।গতদিনের নিভে যাওয়া পরিত্যক্ত ছাইয়ের মধ্যে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে কয়েকটি কুকুর। কৃষিশ্রমিক কাজের উদ্দেশ্যে দু একজন ছুটছে জমির দিকে। আলু ও তামাক( মানব স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর) চাষি আনমনে লাঙল টানছে মাটি শুকানোর জন্য।
ভোর বেলায় হীরকখণ্ডের মতো শিশিরকণা ভেদ করে দ্রুত পায়ে হেঁটেই চলছি।প্রাতঃভ্রমণে তেমন কেউ নেই গাঁয়ের পথে। পথপানে তাকিয়ে খুঁজছি " লাগবে খেজুররস" বলে কেউ হাঁক ছাড়ে কি না। কিন্তু না এমন আওয়াজ এখন শোনাই যায় না।পথের ধারে,পুকুরপাড়ে খেজুর গাছ তেমন চোখে পড়ে না। আগের মতো এ গাঁয়ে গাছটির অস্তিত্ব নেই বলেই গ্রামীণ ঐতিহ্য বাঁশ নির্মিত বাহকের (বাউক)দুপাশে কলসি ঝুলিয়ে গাছির ছবিটিও স্মৃতিতে কুয়াশার চেয়েও ঝাপসা হয়ে গেছে।
প্রতিদিন নিয়মকরে ৫০ মিনিট হাঁটি।যে পথ ধরে যাই অন্যপথে ফিরে আসি।প্রায়শ পথ বদল করেই প্রাতঃভ্রমণের অভ্যেস।শৈশবে রাতের শেষ প্রহরে ঘুম ভেঙে শুনতাম দূর থেকে ভেসে আসা কোন শিক্ষার্থীর সরব পাঠের শব্দ।আমিও ঘুমোতে না গিয়ে বসে পড়তাম বই নিয়ে।নিরব প্রতিযোগিতা স্বয়ংক্রিয় সক্রিয় হতো।বাবা মাও ডেকে দিতেন পড়ার জন্য।কিন্তু অনেকদিন হতে বিভিন্ন পথে হেঁটেই যাচ্ছি কিন্তু পড়ার শব্দ কানে আসে না।বয়সের কারণে কম শুনছি নাতো? না শিক্ষার্থীরা এখন নিরব পাঠে অভ্যস্থ? না গভীর রাত অবধি জেগে পড়াশোনা করে ভোরে ওরা ঘুমায়? করোনাকালে সবাই তো বাড়িতেই তবে কেন আমি শুনছি না পড়ার শব্দ?এখন প্রত্যেক পরিবারেই শিক্ষার্থী রয়েছে।তবে শীত ভেদ করে সাইকেলে, বাইকে রাস্তা দখল করে সগৌরবে প্রাইভেটে যেতে দেখেছি অনেককে।তাদের ভাবসাব একটু অন্যরকম।
চলার পথে পথের মাঝে অসতর্ক কৃষক গোবরের স্তুপ ফেলে রাখে যা ক্ষতির কারণ।গোবরের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে রুচিবোধে সমস্যা এবং পা পিছলে পড়ে যাবার থাকে আশঙ্কা।শুধু কাঁচা পথেই নয় পাকাসড়কেও এমন অপকর্ম সহসা করেই থাকে।আজ চোখের সামনেই একজন সাইকেল আরোহি পড়ে গেল এবং হাঁটুর চামড়া উঠে রক্ত ঝরতে দেখে কষ্টও পেলাম।কিছুদিন পূর্বে জেনেছি জাহিদ নামের যুবক স্তুপিকৃত গোবরে দুর্ঘটনায় পায়ের বুড়ো আঙুল হারিয়েছে।কোনদিন শোনা যাবে এ কারণে কারো জীবন প্রদীপ নিভে গেছে।কবে বোধদয় হবে অসতর্ক কৃষকের এবং তৈরি করবে না কারো দূর্ঘটনার ফাঁদ।প্রতীক্ষায় রইলাম।
শিশিরভেজা পথে হেঁটেই চলছি।পথিমধ্যে আবছা আলোয় জনৈক কৃষক কোদাল দিয়ে জমি সংলগ্ন রাস্তা একটু করে কেটে ধ্বংস করছে রাস্তার প্রকৃত অবস্হা। রাস্তা দিনে দিনে ক্রমশ সরু হয়ে পড়ছে। এ রকম রাস্তা খেকোদের জন্য গাঁয়ের পথের বেহালদশা।যা আমাকে পীড়িত করে।সরাসরি প্রতিবাদ বিপত্তির কারণ ভেবে দীর্ঘশ্বাসে হাঁটতে লাগলাম।
দিনের আলো রাতের আঁধারে নিঃশব্দে ডুব দেয়।সন্ধ্যার পর বাইকে চেপে চা পানের তিয়াসে মন্থর গতিতে বাজারের পথে চলতে লাগলাম।পথের বাঁকে দূর থেকে সদ্য কাটা ধানক্ষেতের মধ্যে আলো ঝলমল স্টেডিয়ামের আদলে সাজানো খেলার আয়োজন দেখে চমকে থমকে গেলাম।গাঁয়ের মধ্যে রাত্রিকালিন ক্রিকেট?
যে গাঁয়ে দিনের বেলায় আলোর অভাব নেই সেখানে বিদ্যুৎ অপচয় করার হেতু খুঁজে পেলাম না।লোডসেডিং হলে অধিক ব্যয়ে বিকল্প আলোর তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা আমাকে হতবাক করে।এটা কি অপচয় আর বিলাসীতা নয়? না আমার মাথায় উল্টাপাল্টা ভাবনা আন্দাজি ক্রিয়া করে? ক্রীড়া চর্চার সংস্কৃতি বদলে যাচ্ছে কি করে যা তন্ময় হয়ে ভাবছি। সন্ধ্যার পর সাধারণত শিক্ষার্থীরা পড়তে বসে।পড়ার সময়ে খেলার আয়োজন শিক্ষায় ব্যঘাত, স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং বদনেশায় আসক্ত হওয়ার প্রবণতা বাড়তে পারে। ।প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় খোলামাঠে কুয়াশার মধ্যে দীর্ঘক্ষণ অবস্থান সর্দিকাশি হওয়ার সম্ভবনা বাড়ায়। আমাদের শৈশবে ধানকাটার পর পতিত জমিতে দলবেঁধে গোল্লাছুট,ফুটবল,কাবাডি ইত্যাদি খেলায় মেতে উঠতাম।কোন মঞ্চ,শব্দযন্ত্র,অতিথি এসবের কিছুই ছিল না।আমারা শারিরীক কসরত ও আনন্দকেই প্রাধান্য দিতাম।লৌকিকতার উপর কখনো গুরুত্ব ছিল না।এখন লৌকিকতাই মূখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গাঁয়ের রাত মানেই নিস্তব্ধতা তা এখন পুস্তকে মলাটবন্দি।অহরহ উচ্চশব্দ ভেসে আসে দোকানের হালখাতা ,বিয়ে বাড়ি,বনভোজন ইত্যাদি অনুষ্ঠান থেকে।দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে গভীর রাত কখনো সারারাত পর্যন্ত শব্দ দূষণ চালাতেই থাকে।আমার রক্তচাপ বেশি থাকায় সমস্যাটা বেশিই অনুভূত হয়।আজ ঘুমোতে যাবার বেলায় অনিচ্ছা সত্বেও শুনতে হয় বনভোজন থেকে শব্দবাক্সে রসহীন উচ্চ শব্দ 'ধপধপ'।ভাষাহীন 'ধপধপানি' বুকের মধ্যে আঘাত হেনেই চলে। দরজা জানালা বন্ধ করেও নিস্তার নেই।গানে আনন্দ এবং শেখার অনেক উপাদান থাকে কিন্তু ভাষাহীন উদ্ভট শব্দে কি আছে এ প্রজন্মই ভালো বুঝে,আমার বোধগম্য নয়।আমার কাছে শুধু বিরক্তিকরই নয় শ্রবণঅঙ্গ সুরক্ষার জন্যও হুমকি।অবশেষে কান পর্যন্ত লেপ মুড়ি দিয়ে কিছুটা রক্ষা।
ভোরের নিরবতা ভেঙে ছিল ঘুঘু পাখিসহ অন্য পাখির কূজনের সিম্ফনি। যা পুরোদিনের মোহনীয় পুলকে অন্যরকম ভালোলাগা।রাতটাও যদি হতো নিঃশব্দে অন্ধকারের মতো নিরব,আর শিশিরবিন্দুর হঠাৎ পাতার গা ছুঁয়ে গড়িয়ে মৃদু টুপটুপ শব্দ,পতঙ্গের ক্রিক্রি মিষ্টি ধ্বনি তবেই নিদ্রালু স্বপ্নিল ভুবনের অাতিথ্যে কেটে যেত সার্থক রাত।তা এখন সুদূর সোনালি অতীত
মতামত দিন