শীতের আগমন ঘটছে। প্রকৃতির উপর শীতের প্রভাব।

বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। ষড়ঋতুতে শীতের আগমন বৈচিত্র্যময়। ঋতুচক্র ৬টি ঋতুতে ভাগ হয়েছে। প্রকৃতি আবহাওয়া ও জলবায়ুর প্রভাবে বছরের ১২টি মাস দুই মাস করে ৬টি ঋতুতে ভাগ হয়েছে। এই ৬টি ঋতু হলো গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। তবে সব ঋতুর প্রাধান্য ও প্রভাব এক নয়। গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত প্রত্যক্ষ আর শরৎ, হেমন্ত ও বসন্ত পরোক্ষভাবে প্রকৃতিতে প্রতিফলিত হয়। গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীতÑএই তিনটি ঋতু প্রকৃতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। জনজীবনে প্রচন্ড নাড়া দেয়। শরৎ, হেমন্ত ও বসন্ত জনজীবনে অনুভূত হয়, যেন তার আগমন নীরব-নিভৃতে। ঋতুচক্রে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ গ্রীষ্মকাল, আষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষাকাল, ভাদ্র-আশ্বিন শরৎকাল, কার্তিক-অগ্রহায়ণ হেমন্তকাল, পৌষ-মাঘ শীতকাল ও ফাল্গুন-চৈত্র বসন্তকাল। গ্রীষ্ম-বর্ষার পর আসে শরৎ। কিছুটা পরে তা মিশে যায় হেমন্তে। শীতের অবস্থান হেমন্তের পরে এবং বসন্তের আগে। শীতকাল পৌষ ও মাঘÑএই দুই মাস হলেও এর শুরু কিছুটা আগে এবং শেষ হয় কিছুটা পরে। পৌষ ও মাঘÑএই দুই মাস নিয়ে শীতকাল। বাংলাদেশের ঋতুচক্রে অন্য ৫টি ঋতু থেকে শীতকালের বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। শুষ্ক চেহারা আর হিমশীতল অনুভব নিয়ে আসে শীত। এ সময় গ্রামবাংলা যেন শীতের চাদর মুড়ি দেয়। ভোরবেলা ঘন কুয়াশার ধবল চাদরে ঢাকা থাকে। হিমেল হাওয়ায় হাড় কাঁপিয়ে শীত জেঁকে বসে। শীতের দাপটে প্রকৃতি নীরব হয়ে যায়। সবুজ প্রকৃতি রুক্ষ মূর্তি ধারণ করে। শীতের শুষ্কতায় অধিকাংশ গাছপালার পাতা ঝরে পড়তে থাকে। শীত তার চরম শুষ্কতার রূপ নিয়ে প্রকৃতির ওপর জেঁকে বসে। রুক্ষতা, তিক্ততা ও বিষাদের প্রতিমূর্তি হয়ে শীত আসে। শীতের তান্ডবে প্রকৃতি বিবর্ণ হয়ে পড়ে। শীতের সকাল কনকনে ঠান্ডা আর ঘন কুয়াশায় ঢাকা থাকে। সবকিছু জড়সড় হয়ে আসে, সামনের কোনোকিছু ঠিকমতো দেখা যায় না, সবকিছুই অস্পষ্ট মনে হয়। কখনো কখনো কুয়াশার স্তর এত ঘন থাকে যে, দেখলে মনে হয়, সামনে কুয়াশার পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। অনেক দেরিতে ওঠে সূর্য। প্রকৃতির ওপর সূর্যের নির্মল আলো ছড়িয়ে পড়ে। দেখে মনে হয়, সূর্যের আলোতে কোনো তেজ নেই। গভীর রাত থেকে গাছের পাতায় শিশির বিন্দু জমতে থাকে। আর ভোররাতে শিশিরকণা বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টির মতো ঝরতে থাকে। টিনের চালে, ঘরের চালে, পাতার ওপর টুপটাপ বৃদ্ধির মতো পড়তে থাকে। সকালে মাঠে মাঠে ঘাসের ডগায় বিন্দু বিন্দু জমে থাকা শিশির রোদের আলোয় ঝিকমিক করে। ধানক্ষেত-শাকসবজির ওপর টলমল করা শিশির বিন্দু সূর্যের সোনালি রশ্মিতে মুক্তার মতো ঝলমল করে। এ সময় গ্রামের খেতে খেতে ধান কাটা শুরু হয়। বাতাসে নতুন ধানের গন্ধ ভেসে বেড়ায়। শীতে এ সময় শহর-গ্রামের সবখানে চলে নবান্ন উৎসব। শীতের সকালে খেজুরের মিষ্টি রস সবার মন কাড়ে। গাছিরা কলস ভরে রস নিয়ে আসে। খেজুরের কাঁচা রস রোদে বসে খাওয়াটাই যেন একটা আলাদা স্বাদ। খেজুর রসের পায়েস আর নলেন গুড়ের কথা ভাবলে জিহ্বায় জল এসে যায়। শীতকালে সর্বত্র নানা রকম পিঠা তৈরি হয়। গ্রামে গ্রামে রং-বেরঙের পিঠা-ক্ষীর-পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে। বাড়ি বাড়ি পিঠাপুলি তৈরি হয়। রসের পিঠা, তেলে পিঠা, পাটিসাপটা এবং ভাপাসহ নানা রকম পিঠা, যা দেখলে সবার মন কাড়ে। এ সময় বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে শুরু হয় রকমারি পিঠা উৎসব। তা ছাড়া খেজুর রসের তৈরি পায়েস আর নানা রকম পিঠা নিয়ে পৌষ-সংক্রান্তির উৎসব জমে ওঠে। বাড়ি বাড়ি ছাড়াও সন্ধ্যায় হাট-বাজারে আতপ চালের গুঁড়া, নলেন গুড় এবং নারিকেল দিয়ে তৈরি গরম ভাপাপিঠা ও পাটিসাপটা খেতে ভারি মজা লাগে। অন্যকে খেতে দেখলে নিজের অজান্তেই জিহ্বায় পানি এসে যায়।
শীতকালে পাকা ধানের সোনালি খেতের দৃশ্য দেখে চোখ ফেরানো যায় না। পাকা ধান কেটে ঘরে তোলার পরপরই কৃষকরা আবার বোরো আবাদে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে কৃষক লাঙল-জোয়াল কাঁধে গরু নিয়ে মাঠে চলে। যদিও এই দৃশ্য আজকাল খুব একটা চোখে পড়ে না, তবু কিছু কিছু এলাকায় গরুর লাঙল দিয়ে চাষাবাদ হচ্ছে। সারা দিনই কৃষকরা চাষাবাদে ব্যস্ত সময় পার করে। তারা বোরো বীজতলা, সদ্য রোপা বোরো আবাদ রক্ষা করতে সকাল-বিকেল পানি পরিবর্তন করে শীতের হাত থেকে ক্ষেত রক্ষা করতে পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকে। শীতকালের শাকসবজিতে খেত ভরে যায়। লালশাক, পালংশাক, শিম, বরবটি, লাউ, টমেটো, গাজর, শালগম এবং মুলাসহ নানা রকম সবজি শোভাবর্ধন করে, যা আমাদের খাবার হিসেবে আকৃষ্ট করে। সরিষাফুলের হলুদ খেত আর মৌমাছির গুঞ্জনের দৃশ্য না দেখলে এই দৃশ্য বোঝানো যাবে না। আর শীতকালের রং-বেরঙের ফুল গাঁদা, ডালিয়া, সূর্যমুখী, গোলাপ প্রভৃতি শোভাবর্ধন করে। ফুলের দোকানগুলো বাহারি ফুলে ভরে যায়। এ সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথি বরণ করতে ফুলের দোকানগুলোতে নানা রকম ফুলের ডালি, তোড়া ও মালাসহ সুসজ্জিত ফুলের উপকরণ বিক্রির হিড়িক পড়ে যায়।
গ্রাম্য এলাকার শীতের সকাল ও বিকাল বড়ই চমৎকার। শীতের দীর্ঘ রজনী কম্বল-লেপ-কাঁথা মুড়ি দিয়ে জড়সড় হয়ে রাত কাটে। সকালে উঠে সূর্য ওঠার অপেক্ষায় সবাই উসখুস করতে থাকে। চায়ের দোকানগুলোতে চা পানের ধুম পড়ে যায়। সকালের মিষ্টি রোদে ছেলেমেয়েরা চিড়া-মুড়ি-খেজুরের পাটালি গুড় খেতে খেতে রোদ পোহাতে থাকে। শীতের দিনে বেলা ছোট হওয়ায় বেলা মাথার ওপর আসতে আসতে যেন সন্ধ্যা হয়ে যায়। এ সময় শীতের দাপট থেকে বাঁচতে সবাই জ্যাকেট, সোয়েটার, মাফলার এবং কোটসহ রং-বেরঙের বাহারি শীতবস্ত্র পরিধান করে। সাজপোশাকে আসে বৈচিত্র্য। বাহারি এসব পোশাক দেখে চোখ জুড়ায়। শীতে প্রকৃতি যেন ঝিমিয়ে পড়ে। শীতের শুষ্কতায় প্রকৃতি বিবর্ণ-রুক্ষ মূর্তি ধারণ করে। হাড় কাঁপানো শীতের দাপটে অনেক অস্বস্তিকর অনুভূতির মধ্যে একটি হলো ঠোঁট ও পা ফেটে যাওয়া। শীত থেকে রক্ষা পেতে বিভিন্ন প্রসাধনীর কদর বেড়ে যায়।
শীতকালে অতিথি পাখির আগমন এক অন্য রকম রোমাঞ্চকর আকর্ষণ। পরিযায়ী পাখিরা বিভিন্ন শীতপ্রধান দেশ থেকে এসে আমাদের দেশের হাওর-বাঁওড় ও জলাশয়ে আশ্রয় নেয়। রং-বেরঙের পাখি দেখে মন ভরে যায় আর কলকাকলিতে এলাকা মুখরিত হয়। তবে এর মধ্যে কিছু দুষ্ট ব্যক্তি চুরি করে পাখি শিকার করে, যা আমাদের জন্য খুবই কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শীতের অনুকূল আবহাওয়ায় দেশি-বিদেশি ভ্রমণবিলাসী পর্যটকের আগমন ঘটে। বিদেশি পর্যটকদের আগমনে আমাদের দেশের বৈদেশিক মুদ্রার আয় বেড়ে যায়। এতে অর্থনৈতিক খাত সমৃদ্ধ হয়। দেশের দর্শনীয় স্থান এবং পিকনিক স্পটগুলোতে ভ্রমণকারীদের ঢল নামে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে শিক্ষাসফর শুরু হয়। তা ছাড়া গ্রামের হাট-বাজার এবং উন্মুক্ত স্থানসহ সর্বত্র পিকনিকের আয়োজন বেড়ে যায়।
শীতের সকালে গ্রামে কনকনে ঠান্ডা আর ঘন কুয়াশা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। শীতকালে মাঝে মাঝে শুরু হয় শৈত্যপ্রবাহ। আর এ সময় তাপমাত্রা খুব নিচে নেমে যায়। হাড় কাঁপানো শীতে মানুষ-জীবজন্তুর পাশাপাশি প্রকৃতি যেন অসাড় হয়ে পড়ে। শীতের হাত থেকে বাঁচতে মানুষ আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। এ সময় শীতবস্ত্র কেনার ধুম পড়ে যায়। যে যার সাধ্যমতো গরম কাপড় কিনে নিজেকে শীত থেকে সুরক্ষার চেষ্টা করে। শীতের সকাল ও রাতে ছিন্নমূল মানুষ আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা চালায়। শীতের সকালে শহর-গ্রামে আগুনের কুন্ডলী তৈরি করে উত্তাপ নিতে দেখা যায় শিশু-বৃদ্ধসহ সব বয়সী মানুষকে। এই আগুন জ্বালিয়ে উত্তাপ নেওয়ার মধ্যে রয়েছে আলাদা এক অনুভূতি। ভবঘুরেরা হাট-বাজার, স্কুল-কলেজের বারান্দায় আশ্রয় খোঁজে। এ সময় সরকার, দানশীল ব্যক্তি এবং বিভিন্ন সংগঠন দুস্থ-গরিবদের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ করে থাকে।
শীতের কনকনে ঠান্ডায় বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা শীতজনিত জ্বর, সর্দি, কাশি, নিউমোনিয়া এবং ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। এ সময় হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। শীতে বিত্তহীন ও গরিব মানুষের জীবনে দুর্যোগ হয়ে দেখা দেয়। এ সময় তারা অনেকটা মানবেতর জীবন যাপন করে।

সাম্প্রতিক মন্তব্য


লুৎফর রহমান
Best wishes with full ratings. Sir/Mam. Please give your like, comments and ratings to watch my all-contents

মোঃ আরিফুল ইসলাম
প্রিয় স্যার, আসসালামু আলাইকুম, বাতায়নে আমি সক্রিয়ভাবে অনেক দিন যাবত কাজ করে আসছি। বাতায়নে আমি ১০১ টি কনটেন্ট, ৫০ টি ভিডিও কনটেন্ট, ১১১ টি ছবি, ৫৮ টি ব্লগ ও ৭২ টি অনলাইন ক্লাস আপলোড করেছি। স্যার সময় পেলে আমার বাতায়ন প্রোফাইল দেখার জন্য বিনীত অনুরোধ রইল। স্যার আপনার সুচিন্তিত মূল্যায়ন আমার পেশাগত জীবনে অনুপ্রেরণা যোগাবে । বাতায়ন প্রোফাইল লিংকঃ https://www.teachers.gov.bd/profile/arif046980 বাতায়ন ফেইজবুক গ্রুপ লিংকঃ https://www.facebook.com/groups/360976128258955/?ref=share User Id: mailto:[email protected] কনটেন্ট লিংকঃ https://www.teachers.gov.bd/content/details/1156607 মোঃ আরিফুল ইসলাম। প্রভাষক (ইংরেজী) প্রতিষ্ঠানের ধরন: আলিম শাখা বিভাগ: সিলেট জেলা: হবিগঞ্জ উপজেলা: হবিগঞ্জ সদর স্কুলের নাম: শায়েস্তাগঞ্জ কামিল মাদরাসা। ICT4E জেলা অ্যাম্বাসেডর, হবিগঞ্জ। মোঃ ০১৭১১৮৫৭৫৮৯০

মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম
✍️ সম্মানিত, বাতায়ন প্রেমী শিক্ষক-শিক্ষিকা , অ্যাম্বাসেডর , সেরা কন্টেন্ট নির্মাতা , প্রেডাগোজি রেটার আমার সালাম রইল। রেটিং সহ আমি আপনাদের সাথে আছি। আমার বাতায়ন বাড়িতে ৬৪ তম কন্টেন্ট দেখার জন্য আপনাদের আমন্ত্রণ রইলো। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখবেন , নিজে সুস্থ্ থাকবেন, প্রিয়জনকে নিরাপদ রাখবেন। ধন্যবাদ।?https://www.teachers.gov.bd/content/details/1159956

প্রকৌঃ মোঃ শফি উদ্দীন
Excellent! Surely your competency will enrich the ‘Shikkhok Batayon’. Please, You are invited to my ppt content: https://www.teachers.gov.bd/content/details/1151867 Video content: https://www.teachers.gov.bd/content/details/1153040 Blog: https://www.teachers.gov.bd/blog-details/626808 Publication: https://www.teachers.gov.bd/content/details/1134641

মোহাম্মদ শাহ আলম
শ্রেণি উপযোগী ও মানসম্মত কনটেন্ট আপলোড করে বাতায়নকে সমৃদ্ধ করার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। লাইক ও পূর্ণ রেটিংসহ আপনার জন্য শুভকামনা রইলো। আমার আপলোডকৃত কনটেন্ট দেখে আপনার মূল্যবান মতামত ও পরামর্শ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি।
মতামত দিন