Loading..

পাঠসংশ্লিষ্ট ছবি/ইমেজ

১৭ ডিসেম্বর, ২০২১ ১০:১৪ পূর্বাহ্ণ

চিরজাগরূক থাকুক সবার অন্তরে

২০২১ সাল। মনের মণিকোঠায় গ্রথিত করে রাখার মতো একটি বছর। এ বছরেই শেষ হতে যাচ্ছে শতাব্দীর কিংবদন্তি স্বাধীনতার স্থপতি সারা বিশ্বে জননন্দিত অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক বাঙালির মুক্তির দূত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর অবিস্মরণীয় উদযাপন এবং পালিত হচ্ছে ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ৩০ লাখ শহিদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী।

বিজয় দিবসের প্রাক্কালে মনে পড়ছে অনেক কথা, অনেক বর্ণিল-মলিন স্মৃতি। চোখের সামনে ভেসে উঠছে কত শত অশ্রুভেজা নয়ন। কর্ণকুহরে ভেসে আসছে কত ছেলেহারা মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ, ভাইহারা বোনের আহাজারি, পুত্রহারা বাবার অঝোর ক্রন্দন, পাড়া-প্রতিবেশীর বুকে চেপে ধরা বিলাপ। হাসি হারানো চেহারাগুলো এখনো ক্ষতবিক্ষত করে পঞ্চাশ বছর পরেও।

প্রথমেই মনে পড়ে সেই স্মরণীয়-বরণীয় মানুষটির কথা, যিনি না জন্মালে বাংলাদেশ নামক কোনো দেশের নাম বিশ্ব মানচিত্রে দেখা যেত না। একটি নতুন রাষ্ট্র, নতুন দেশ সৃষ্টি করার জন্য হিমালয়ের মতো উঁচু শির করে সারা জীবন পথ চলেছেন যে মানুষটি, তিনি আমাদের জন্য সর্ব অর্থেই শ্রেষ্ঠ পাওয়া। তার মতো না হলে কে পারে জীবনের সোনালি দিনগুলো এমনভাবে কারান্তরালে আর রাজপথে কাটিয়ে দিতে? যার জীবন ছিল, যৌবন ছিল না জীবনের কাছে।

যৌবনের টগবগে দিনগুলো স্বৈরশাসকদের দৌরাত্ম্যে হয়েছে পর্যুদস্ত, বিধ্বস্ত, ধুলোময়। প্রায় চৌদ্দ বছরের মতো মূল্যবান সময় কাটিয়েছেন শাসকদের লৌহনিগড়ে। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-সংসার সবকিছু সমর্পণ করেছিলেন দেশের আপামর মানুষের সেবায়, দেশমাতৃকাকে অপশাসনমুক্ত করার জন্য, সবাইকে একটি সুখী জীবন দেওয়ার জন্য, দেশময় ফুলের হাসি উপহার দেওয়ার জন্য। সবই দিয়েছেন, বিনিময়ে পেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে হেরে যাওয়া স্বাধীনতাবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের নির্মম বুলেট; যদিও পেয়েছিলেন দেশপ্রেমী সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অফুরন্ত ভালোবাসা।

‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেশবাসীর মুখে মুখে ফিরেছে একাত্তরের প্রতিটি দিনে, প্রতিটি রাতে। এ স্লোগান মানুষকে উদ্দীপ্ত করেছে, ভয়ভীতি-শঙ্কাকে শক্তিতে রূপান্তরিত করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এ স্লোগানটি ছিল মন্ত্রের মতো, উদ্দীপ্ত হওয়ার হাতিয়ার, যুদ্ধের হাতিয়ারের চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী। অথচ ইতিহাস-বিকৃতির যুগে (১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ শক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত) দিনের আলোতে এ স্লোগান মুখে নেওয়াও ছিল ‘অপরাধ’-রাতের আঁধারে এ স্লোগান দেশপ্রেমীদের গাইতে হতো সামরিক শাসক আর তাদের দোসরদের তাণ্ডবের ভয়ে।

তারা ইতিহাস বিকৃত করেই ক্ষান্ত হয়নি, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বিকৃত ইতিহাস তরুণদের মনে প্রোথিত করে দেওয়ার জন্য পাঠ্যপুস্তকেও অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তারা ব্যর্থ হয়েছে; জয় বাংলা আবার মাঠে ফিরে এসেছে। তথ্যবিকৃতির হাত থেকে ইতিহাসকে রক্ষা করাও নতুন প্রজন্মের দায়িত্ব।

পাকিস্তানি শাসকদের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছিল যে ৬ দফা, তার মর্মার্থ অনুধাবন করতে হবে নতুন প্রজন্মকে। বঙ্গবন্ধু যখন ৬ দফা প্রথম উত্থাপন করেন, তখন তিনি বহু বাঘা বাঘা নেতার সমর্থন পাননি; বরং পেয়েছিলেন প্রচণ্ড বিরোধিতা। অমিত তেজের অধিকারী বঙ্গবন্ধু তাতে দমে যাননি। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’-রবি ঠাকুরের এ বাণী তিনি অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করেন এবং প্রথমে একাই এগিয়ে যান। দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে ঘুরে জনসভায় বাংলার মানুষকে বোঝান, ৬ দফা কেন তিনি শাসকদের কাছে দাবি হিসাবে তুলে ধরেছেন।

আসলে এর মধ্যেই তো নিহিত ছিল স্বাধীনতার বীজ। জনগণ সায় দেয়, এগিয়ে আসে তার সমর্থনে। ছাত্রসমাজও যোগ দেয় তার সঙ্গে ১১ দফা সহকারে, যে ১১ দফায়ও যুক্ত ছিল ৬ দফা। এরপর বঙ্গবন্ধুকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ৬ দফার কারণে বেশ বেকায়দায় পড়েছিল পাকিস্তানি শাসকরা, অনুমান করতে পেরেছিল তারা মহাবিপদের অশনিসংকেত।

মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিলগ্ন নিয়েও আছে অনেক কথা। সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় অর্জনের পরও স্বৈরশাসকরা বারবার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বেইমানি করেছে, কথার বরখেলাপ করেছে, জবান দিয়ে জবান ফিরিয়ে নিয়েছে। সংসদের অধিবেশন আহ্বানের জবান দিয়েও কথা রাখেনি। শুধু সময় নষ্ট করেছে আর এর ফাঁকে তাদের শক্তি সংহত করেছে।

বঙ্গবন্ধুসহ জনগণ তাদের চালাকি বুঝতে পেরে মিছিলে-মিটিংয়ে রাজপথ প্রকম্পিত করেছে; একাধিকবার সচিবালয় ঘেরাও করেছে, মিছিলে গুলি হয়েছে, বাঙালি মরেছে; কিন্তু দমেনি। আরও জোরদার হয়েছে জনগণের মনোবল। ২ মার্চ ১৯৭১-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় উড়িয়ে দিয়েছে সবুজের বুকে লালসূর্য খচিত প্রথম স্বাধীনতার পতাকা, যার কারণে এ বটগাছটি হয়ে উঠেছিল শাসকদের চক্ষুশূল-গোড়া থেকে কেটে দিয়েছিল গাছটিকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়।

আচমকা গণহত্যা শুরু করল হানাদার বাহিনী একাত্তরের ২৫ মার্চের রাতে। এত তাড়াতাড়ি যে শুরু হবে তা অবশ্য আমরা ভাবতেও পারিনি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হানাদারের রূপ নিয়ে বিপুল আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ল নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর, রাজধানীতে এবং সব শহরে একযোগে, কোনো রকম সংকেত ছাড়াই। শুরু করল গণহত্যা দেশজুড়ে।

বঙ্গবন্ধুও ঘোষণা করে দিলেন স্বাধীনতা আনুষ্ঠানিকভাবে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে, স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়ে দিলেন চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে, যা সেদিন থেকেই বারবার প্রচারিত হয়েছে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে। তিনি আশঙ্কা করছিলেন, যে কোনো সময় তাকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। হয়েওছিল তাই।

বিশ্বনেতাদের হস্তক্ষেপের কারণে পাকিস্তান সরকার শেষ পর্যন্ত রাওয়ালপিন্ডির কারাগার প্রাঙ্গণে খুঁড়ে রাখা কবরের সামনে থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয় ১৯৭২-এর জানুয়ারির ৮ তারিখে। তিনি লন্ডন, দিল্লি হয়ে ফিরে আসেন নিজের স্বাধীন দেশে ১০ জানুয়ারি। নয় মাসের তীব্র মানসিক যন্ত্রণার শিকার বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন বিধ্বস্ত দেশে, বিমানবন্দরে নেমে অগণিত মানুষের সামনে নিজে কাঁদলেন, অন্যদের কাঁদালেন এবং ট্রাকের উপরে উঠে রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে অশ্রুশিক্ত নয়নে লাখো অপেক্ষমাণ দেশবাসীর সামনে দেশকে পুনর্গঠনের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন। হাজারো সমস্যা, বাধাবিপত্তি এক পাশে ঠেলে রেখে শুরু করলেন পুনর্গঠনের কাজ।

দেশের এমন দুঃসময়ে বঙ্গবন্ধুর আপ্রাণ প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করা আর বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্র প্রমাণ করার জন্য স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কয়েকটি বামপন্থি দল আর তথাকথিত সর্বহারা পার্টি নামধারীরা দেশে কৃত্রিম খাদ্য সংকট তৈরি করে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার অপচেষ্টা অব্যাহত রাখে।

২০২১ সালের বিজয়ের মাসে আমরা চাই, নবপ্রজন্ম সঠিক ইতিহাস জানুক। জাতির পিতার অবদান আর জাতীয় নেতাদের আত্মত্যাগের কথা হৃদয়ে অনুভব করুক। কেন জাতির সূর্যসন্তান বুদ্ধিজীবী-কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-শিল্পীদের রাজাকার-আলবদর বাহিনীর হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে, তা উপলব্ধি করুক।

একটি ফুলকে বাঁচানোর জন্য মহান মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন-তুচ্ছ করা লড়াইয়ের মর্মার্থ স্মরণ করে এক ফোঁটা চোখের জল ফেলুক। লাখ লাখ মা-বোনের আব্রু হারানোর মর্মান্তিক কাহিনি জেনে হৃদয়টাকে তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধায় আনত করুক। আন্তরিকভাবে কামনা করি, ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবস শুধুই আনুষ্ঠানিকতায় রূপান্তরিত না হোক; বরং হৃদয়ের অন্তঃস্থলে প্রোথিত হয়ে স্বাধীনতার চেতনাকে চিরকাল উজ্জীবিত রাখুক।

অধ্যাপক ড. এম এ মাননান : সাবেক উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

আরো দেখুন