পীতকরবীর আত্মকথা পাপড়ি মোড়ানো পীতকরবীর হলুদ ফুল দেখতে বেশ সুন্দর, পুরো গাছটাই ছিমছাম, নয়নাভিরাম।

পীতকরবীর আত্মকথা
পাপড়ি মোড়ানো পীতকরবীর হলুদ ফুল দেখতে বেশ সুন্দর, পুরো গাছটাই ছিমছাম, নয়নাভিরাম। ডালে ডালে হালকা সবুজ চিরল পাতার থোকায় প্রায় সারাবছরই ফুটতে থাকে ঘন্টাসদৃশ ফুলগুলো।এই ফুলের রং কখনো গোলাপি-হলুদ বা সাদাও হতে পারে যদিও গাছ দেখতে একরকম। বহুযুগ আগে পীতকরবীর একটি বিরল কালো প্রজাতিও দেখা যেত ভারতবর্ষে। বনৌষধি গবেষক বিরজাচরণ গুপ্ত উল্লেখ করেছেন, এই কালো প্রজাতিতে ফলের গায়ে কাঁটা থাকতো এবং বীজ হতো চক্রাকার, যা এখন লুপ্ত বলেই অনুমিত। দৃষ্টিনন্দন এই গাছ ছোট বৃক্ষের উচ্চতাসম্পন্ন বলে পৃথিবীর নানা দেশে একে রাস্তার পাশে, বাগানে ও পার্কে ভূদৃশ্যের জন্য লাগানো হয়। এই ফুলের ঘ্রাণ তীব্র না হলেও হাজারটা ফুল থেকে স্বতন্ত্র। পীতকরবী ফুলের গন্ধে যিনি একবার অভ্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি গাছ দেখলেই ফুলের সন্ধান করে অজ্ঞাতসারেই নাকটা বাড়িয়ে দেন। এহেন ঘ্রাণের অদ্ভুত স্বাতন্ত্র্যের কারণে পৃথিবীর কিছু নামকরা পারফিউম ইন্ডাস্ট্রি চেষ্টা করেছে একে অবিকল নকল করার জন্য যা কখনো সম্ভব হয়নি।
পীতকরবীর ফুল দেখতে হুঁকার কল্কের মতো, তাই সহজভাবেই বাংলায় একে আমরা কল্কে ফুল নামেই চিনি। কেউ কেউ একে কল্কা ফুল বলে থাকেন যা হয়ত কল্কে নামেরই ঈষৎ রূপান্তর। পারস্যে ব্যবহৃত ‘কল্কা’ নামটির আগমন ঘটেছে তুর্কী শব্দ কল্গা থেকে যার অর্থ পাতা। এই পাতাকে ‘মোটিফ’ হিসেবে ব্যবহার করে তৈরি করা হয় শাড়ি, নকশিকাঁথা ও কাশ্মীরী শাল। পীতকরবীর বৈজ্ঞানিক নাম কাস্কাবেলা থিভেটিয়া (Cascabela thevetia syn: Thevetia peruviana)। কাস্কাবেল শব্দটি ঘন্টা ও ‘র্যাট্লিং’ উভয় অর্থেই ব্যবহৃত হয়।পীতকরবীর গোলাকার ফল শুকিয়ে গেলে ভিতর থেকে বের হয় সামঞ্জস্যহীন লম্বাটে বীজ যা ঝাঁকালে ভেতর থেকে এই র্যাট্লিংয়ের আওয়াজ আসে, যে শব্দকে আমরা বাংলায় ‘কটর-কটর’ বললেই ভাল বুঝি। দুচারটি বীজ ঠোকাঠুকি লাগলে যে ধরনের শব্দ উৎপন্ন হয় তা বেশ স্বতন্ত্র, প্রকৃতিতে বিরল। ওয়েস্ট ইন্ডিজে পীতকরবীর ফল ‘লাকি নাট’ নামে পরিচিত। প্রাচীনকালে এই বীজকে ছিদ্র করে মালা বানিয়ে গলায় ধারণ করতো পেরুর অধিবাসীরা। সমবৈজ্ঞানিক নামের 'থিভেটিয়া' শব্দ থেকে বোঝা যায় এর আদি নিবাসের কথা। ষোড়শ শতাব্দিতে ফরাসী দরবেশ ও উদ্ভিদ সংগ্রাহক ‘আঁদ্রে থিভেট’ একে আবিষ্কার করেন দক্ষিণ আমেরিকায়, হয়ত পেরু অঞ্চলে, যেকারণে বৈজ্ঞানিক নামের এপিথেট-এ উল্লেখ করা হয় ‘পেরুভিয়ানা’।
আমাদের দেশে যে শ্বেত বা রক্তকরবী (Nerium oleander) দেখা যায় তা একই পরিবার অ্যাপোসিনাসিয়ি (Apocynaceae) বা ডগবেন গোত্রের অন্তর্গত। গ্রীক ‘apo’ অর্থ ‘দূরে থাকা’ এবং ‘kuon’ অর্থ কুকুর। কুকুরের অমঙ্গলের সঙ্গে জড়িত বলেই জাতের এই নাম; বাংলায় একে আমরা করবীগোত্রের বলে উল্লেখ করি, এবং পীতকরবীকে ‘হলুদ করবী’ বলে অভিহিত করি কারণ পীত অর্থ হরিদ্রা বা হলুদ। শ্বেতকরবী বা রক্তকরবীর ফল লম্বা কিন্তু পীতকরবীর ফল গোলাকার। করবীর পাতা পীতকরবী থেকে সামান্য বিস্তৃত ও বেশি সবুজ। উভয় প্রকার গাছেরই ভেষজ গুণাবলী প্রায় এক রকম, তবে পীতকরবীর বিষাক্ততা বেশি। এসব গাছের নিচে অন্য গাছ জন্মাতে দেখা যায় না, আত্মরক্ষার্থে নির্গত অ্যালিলো-রসায়নের কারণে। পীতকরবী গাছের তলদেশ বেশ পরিষ্কার থাকে, তাই ফুল বা ফল পড়ে থাকলে সহজে দৃষ্টিগোচর হয়। এই ফুল ব্যবহৃত হয় শিবপূজায়।
যদিও আমাদের দেশে উঠানে বা বাগানে পীতকরবী গাছ লাগানো হয় তবে বিদেশে অনেকে একে নিকট দূরত্বে রাখতে চান না। এর বিষাক্ত ফল গাছতলায় পড়ে থাকে যা তাদের পোষা কুকুর খেয়ে ফেলে প্রায়ই বিপদ ডেকে আনে। কুকুরকে নিয়ে তখন তড়িঘড়ি পশু হাসপাতালে দৌড়াতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে গোটা পরিবারে দুঃখ বয়ে আনে পোষা প্রাণীটার অকাল মৃত্যু।‘হাঁটিহাঁটি পা-পা’ করে চলা টড্লার (Toddler) বেবীদের নিয়ে বিপদ আরো বেশি। এই বয়সে শিশুদের মনে হয়, তার চারদিকের পৃথিবী কেবল খাবার দিয়েই তৈরি। খেতে যতই বিস্বাদ হোক, মুখ যতই বিকৃত হোক, চোখের আড়াল হলে গাছতলা থেকে টড্লার বেবী এই ফল মুখে তুলতেই পারে। অনুসন্ধিৎসার কারণে কুকুর যা কিছু সামনে পায় তাই একবার শুঁকে নেয় কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় হয় যখন সে চেখেও দেখতে চায়। হরিণ ও গবাদি পশু হিতাহিত বুঝে নিয়ে এই ফল আহার করে না। ঘোড়া কখনো এর বীজ খেলে প্রায়শ মারা যায় যে-কারণে পীতকরবীর এক নাম অশ্বমারক।
টড্লার বেবী, কুকুর ও কিছু প্রাণীর জন্য বিপজ্জনক হলেও ভিন্ন কিছু প্রাণী নিশ্চয়ই এই ফল আহার করে কারণ গাছের বংশবিস্তারের জন্য বীজের বিসরণ চাই। আমাদের দেশের বুলবুলি, ময়না এবং কোকিল এর ফল খায়, যে ফলগুলো পেকে বাদামি হয়ে বিষাক্ত অবস্থায় গাছে ঝুলতে থাকে। গাছের নিচের ঝরা ফুল কখনো গৃহপালিত মরু কচ্ছপকে খেতে দেখা যায়। বংশবিস্তারের জন্য পরাগায়ন জরুরি তাই প্রাকৃতিক কারণেই পরাগায়নকারী কীটপতঙ্গের জন্য ফুলের মধু বিষাক্ত হয় না। তবে মানুষ এর পরাগায়নকারী নয়, তাই তাদের পক্ষে এর মধু খাওয়া কতটা নিরাপদ তা ভেবে দেখা ভাল। নিউজিল্যান্ডের বিষাক্ত টুটু (Coriaria arborea) গাছের রস খাওয়া পোকা থেকে হানি ডিউ সংগ্রহ করে মৌমাছি যে মধু তৈরি করে তা বিষাক্ত। এই মধু খেয়ে অতীতে বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে।
পীতকরবী গাছের পাতা, কাণ্ড, শিকড় ও ফল সবই বিষাক্ত, ফলের দেহেই এর তীব্রতা সবচেয়ে বেশি। ১৯৯৬ সালে ঋণের দায়ভার ও দারিদ্র্যের কারণে শ্রীলঙ্কায় ৯০০০ মানুষের আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল পৃথিবীর জন্য এক ভীতিজনক পরি্সংখ্যান।পীতকরবীর বিষে আক্রান্ত হয়ে একটানা ৩ বছরের হিসাবে ৩৫১ জনের মধ্যে মারা গেছে মাত্র ২ জন (M. Eddleston)। অতএব সুইসাইড ও হোমিসাইডের জন্য করবী বিষ তেমন কার্যকরী নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আত্মহননকারীরা সন্ধ্যার পরে করবীর বিষ খেয়েছে যার ভিতরে পীতকরবীর ফলই প্রধান। সকালে করবী বিষ খেলে দেহে এর ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া হয় অনেক বেশি, রাতে খেলে এর কার্যকারিতা কমে যায়। ভোরবেলা বিষের তীব্রতার পেছনে বাসি পেটে ফল খাওয়া ছাড়াও অন্য আরো অজ্ঞাত কারণ থাকতে পারে। বিষ খাওয়া মানুষকে চিকিৎসার জন্য দ্রুত হাসপাতালে স্থানান্তর করা উচিৎ। রোগীকে অ্যাক্টিভেটেড চারকোল খাওয়ালে কিছু বিষ দ্রুত শোষিত হতে পারে।
পৃথিবীর বিভিন্ন উপজাতীয় এলাকার মানুষ পীতকরবীর বিষকে তীরের মাথায় লাগিয়ে নেয় পশু ঘায়েল করার জন্য। কৃষিক্ষেতে ও ঘরে ইঁদুরজাতীয় প্রাণীকে মারার জন্যও এই বিষ ব্যবহার করা হয়। জলাশয়ে পীতকরবীর বিষ ছড়ালে মাছ উপরে ভেসে ওঠে, এতে মাছ ধরা সহজ হয়। অতীতে নানা দেশে করবী-বিষ ব্যবহৃত হয়েছে উৎকৃষ্ট বমনকারক হিসাবে এবং ম্যালেরিয়া, জন্ডিস, অন্ত্র-কৃমি, মূর্চ্ছা, ঘুসঘুসে জ্বর, কোষ্ঠকাঠিন্য ও মৃগীরোগে। আধুনিক কালে এর ব্যবহার হচ্ছে হার্টের চিকিৎসায়, ভবিষ্যতে ব্যবহার হবে ক্যান্সার এবং এইড্সের মতো কঠিন রোগেও।
পীতকরবী গাছ থেকে কার্ডিয়াক গ্লাইকোসাইড পাওয়া যায় যার ভিতরে আছে থিভেটিন, সেরেব্রিন ও নেরিফোলিন। কার্ডিয়াক স্টেরয়েডের মধ্যে থাকে পেরুভোসাইড যা নিয়ে সবচেয়ে বেশি গবেষণা হয়েছে হার্টের অসুখ নিরাময়ের জন্য। চীন ও রাশিয়াতে হার্টের চিকিৎসায় করবী-বিষের ব্যবহার বেশ দেখা যায় তবে সমস্যা হলো, এই ওষুধের মাত্রা নির্বাচন করা খুব কঠিন কাজ কারণ, বিষকে পরীক্ষার সময় পাকস্থলি ও হার্টকে বিষক্রিয়ায় অকার্যকর করে ফেলে। বিজ্ঞানীরা উপলব্ধি করেছেন, পীতকরবীর বিষে বর্তমান পৃথিবীর বহু কঠিন রোগ নিরাময়ের ক্ষমতা থাকতে পারে কিন্তু বিষের অজানা ক্ষতিকর দিক ও তীব্রতার কারণে গবেষণার গতি স্তিমিত হয়ে আছে কয়েক যুগ ধরে।
তথ্য সূত্র : ইন্টারনেট

সাম্প্রতিক মন্তব্য


শামিমা নাসরিন সনিয়া
লাইক ও রেটিং সহ আপনার জন্য শুভ কামনা রইলো। আমার আপলোডকৃত কনটেন্ট দেখে লাইক ও রেটিং সহ আপনার সুচিন্তিত মতামত প্রদানের জন্য বিনীত অনুরোধ রইল। কন্টেন্ট লিংকঃ https://www.teachers.gov.bd/content/details/1277445

সুশিল চন্দ্র রায়
লাইক ও রেটিংসহ আপনার জন্য শুভকামনা। আমার আপলোডকৃত কনটেন্ট ও ব্লগ দেখে আপনার মূল্যবান মতামত ও পরামর্শ প্রত্যাশা করছি।

জাহিদুল ইসলাম
আসসালামু আলাইকুম/আদাব। লাইক ও রেটিংসহ আপনার জন্য শুভকামনা। আমার আপলোডকৃত কনটেন্ট ও ব্লগ দেখে আপনার মূল্যবান মতামত ও পরামর্শ প্রত্যাশা করছি। কনটেন্ট লিংক: https://www.teachers.gov.bd/content/details/1273517

জামিলা খাতুন
লাইক ও রেটিংসহ আপনার জন্য শুভকামনা। আমার আপলোডকৃত কনটেন্ট ও ব্লগ দেখে আপনার মূল্যবান মতামত ও পরামর্শ প্রত্যাশা করছি।
মতামত দিন