Loading..

ব্লগ

রিসেট

১১ জুন, ২০২৫ ০৮:২৫ অপরাহ্ণ

সুশিক্ষাই আলোকিত মানুষের জন্মদাতা

সুশিক্ষা বলতে আমরা প্রকৃতপক্ষে কী বুঝি। শিক্ষার সঙ্গে সুশিক্ষার সম্পর্ক কী অথবা পার্থক্য কতটুকু। সুশিক্ষিত ব্যক্তি কে। এসব প্রতিটি প্রশ্নই শিক্ষার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। আমাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য সুশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া বা করে তোলা। কেবল শিক্ষিত হওয়ার ফল আজ আমরা জাতি হিসেবে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। সার্টিফিকেটনির্ভর শিক্ষার পরিণতি যে মোটেই শুভ হয় না, তা এত দিনে বুঝে গেছি। তাই শিক্ষিত হয়েও শিক্ষার হার বৃদ্ধি করেই দেশের অন্ধকার দূর করতে এত বেগ পেতে হচ্ছে। যদি সুশিক্ষার মূল লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হতে পারতাম, তাহলে এই অবস্থার সৃষ্টি হতো না। সুশিক্ষা হলো সেই শিক্ষা, যা মানুষের বিবেক নৈতিকতার পথে ধাবিত করে। মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলে সমাজেও সেই মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটাতে ভূমিকা পালন করে এবং আরো প্রকৃত মানুষ গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিক্ষা ব্যক্তিকে কোনদিকে চালিত করবে, সেটা নির্ভর করে শিক্ষাগ্রহণকারী ব্যক্তি ভবিষ্যতে তার জীবনে শিক্ষার প্রয়োগ কীভাবে করছে, তার ওপর। তাই বলা হয়েছে, সুশিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত। একজন সুশিক্ষিত মানুষের সার্টিফিকেট অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে মানবিক, নৈতিক, আবেগিক গুণ অর্জন করা, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়া এবং উদ্বুদ্ধ করা ইত্যাদি আরো এ রকম মানবিক গুণাবলি অর্জন করা প্রয়োজন। আমরা জীবনের শুরু থেকে দুভাবে শিক্ষা লাভ করে থাকি। এক ধরনের শিক্ষা যা আমাদের জীবনব্যাপী বিদ্যমান থাকে এবং সর্বক্ষেত্রেই সহায়ক হয় সেই শিক্ষা। আর অন্যটি হলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। যা স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকে শুরু হয় এবং নির্দিষ্ট সময় শেষও হয়।

প্রকৃতপক্ষে শিক্ষাগ্রহণ কোনো দিনও শেষ হয় না বরং তা চলমান একটি প্রক্রিয়া এবং জীবনের অংশ। এটি হলো প্রথম প্রকারের শিক্ষা। সামাজিক আচার-আচরণ, পারিবারিক মূল্যবোধ অর্জন, মিথস্ক্রিয়া, সততার মতো গুণাবলির শিক্ষাগ্রহণ এবং ধারণ করার শিক্ষা মূলত সুশিক্ষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। আর দ্বিতীয় প্রকারের শিক্ষা শেষ হয় একগাদা সার্টিফিকেট দিয়ে ফাইল ভর্তি করার পর। এই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যক্তিকে তার কর্মে স্বনির্ভর হতে সাহায্য করে, জীবনে নৈতিকতার শিক্ষা দেয়, সততার শিক্ষা দেয়। সর্বোপরি তাকে চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতার জন্য উপযুক্ত করে তোলে। যে কারণে আজ সমাজে মিথ্যা বলার প্রবণতা, অসৎ পন্থা অবলম্বন করার প্রতিযোগিতা, অন্যকে আঘাত করার প্রতিযোগিতা, বিলাসিতা বা প্রতারণার মতো অপরাধে ছেয়ে গেছে সমাজের সর্বত্র। এর কারণ হলো নৈতিকতার শিক্ষা রয়েছে ঠিক কিন্তু চর্চার অভাব প্রকট। উদাহরণস্বরূপ পরিবারে শিশুকে শেখানো হচ্ছে যে, মিথ্যা বলা অন্যায়। অথচ সেই শিশু দেখছে যে, মিথ্যা কথার চর্চা সমাজে হচ্ছে নিয়মিত এবং এই মিথ্যা দ্বারা বহু ঝামেলা থেকে বেঁচেও যাচ্ছে অনেকে। এই দুই ধরনের বিপরীতধর্মী অবস্থান তার মনে সংশয়ের সৃষ্টি করছে। মিথ্যা বা অসততার ফল যে খারাপ এই বাস্তবতা তাকে শেখাতে হবে। যদি তা শেখে এবং সত্য বলার চর্চা করে, তাহলে তার সুশিক্ষিত হওয়ার পথে অগ্রসর হচ্ছে। অর্থাৎ শিক্ষিত হয়ে গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার গুণগুলো বাস্তব জীবনে অভ্যাস করা এবং বদঅভ্যাসগুলো বর্জন করার শিক্ষায় শিক্ষিত হলে তাকে সুশিক্ষিত হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া যায়। শিক্ষার কাজ হলো আচরণের স্থায়ী পরিবর্তন সাধন করা। আচরণের ইতিবাচক পরিবর্তন না হলে শিক্ষার প্রয়োগ সঠিক হয়নি বলে ধরা যায়। তাহলে শিক্ষিত এবং সুশিক্ষিত এই দুয়ের পার্থক্য কেন বেড়েই যাচ্ছে ক্রমশ।

জন্মের পর থেকে শিশু মা-বাবার কাছ থেকে যে শিক্ষা পাচ্ছে, তা নিয়ে সে বড় হচ্ছে। তার পারিবারিক মূল্যবোধ তার ওপর প্রভাব ফেলছে। কোনো পরিবারে মা বাবার সঙ্গে সন্তানের দূরত্ব তার মনের ওপর প্রভাব ফেলছে। সবাইকে নিয়ে গড়ে ওঠার শিক্ষা সে পাচ্ছে না। আজ যখন বড় বড় ডিগ্রি নিয়েও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ না হয়ে বড় বড় দুর্নীতিতে যুক্ত হচ্ছে, তখন প্রশ্ন উঠতেই পারে যে শিক্ষা নিয়ে তাদের মধ্যে কেন অসততা প্রশ্রয় পাচ্ছে। শিক্ষিত হয়েও তারা নিজেকে সুশিক্ষিত করতে পারেনি। আমরা যেমন নিজেদের সন্তানদের জন্য বলি মানুষের মতো মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে। সেই মানুষের খোঁজ আমরা আজ কতটুকু পাচ্ছি। আর কেন পাচ্ছি না, তা বিচার করতে হবে? মানুষ হওয়ার জন্যই তো সন্তানকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করছি। কিন্তু শেষমেশ ব্যর্থ হচ্ছি অনেকেই। আসলে সুশিক্ষিত কথাটির অর্থ হলো ব্যক্তি তার প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অর্জনের পর তা জীবনে প্রয়োগ করে এবং পাশাপাশি অন্যকে করতেও উৎসাহিত করে। শিক্ষা কাউকেই বিপথে চালিত করে না। মানুষকে পথ দেখায়। যদি কেউ সেই পথে না গিয়ে বিপথে যায়, তাহলে শিক্ষার দোষ দেওয়া যায় না। শিক্ষাগ্রহণে ক্রটির কথা বলা যায়। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেও যখন মানুষ বিনয়ী, অহংকারমুক্ত হয়, তখন তাকে জ্ঞান অর্জনের পথিক বলা যায়। জ্ঞানের ধর্মই বিনয়ী করা। আবার সুশিক্ষার কাজও তাই। মানুষকে মনুষ্যত্বের পথ দেখায়।

আজ যেমন অনেক ক্ষেত্রেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে সার্টিফিকেট অর্জন করেও মনুষ্যত্বের পথ দেখাতে ব্যর্থ হচ্ছে, সেই শিক্ষা সমাজের বা দেশের কোনো কাজেই আসছে না, বরং ব্যক্তির ভোগলিন্সায় যাচ্ছে তাকে সুশিক্ষা বলা চলে না। বিপরীতে কেউ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ না করেও নিজের বিবেক, আদর্শ নিয়ে সমাজে সততার চর্চা করলে তাকে সুশিক্ষিত বলা চলে। এদের দ্বারাই সমাজের দেশের ও দশের মঙ্গল। সার্টিফিকেটধারী অনেক আছে কিন্তু প্রকৃত মানুষ কজন? আজ যে সমাজে এত হানাহানি, উগ্রতা এসব তো ভালো মানুষ হতে না পারারই ফল। একজন মানুষের উচ্চশিক্ষা লাভ করার পাশাপাশি মনুষ্যত্ব অর্জনের শিক্ষা নেওয়াটাও জরুরি। উচ্চশিক্ষা শুধু সার্টিফিকেটে উচ্চ হলেই হবে না, মন ও মননশীলতায় উঁচু হতে হবে। শিক্ষা মানুষের মধ্যকার অন্তর্নিহিত শক্তি জাগ্রত করার কাজ করলে বাস্তবিক ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ সঠিকভাবে হচ্ছে না। শিক্ষা তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সফল হচ্ছে না। প্রয়োগের উদ্দেশ্য এবং ধরনেই এমনটা হচ্ছে বলাই যায়। ভারতের রাষ্ট্রপতি ও বিখ্যাত পরমাণুবিজ্ঞানী এপিজে আবদুল কালাম শিক্ষা নিয়ে খুবই চমৎকার একটি মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছিলেন, যত দিন শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধু চাকরি পাওয়া হবে, তত দিন সমাজে শুধু চাকররা জন্মাবে, মালিক নয়। যে কথার বাস্তবিক প্রমাণ আমরা আজকের সমাজে প্রতিফলিত হচ্ছে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমাদের আজকের শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবল চাকরি পাওয়া। পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকেই নানা প্রক্রিয়ায় টিকে থাকার শিক্ষা মানুষ প্রকৃতি এবং অভিজ্ঞতা থেকে পেয়েছিল। এরপর সভ্যতার বিকাশে শিক্ষার ধারা এবং কাঠামো পরিবর্তন হয়েছে। এখনো হচ্ছে। শিক্ষিত এবং অশিক্ষিতদের মধ্যে পার্থক্য ছিল তার আচরণে, কথায়, কাজে এবং জীবন পরিচালনায়। ফলে শিক্ষার প্রয়োজন অনুভব করেছে সবাই। ক্রমে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। এর মাপকাঠি হলো প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেট বা স্বীকৃতি। তবে এই স্বীকৃত মানুষকে কতটা পথ দেখাতে পারছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ প্রশ্ন উঠছে। আমাদের প্রয়োজন মানুষ। আমাদের প্রয়োজন স্বশিক্ষিত মানুষ। শিক্ষা ও স্বশিক্ষিত মানুষের এই পার্থক্য সেদিনই দূর হবে, যখন সবাই সুশিক্ষিত হয়ে গড়ে উঠবে।

তথ্য সূত্র : প্রতিদিনের সংবাদ


লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট


মন্তব্য করুন