Loading..

ব্লগ

রিসেট

৩০ জুন, ২০২৪ ০৪:৫৫ অপরাহ্ণ

ইসলামে মুদ্রার গুরুত্ব : দৈনিক সংগ্রাম : বুধবার ১৭ জানুয়ারি ২০২৪ | প্রিন্ট সংস্করণ


মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান 


মানব সভ্যতার ইতিহাসে মুদ্রার উদ্ভাবন এক বিরল ঘটনা। আদিম ও প্রাচীন সমাজে মুদ্রার ব্যবহার না থাকলেও আধুনিক জগতে প্রতিটি সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থা এতই জটিল হয়েছে যে, মুদ্রা ব্যবস্থা ও মুদ্রার ব্যবহার না থাকলে সভ্যতার চাকা অচল হয়ে পড়বে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এই অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির উন্নয়নের ক্ষেত্রে ইসলামের অবদান অনস্বীকার্য। কুরআন মাজীদ ও হাদীসে “দ্রব্য বিনিময়” প্রথার পরিবর্তে একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী মুদ্রা ব্যবস্থা গড়ে ওঠেছিল, যা গোটা পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠির নিকট ‘হার্ড কারেন্সি’ হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। 


মুদ্রা বা অর্থকে আরবী ভাষায় আন-নুকূদ বা আল-আমালা বলা হয়। ইংরেজীতে বলা হয় Money বা ‘Currency’। পূর্বেকার ফিক্হবিদগণ নুকূদ বা মুদ্রা বলতে শুধু স্বর্ণমুদ্রা এবং রৌপ্য মুদ্রাকেই বুঝাতেন। তবে কাগজি মুদ্রা আবিষ্কারের পর ফিক্হবিদগণও অর্থনীতিবিদদের মতই নুকূদ বা মুদ্রা বলতে এমন কোন বস্তুকেই বুঝান যা কোন দ্রব্য কিংবা সেবার বিনিময় মূল্য হিসেবে প্রদান করা হয়। স্বর্ণ হোক কিংবা রৌপ্য অথবা অন্য কোন ধাতু কিংবা কাগজি মুদ্রা হোক বর্তমানকালে আধুনিক ফিক্হবিদগণ এবং অর্থনীতিবিদদের মধ্যে এ ব্যাপারে কোন পার্থক্য নেই।


যে পদ্ধতির সাহায্যে দেশের অর্থের জোগান ও এর মূল্য নিয়ন্ত্রিত হয় তাকে মুদ্রাব্যবস্থা বলে। দেশের অর্থনৈতিক কর্মপ্রবাহ অক্ষুণ্ন রাখার উদ্দেশ্যে অর্থের যথোপযুক্ত যোগানের বন্দোবস্ত করে দেশের দাম স্তর ও অর্থের মূল্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখাই মুদ্রাব্যবস্থার লক্ষ্য। সুতরাং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মুদ্রাব্যবস্থার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। 


ইসলামী অর্থনীতিবিদদের মতে, মানুষের প্রয়োজনের তাগিদে কয়েকটি স্তর বা ধাপের মধ্য দিয়ে মুদ্রার উৎপত্তি হয়েছে। আদিম যুগে মানুষ মুদ্রার তেমন কোন প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। কেননা তখন প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী পর্যাপ্ত পরিমাণে বিদ্যমান ছিল। কোন দ্রব্য বা সেবা কর্ম খরিদ করার প্রয়োজন ছিল না। তখন প্রত্যেক ব্যক্তি তার প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং আশ্রয়স্থল নিজেই তৈরী করতো। অন্যের তৈরী বস্তুর কোন প্রয়োজন হয় নি। কেননা তখন মানুষের জীবনযাত্রা ছিল অতীব সহজ সরল ও সাদাসিধে। এ স্তর বা যুগকে অর্থনীতির পরিভাষায় বলা হয় ‘ব্যক্তির অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনের যুগ’। এরপর ধীরে ধীরে মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে লাগলো এবং মানুষের প্রয়োজনও অনেক গুণে বৃদ্ধি পেল। তখন মানুষ অনুভব করল, তার বহুবিধ চাহিদা নিজে নিজে পূরণ করা সম্ভব নয়। এজন্য তাকে অন্যের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে, অন্যের তৈরী দ্রব্য সামগ্রী তার নিজের প্রয়োজন মেটানোর জন্য বিশেষ প্রয়োজন। তখন থেকে মানুষ ছোট ছোট দল গঠন করতে লাগল এবং কর্ম বিভাজন শুরু করল। প্রত্যেক ব্যক্তি কোন একটি বিশেষ দ্রব্য উৎপাদন কাজে নিয়োজিত হতে লাগলো। এভাবে কেউ খাদ্য তৈরী, কেউ বা বস্ত্র তৈরী, কেউ বা আশ্রয়স্থল নির্মাণে নিয়োজিত হলো। অর্থনীতিতে একে বলা হয় ‘শ্রম বিভাজন’ এবং এ যুগকে বলা হয় ‘দলীয় স্বাবলম্বনের যুগ’। 


তারপর মানুষ বহু দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং মানুষের চাহিদা ও প্রয়োজন বহুমুখী হয়ে ওঠে। তখন বিভিন্ন পণ্য দ্রব্যের উৎপাদনও অনেক গুণে বৃদ্ধি পায়। মানুষর জীবনযাত্রা অনেকটা স্থায়িত্ব পায় এবং মানুষ কৃষি কাজে নিয়োজিত হয় এবং বড় বড় দলীয় বন্ধনে আবদ্ধ হতে থাকে। তখন থেকে মানুষ বিভিন্ন পণ্য দ্রব্যের আন্ত:বিনিময়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। অর্থনীতিতে এই স্তরকে বলা হয় ‘পরস্পর বিনিময়ের অর্থনৈতিক স্তর’। বিনিময়ের এ স্তর দীর্ঘদিন যাবৎ চলতে থাকে। পরবর্তীতে এই স্তরে মানুষের মধ্যে বিনিময়ের ক্ষেত্রে অনেক জটিলতা সৃষ্টি হয় এবং মানুষ দ্রব্য বিনিময়ের কোন সহজ পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। 


এ পর্যায়ে মানুষ দ্রব্য বিনিময়ের জটিলতা ও সমস্যা প্রকটভাবে অনুভব করে এবং চিন্তা করতে থাকে বিশেষ কোন একটি দ্রব্যকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে নির্ধারণ করার জন্য যা দ্রব্য ও সেবার মূল্য পরিমাপক হিসেবে গণ্য হবে। একে ‘দ্রব্য বিনিময় প্রথা’ বলা হয়। বিনিময়ের এ স্তর বহু যুগ ধরে চলতে থাকে। এর কিছুদিন পর আরেকটি উন্নত পর্যায় আবিষ্কৃত হয়, যে স্তরে মানুষের ব্যবসায়-বাণিজ্যের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয় এবং সহজতর হয়। এ পর্যায়ে কোন একটি বিশেষ দ্রব্যকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে সকল ক্রেতা ও বিক্রেতা গ্রহণ করে এবং তাদের দ্রব্য সামগ্রীর মূল্য পরিমাপক হিসেবে নির্বাচন করে নেয় যেমন- চামড়া, অলংকার, হাতিয়ার, যন্ত্রপাতি এবং অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদি। এ স্তরকে ‘বস্তু মুদ্রা অর্থনীতি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। কেউ কেউ একে ‘দ্রব্য মুদ্রা পদ্ধতি’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তবে এখানে উল্লেখ্য যে, উপরোক্ত ধাপগুলো একটি আরেকটি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ছিল না বরং পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ছিল। উল্লেখ্য যে, মুদ্রার উৎপত্তির উপরোক্ত ধাপগুলোর সুনির্দিষ্ট কোন সময়কাল জানা যায়নি। কারণ এ ধাপগুলোতে কোন বিষয় লিখিতভাবে লিপিবদ্ধ করে রাখার প্রচলন ছিল না, কেননা এগুলো ছিল ইতিহাসপূর্ব যুগের ঘটনাবলী। 


এরপর ইসলামের আবির্ভাবের পূর্ব যুগে মানুষের জীবনযাত্রা আরও জটিল হয়ে পড়ে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা আরও বৃদ্ধি পায়। শ্রম বিভাজন আরো ব্যাপক হয়ে পড়ে, বিনিময় পরিসর আরো বৃদ্ধি পায়, তখন দ্রব্যের বিনিময়ে দ্রব্য প্রথা অচল হতে থাকে। সেটা আর মানুষের বিনিময় প্রয়োজন মিটাতে সক্ষম হল না। তখন মানুষ এমন একটা মুদ্রার প্রয়োজন অনুভব করল যার মূল্যমান অধিক হবে, সহজে বহনযোগ্য হবে, দীর্ঘস্থায়ী হবে, যার মূল্যমান ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত করা যাবে এবং যার মাধ্যমে ছোট বড় সব ধরনের বস্তু ক্রয়-বিক্রয় করা সম্ভব হবে। মানুষের এ প্রয়োজন ও অর্থনৈতিক চিন্তার উপর ভিত্তি করে ‘দ্রব্য মুদ্রা’ প্রথার পরিবর্তে তখন ‘ধাতব মুদ্রা’ প্রথার প্রচলন হলো। ধাতব মুদ্রা মানুষের বিনিময় ব্যবস্থাকে অনেক উন্নত ও সহজতর করে দেয়। ধাতব মুদ্রাই তখন সকল দ্রব্যের মূল্য পরিমাপক হিসেবে গণ্য হয়। এ সময় মানুষ স্বল্পমূল্যের ধাতব যেমন লোহা, ব্রোঞ্জ, নিকেল ইত্যাদিকে মুদ্রা হিসেবে গ্রহণ করে। 


ডঃ ফৌজি আতাবি বলেন, “প্রথম ধাতব মুদ্রা ব্যবস্থার প্রচলন হয় যিশুখৃস্টের জন্মের তিন হাজার বছর পূর্বে। বহু বৎসর পর্যন্ত এ মুদ্রার প্রচলন চলতে থাকে এবং পরবর্তীতে স্বর্ণ ও রৌপ্যকে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তখন ধীরে ধীরে অন্যান্য ধাতব মুদ্রার ব্যবহার হ্রাস পায় এবং স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার ব্যবহার বৃদ্ধি পায়, কারণ স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার বিনিময় মূল্য অনেক বেশী। এটা সহজে বহনযোগ্য ও দীর্ঘস্থায়ী। ফলে এ দুটো মুদ্রাই তখন সর্বসাধারণের নিকট অধিক গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়।


এক গবেষণায় বলা হয়, যিশুখৃস্টের জন্মের ৭০০ বছর পূর্বে প্রথম রৌপ্য মুদ্রার প্রচলন হয়। অন্য এক গবেষণায় বলা হয়, প্রথম রৌপ্য মুদ্রার ব্যবহার শুরু হয় যিশুখৃস্টের জন্মের ২৬৯ বছর পূর্বে। স্বর্ণমুদ্রার প্রচলনের ব্যাপারে অন্য এক গবেষণায় বলা হয়, যিশুখৃস্টের জন্মের ২০৬ বছর পূর্বে প্রথম স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন হয়। 


প্রথমে মানুষ যখন স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার প্রচলন শুরু করে এবং এর গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও বৈশিষ্ট্য অনুভব করল তখন থেকে বিভিন্ন ধরনের, বিভিন্ন ওজনের মুদ্রা তৈরি হতে লাগল। পরবর্তীতে বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা ও জালিয়াতী কারবার চলতে থাকে। তখন এ সমস্যা নিরসনের জন্য সরকারী হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়। তখন থেকে ব্যক্তির পরিবর্তে সরকার বা রাষ্ট্রের উপর স্বর্ণমুদ্রা ও রৌপ্যমুদ্রা প্রচলনের দায়িত্ব ন্যস্ত হয় এবং মুদ্রার প্রকৃত মূল্যের সাথে বাজার মূল্যের সমন্বয় হয় এবং মানুষ স্বাধীনভাবে স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রার বিনিময়ে কারবার করতে থাকে। 


এ স্তরে গোটা পৃথিবী আরেকটি নতুন শিল্পে প্রবেশ করে। তা হল ‘মুদ্রা তৈরী শিল্প’। এ মুদ্রা তৈরী শিল্প প্রথমে এশিয়া তারপর ইউরোপে প্রবেশ করে। তখন হতে মুদ্রার উভয় পার্শ্বে বিভিন্ন নকশা সম্বলিত এবং প্রচলনকারী সরকারের ছবি কিংবা সিলমোহরসহ তৈরী হতে থাকে। স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা বিভিন্ন নামে পরিচিত হতে থাকে যেমন স্বর্ণমুদ্রাকে দিনার এবং রৌপ্য মুদ্রাকে ‘দিরহাম’ বলা হতো। ব্যবসায়-বাণিজ্যের বিস্তারের মাধ্যমে পৃথিবীর বৃহৎ সাম্রাজ্য রোম সাম্রাজ্যে স্বর্ণমুদ্রা ব্যবহৃত হতো ‘দিনার’ নামে এবং পৃথিবীর আরেকটি বৃহৎ ক্ষমতাধর সাম্রাজ্য পারস্যে রৌপ্যমুদ্রা ব্যবহার হতো ‘দিরহাম’ নামে। এ সময় এ দুটো সাম্রাজ্যের সাথেই আরবদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, যোগাযোগ ও ব্যবসায় বাণিজ্য পরিচালিত হতো। ব্যবসা বাণিজ্যের কাজ সম্পাদিত হতো মুদ্রার বিনিময়ে। এ কারণে আরব দেশে তখন ‘দিনার’ ও ‘দিরহাম’ উভয় মুদ্রার প্রচলন ছিল। 


গোটা পৃথিবীতে বহু শতাব্দিকাল থেকে ধাতব মুদ্রার প্রচলন বিদ্যমান থাকলেও শিল্প বিপ্লবের পরের পৃথিবীর বিনিময় মাধ্যম হিসেবে চাহিদা মিটাতে ধাতব মুদ্রা অক্ষম হয়ে পড়ে। গোটা পৃথিবীর ব্যবসায়-বাণিজ্য আর লেনদেনের পরিমাণ এতই বৃদ্ধি পায় যে, স্বর্ণমুদ্রা কিংবা রৌপ্য মুদ্রার মাধ্যমে এ বিশাল চাহিদা পূরণ করা সম্ভব ছিল না। পৃথিবী তখন এমন আরেকটি মুদ্রার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে যার মাধ্যমে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক লেনদেন ব্যবসায়-বাণিজ্য ও কারবারের বিনিময় মাধ্যম ও মূল্য পরিমাপক হিসেবে যোগান দেয়া সম্ভব, যার যোগান ধাতব মুদ্রার মত সীমিত থাকবে না। আর তখনই আবিষ্কার হল ‘কাগজী মুদ্রা’। ১৭শ শতাব্দিতে ইউরোপে বিশেষ করে ইংল্যান্ডে কাগজি মুদ্রার প্রথম প্রচলন শুরু হয়। যদিও কাগজি মুদ্রা অনেকগুলো ধাপ বা স্তর অতিক্রম করে আজকের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। অর্থনীতিবিদদের ধারণা, কাগজি মুদ্রা এ পরিণত পর্যায়ে পৌঁছাতে প্রায় তিন শত বছরেরও বেশী সময় পার হয়েছে। মুদ্রার ইতিহাসে কাগজি মুদ্রার আবিষ্কার এক বিরল ঘটনা। 


ইসলামী মুদ্রা ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, দ্বি-ধাতুমান মুদ্রাব্যবস্থা। ইসলামের আবির্ভাবের পর সাময়িকভাবে রোম সাম্রাজ্যের স্বর্ণমুদ্রা এবং পারস্য সাম্রাজ্যের রৌপ্য মুদ্রা- এ দুটি মুদ্রাই যুগপৎভাবে ইসলামী রাষ্ট্রে প্রচলিত ছিল। অতঃপর উমর রা. উক্ত মুদ্রা দুটির আকার আকৃতির কিছু পরিবর্তন এবং ইসলামী ভাবধারার কিছু শব্দাবলী সংযোজন করে ইসলামী মুদ্রা প্রচলন করেন। পরবর্তীতে খলীফা আব্দুল মালিক এবং উমাইয়া ও আব্বাসীয় খলিফাদের আমলে আরো অনেক পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে ইসলামী মুদ্রার প্রচলন করা হয়, যা ইসলামের সুদীর্ঘ শাসনামলে প্রচলিত ছিল। ইসলামী মুদ্রা ব্যবস্থার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল, দেশের অভ্যন্তরে প্রচলিত বিহিত মুদ্রার ধাতবমান। ইসলামী অর্থব্যবস্থায় বিহিত মুদ্রার অবশ্যই ধাতব মূল্য থাকতে হবে, কিংবা অবশ্যই তা পরিবর্তনীয় হতে হবে। এ অর্থে ইসলামে বিভিন্ন দেশে প্রচরিত কাগজি মুদ্রাকে সমর্থন করে কিন্তু এটাকে অবশ্যই পরিবর্তনীয় মুদ্রা হতে হবে। অর্থাৎ এ মুদ্রার বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সমপরিমাণ কিংবা ন্যূনতম পরিমাণ স্বর্ণ কিংবা রৌপ্য থাকতে হবে, যাতে জনসাধারণ ইচ্ছে করলে সরকারের নিকট থেকে কাগজি মুদ্রার পরিবর্তে ধাতব মুদ্রায় পরিবর্তন করে নিতে পারে, কিংবা এমন বৈদেশিক মুদ্রা থাকতে হবে যার বিপরীতে নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ কিংবা রৌপ্য ঐ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গচ্ছিত রয়েছে যেমন মার্কিন ডলার। 


ইসলামী মুদ্রা ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, এটা সুদমুক্ত ব্যবস্থা। ইসলাম সুদকে যুলুম, নির্যাতন ও অর্থনৈতিক শোষণের হাতিয়ার আখ্যা দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি বরং মানবতার মুক্তির সনদ সুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে আল্লাহ বলেন, “হে মুমিনগণ! তোমরা সুদ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিরত থাক, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক। আর যদি তা না কর তাহলে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধ ঘোষণা করা হচ্ছে। আর তোমরা যদি তা থেকে বিরত থাক এবং তওবা কর তাহলে তোমরা তাতে বিনিয়োগকৃত তোমাদের মূল পুঁজি গ্রহণ করতে পারবে। তোমরা কাউকে যুলুম করবে না এবং তোমরাও কারো যুলুম নির্যাতনের শিকার হবে না”। রসূলুল্লাহ স.-এর পবিত্র হাদীসে কঠোরভাবে সুদ গ্রহণ, ভক্ষণ ও সুদের কারবারে সাক্ষ্য প্রদানকে শুধু নিষিদ্ধ বা হারামই করা হয়নি বরং তিনি তাদের প্রতি আল্লাহর অভিশাপ বর্ষণ করেছেন। আর এ জন্যেই ইসলামী মুদ্রাব্যবস্থা এ অভিশপ্ত সুদকে সম্পূর্ণরূপে পরিহার ও বর্জন করেছে। 


ইসলামী মুদ্রা ব্যবস্থা সুদ বর্জন করা ছাড়াও ইসলামী শরীয়তের সকল নির্দেশাবলী মেনে চলতে বদ্ধপরিকর। ইসলামী শরীয়তের নীতিমালা অনুযায়ী এর সকল কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ইসলামী ব্যাংকের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, কার্যবিধি ও কর্মপদ্ধতিতে ব্যাংক সম্পূর্ণরূপে ইসলামী শরীয়ার অনুসারী। আমানত গ্রহণ, বিনিয়োগ ও পরামর্শ প্রদানসহ সকল ক্ষেত্রেই ইসলামী শরীয়ার বিধি-নিষেধের প্রতি খেয়াল রাখা ইসলামী ব্যাংকের কর্তব্য। 

আরো দেখুন