সহকারী শিক্ষক
১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ০৮:২২ অপরাহ্ণ
অন্য আলোয় বিদ্যাসাগর
"অন্য আলোয় বিদ্যাসাগর "
ওমর ফারুক
উপমহাদেশে ব্রিটিশরা শোষণ করেছে প্রায় ২০০ বছর। এতো অধিক সময় কোনো দেশ বা মহাদেশে ব্রিটিশ কলোনি ছিলো না।ঔপনিবেশিক শাসনের সময় শোষণ হয়েছে অতিমাত্রায়। মুসলিম সাম্রাজ্য প্রায় ৮০০ বছর স্পেন শাসন করেছে।১২০৪ থেকে ১৮৫৭ পর্যন্ত(খিলজি,লুদি,মামলুক,তুঘলক, সুলতানী আমল,মহিসূর,সূরী,কররাণি,শাহ,মুঘল আমল) উপমহাদেশে শাসন করেছে।তারপর চালু হয় কোম্পানির শাসন। তিনটি মহাদেশে রাজ্য স্থাপন করেছিলো অটোম্যানরা।উসমানীয়, আব্বাসীয়, ফাতেমীয় শাসকেরা দীর্ঘদিন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ, রাজ্য শাসন করেছে।ইতিহাস তাদের শোষক হিসেবে চিহ্নিত করেনি বা করতে পারেনি।ব্রিটিশ শাসনকে শোষণের ইতিহাস এই কারণে বলা হয় যে ব্রিটিশরা এদেশে বণিকের বেশে এসেছিল।তারা বাণিজ্য করার নামে এদেশে দুর্গ তৈরি করে।তারপর তারা যখন দেখলো উপমহাদেশের লোকজন সহজ-সরল, তারা রাজনীতি বোঝে না।এদেশের লোকদের মধ্যে কূটনীতি নেই, সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার তারা জানেনা। এদেশের লোকদের অস্ত্র বিদ্যা জানা নেই, আধুনিক মারণাস্ত্র সম্পর্কে তাদের কোনই জ্ঞান নেই।আর ভ্রাতৃঘাতী মনোভাবই বজায় আছে।এই কারণগুলো উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের পথ তরান্বিত করে।উপমহাদেশে একই সময়ে বাণিজ্য করতে আসে ডেনিশ (দিনেমাররা), ফরাসিরা (ফিরিঙ্গিরা)।ফরাসিরা বিভিন্ন স্থানে দুর্গ নির্মাণ করেছিল।ফরাসি এবং ইংরেজি দুটো জাতির মনোভাব একই ছিল।তারা এদেশে রাজ্যস্থাপণে তৎপর ছিলো। ফরাসিরা অর্থাৎ ফিরিঙ্গিরা ইংরেজদের কাছে পরাজিত হয় কূটকৌশল আর নৌশক্তির কারণে। ফরাসিরা শিল্প,সাহিত্যের সমঝদার ছিলো। ফিরিঙ্গিরা এদেশে জয়ী উপমহাদেশের ইতিহাস অন্যরকম হতে পারতো। কলোনিয়াল শাসনের সবটা খারাপ ছিলো এটা বলার অবকাশ নেই।ব্রিটিশরা এদেশ থেকে শোষণ করে নিয়ে বার্কিংহাম প্রাসাদ, ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিট, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও স্থাপনা গড়েছে।এদেশের সম্পদে সমৃদ্ধ হয়েছে যুক্তরাজ্য। ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা সবাই করেনি।আবার সবাই সহযোগিতাও করেনি।ব্রিটিশ যুগে তিনটি শ্রেণি গড়ে উঠেছিল।প্রথম শ্রেণি সরাসরি ইংরেজদের সহযোগিতা করেছে, দ্বিতীয় শ্রেণি ইংরেজদের কোনো প্রকার সহযোগিতা করেনি, তৃতীয় শ্রেণি ইংরেজদের থেকে সুবিধা নিয়ে ভারতবর্ষকে উন্নত করতে চেয়েছে।প্রথম শ্রেণি দেশদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক তকমা পেয়েছে। এ শ্রেণির তালিকা দীর্ঘ এবং এদের ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হয়নি।দ্বিতীয় শ্রেণি বীর, দেশপ্রেমিক। তাদের নিয়েই জাতির গৌরব, জাতির ইতিহাস। তাঁরা ইংরেজ শাসনের শুধু বিরোধিতাই করেনি, ইংরেজদের এদেশ থেকে বিপ্লবের মাধ্যমে তাড়িয়ে দিতে এরা ছিল বদ্ধপরিকর। এদের কথা পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু তৃতীয় যে শ্রেণিটি ছিলো এদের নাম পড়ে যায় মধ্যসত্ত্ব সুবিধাভোগী হিসেবে।এ দলে ছিলেন মহাত্মা গান্ধী, চিত্তরঞ্জন দাশ, বিবেকানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়,ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজা রামমোহন রায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়,জগদীশ চন্দ্র বসু, নবাব আব্দুল লতিফ, বেগম রোকেয়া,স্যর সৈয়দ আহমদ খান,স্যর আমীর আলী, হাজী মোহাম্মদ মহসিন, হাজি দানেশ,শ্যামা প্রসাদ প্রভৃতি। এরা ইংরেজদের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখতেন।কারণ তারা বুঝেছিলেন সহজে বা যেনতেন ভাবে ইংরেজদের এদেশ থেকে বিতাড়িত করা যাবেনা। এজন্য অনেকে ইংরেজ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করেছেন।ইংরেজদের সাথে থেকেই ভারতবাসীর সেবা করেছেন, ভারতবর্ষকে উন্নত করার চেষ্টা করেছেন।এদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগামী ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ইংরেজ শাসনের বিরোধিতা করেননি। ইংরেজ সরকারের সাথে থেকে ভারতবর্ষকে আলোর পথ দেখিয়েছেন। কোম্পানি সরকার থেকে বিভিন্ন সাহায্য, সহযোগিতা নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে স্কুল, কলেজ স্থাপন করেছেন।এদেশে শিক্ষার প্রসার ঘটাতে তিনিই প্রথম চেষ্টা চালান এবং সফল হন।ইংরেজ সরকারের সাথে সুসম্পর্ক থাকার দরুন তিনি এদেশে সহজেই বিধবা বিবাহের প্রচলন করতে পারেন।ঈশ্বরচন্দ্রের সময়টা ছিলো ১৮২০-১৮৯১।ব্রিটিশ শাসন তখন তুঙ্গে।তাঁর যৌবনেই সিপাহি বিদ্রোহ অনুষ্ঠিত হয়।তিনি এসবে মন দেননি। তাঁর ধ্যান ছিলো রাজ শক্তি থেকে কিভাবে সহযোগিতা নিয়ে এদেহভশে শিক্ষার আলো জ্বালানো যায়।কিভাবে সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর করা যায়।স্কুল প্রতিষ্ঠা করে যখন শিক্ষার আলো পুরোটা জ্বালানো যাচ্ছিলো না তখন তিনি সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন।শিশু শিক্ষায় "বোধোদয় " এবং "আদর্শ পাঠ " বিদ্যাসাগরের অমরকীর্তি।তিনি নারী শিক্ষার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে ২০০ টি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।যারা দেশের জন্য কিছু করতে পারবে কিংবা দেশ ও জনগণের জন্য যাদের করার কিছু আছে এমন ব্যক্তিকে বিদ্যাসাগর অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছেন।মানুষই তাঁর কাছে বড় বিষয় ছিলো। তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্তকে বিদেশবিভুঁইয়ে অর্থ সাহায্য পাঠাতেন। তিনি মনে করতেন, "মধুসূদন বাংলাসাহিত্যের সম্পদ,তাঁকে বাঁচাতে হবে।" বিদ্যাসাগরের সবচেয়ে বড় অবদান এ সমাজ থেকে কুসংস্কার, অজ্ঞতা দূরীকরণে কাজ করে যাওয়া। সমাজে ন্যায়বোধ প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন কাজ করে গেছেন।বাঙালির জন্য বিদ্যাসাগর পাঠ জরুরী।
৩৪
৬৫ মন্তব্য