Loading..

খবর-দার

২৫ ডিসেম্বর, ২০২১ ১২:৪৭ পূর্বাহ্ণ

ওমিক্রন কতটা ভীতিকর

সম্প্রতি করোনাভাইরাসের কিছু উদ্বেগজনক বৈশিষ্ট্যসহ একটি নতুন রূপ শনাক্ত হয়েছে। এ ভাইরাসটি দক্ষিণ আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়লেও এটি ১১ নভেম্বর আফ্রিকার বতসোয়ানায় প্রথম শনাক্ত হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার এ অঞ্চলে হঠাৎ করে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অতিদ্রুত বেড়ে যেতে দেখা যায়। তাই এ নতুন স্ট্রেইনটির সংক্রমণ বৃদ্ধিতে দক্ষিণ আফ্রিকার অবদানই বেশি বলে মনে করা হচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ২৬ নভেম্বর করোনাভাইরাসের সর্বশেষ নতুন ভ্যারিয়েন্টের নাম ঘোষণা করেছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘ওমিক্রন’ (Omicron বা B 1.1.529 SARS-CoV-2 )। ওমিক্রন একটা গ্রিক অক্ষর। কেউ যাতে এটাকে দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট না বলে, সে জন্যই এই নামকরণ।

কেন এত শঙ্কা

ওমিক্রনের মোট মিউটেশন ৩২টি, যা মূল উহান স্ট্রেইনের তুলনায় অনেকগুণ বেশি। আর নতুন এ ভ্যারিয়েন্টের ৩২টিরও বেশি মিউটেশন আছে শুধু স্পাইক প্রোটিনে, যা এর আগে পাওয়া ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের মিউটেশনের দ্বিগুণ। অনেকগুলো আবার স্পাইক প্রোটিনে উপস্থিত, অর্থাৎ ভাইরাসের যে অংশটি মানুষের কোষের সঙ্গে আবদ্ধ হয় এবং তাকে মানুষের শরীরে প্রবেশ করতে সক্ষম করে- সেখানটায়।

অস্বাভাবিক সংখ্যক মিউটেশন দেখা যাওয়ার কারণে সবাই বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন করোনার এ ভিন্ন রূপটি নিয়ে। ভয়ের কারণ এই যে, এ পরিবর্তনগুলোর কারণে ওমিক্রন আরও সহজে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বিপর্যস্ত করতে পারে এবং ভ্যাকসিনগুলোর কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে। যে আর (R value) ভ্যালুর ওপর ভিত্তি করে হিসাব করা হয় এ ভাইরাস কতটা সংক্রমণশীল, তা গোটা দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য হচ্ছে ১.৪৭, কিন্তু প্রিটোরিয়া ও জোহানেসবার্গ অঞ্চলের জন্য তা হচ্ছে ১.৯৩।

কাজেই ধারণা করা যায়, এ ভাইরাস ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের চেয়েও সংক্রমণশীল। স্ক্রিপস রিসার্চ ট্রান্সলেশনাল ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর এরিক টোপোল সম্প্রতি ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছেন, ডেল্টার পর এটিই করোনাভাইরাসের সবচেয়ে বেশি উদ্বেগজনক রূপ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন রূপের করোনাভাইরাসটিকে ‘উদ্বেগজনক’ বা ‘Variant of Concern’ বলে উল্লেখ করেছে। কারণ ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে যে, এ ভাইরাসের পূর্ববর্তী সংস্করণগুলোর তুলনায় এটি আরও বেশি সংক্রমণযোগ্য এবং আরও বেশি মারাত্মক।

এত অধিকসংখ্যক মিউটেশনের কারণে ধারণা করা হচ্ছে, এ ভাইরাসটি ডেল্টা ভাইরাসের চেয়ে বেশি সংক্রমণশীল হবে। আগে যাদের কোভিড-১৯ হয়েছে, তাদের আবারও এ ভ্যারিয়েন্টের কারণে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে। পরবর্তী সময়ে দক্ষিণ আফ্রিকার গাউতেং প্রদেশসহ ইসরাইল, হংকং ও বেলজিয়াম ছড়িয়ে পড়ে। তবে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ অন্যান্য রূপের তুলনায় ভয়ানক কিনা অথবা এ ক্ষেত্রে ভিন্ন লক্ষণ আছে কিনা, তা এখনো স্পষ্ট নয়।

তাই ওমিক্রন কতটা সংক্রমণপ্রবণ, কতটা মারাত্মক এবং এর বৈকল্পিক লক্ষণগুলো কী, সেই সঙ্গে বর্তমান ভ্যাকসিনগুলো এ ক্ষেত্রে কতটা কার্যকর হবে, তা সম্পূর্ণরূপে জানতে আরও অনেক পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার প্রয়োজন হবে। বিবর্তিত এ জীবাণুটি কতটা বিপজ্জনক হতে পারে, তা বুঝতে আরেকটু সময় লাগবে। বিজ্ঞানীরা এখনো এ ভাইরাসটির মিউটেশন প্রোফাইলের বাইরে নতুন বিবর্তিত রূপটি সম্পর্কে খুব কমই জানেন। এ ভ্যারিয়েন্ট কঠিন সমস্যা তৈরি করবে নাকি হালকা সমস্যা তৈরি করবে, তা এখনো পরিষ্কার হয়নি, গবেষণা চলছে।

তবে প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ৫ বছরের কম বয়সি শিশুসহ ছাত্রদের এবং অল্প বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে আক্রান্তের হার বেশি দেখা গেছে। যদিও এখন পর্যন্ত বেশিরভাগই হালকা লক্ষণসংবলিত রোগী। প্রভাবশালী ডেল্টা রূপান্তরের মতো, বিশেষ করে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য ওমিক্রন গুরুতর রোগ বা মৃত্যুর কারণ হতে পারে। অতএব, প্রতিরোধই সর্বদা গুরুত্বপূর্ণ।

লক্ষণের ভিন্নতা

দক্ষিণ আফ্রিকা মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান এবং ওমিক্রন কোভিড-১৯ ভ্যারিয়েন্টের রোগীদের চিকিৎসা করা প্রথম চিকিৎসকদের একজন ডা. অ্যাঞ্জেলিক কোয়েটজি বিবিসিকে বলেছেন, রোগীদের মধ্যে তিনি যে ধারাবাহিক লক্ষণগুলো দেখেছিলেন তা হলো- ক্লান্তি, শরীরে ব্যথা ও মাথাব্যথা, গলায় খুশখুশে ভাব ও ব্যথা। তার মতে, এ লক্ষণগুলো ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

ডা. কোয়েটজির মতে, আক্রান্তরা গুরুতর অসুস্থ হয়নি। হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন ছিল না এবং বাড়িতেই চিকিৎসা করা গেছে। রোগীদের গন্ধ বা স্বাদ হারানোর লক্ষণ ছিল না এবং অক্সিজেনের মাত্রা কোনো বড় রকমের হ্রাস পায়নি। মোটামুটিভাবে হালকা লক্ষণজনিত এবং দ্রুত উন্নতি হচ্ছিল।

করণীয়

ভ্রমণনীতি ও নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপের মাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকায় ইতোমধ্যে ছড়িয়ে পড়া নতুন ভ্যারিয়েন্টের করোনাভাইরাস যাতে অন্য দেশগুলোতে ছড়াতে না পারে, সেজন্য তা প্রতিরোধের চেষ্টা করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রিটেন, জাপান ও ইসরাইলসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল ও দেশগুলো দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আগত বিমান ভ্রমণকারীদের জন্য জরুরিভিত্তিতে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। ইউরোপের একাধিক দেশ আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে তাদের বিমান চলাচল স্থগিত করে দিয়েছে।

একটা কথা মনে রাখা দরকার, কোভিড-১৯ রোগীদের বেশিরভাগই টিকাবিহীন। যুক্তরাষ্ট্রের কমপক্ষে আরও চব্বিশটি রাজ্যে গত দুই সপ্তাহে আক্রান্তের সংখ্যা অন্তত পাঁচ শতাংশ বেড়েছে। অর্থাৎ আরেকটি মহামারি তরঙ্গ যে আসছে, তা প্রায় নিশ্চিত। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, স্পাইক প্রোটিনে এত বেশি মিউটেশনের কারণে এ ভাইরাস আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে (Immune System) ফাঁকি দিতে পারে।

তবে ভ্যাকসিন কাজ করবে না, এমনটি মনে হচ্ছে না। তবে কম কাজ করতে পারে অর্থাৎ এফিকেসি কমে যেতে পারে। এজন্য ভ্যাকসিনের তৃতীয় ডোজ দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। আর কোভিডের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত সম্প্রতি বের হওয়া অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ Molnupiravir (মার্ক) অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের মতোই কার্যকর হবে।

বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যেই সতর্ক করেছেন যে ভবিষ্যতে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। তাই এ ভাইরাস যাতে বাংলাদেশে দ্রুত ছড়িয়ে না পড়ে, সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ আফ্রিকার যেসব দেশকে রেড লিস্টে ফেলেছে সেগুলো হচ্ছে- দক্ষিণ আফ্রিকা, বতসোয়ানা, লেসোথো, এসভাতিনি (সোয়াজিল্যান্ড), জিম্বাবুয়ে ও নামিবিয়া। বাংলাদেশের উচিত দেরি না করে এখনই সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া। এ ছাড়া স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থাসহ নিয়ন্ত্রণের জন্য উপায় পরিকল্পনা করা।

জনস্বাস্থ্য বিভাগের পূর্ববর্তী নির্দেশনাগুলো এখনো পরিবর্তিত হয়নি। অর্থাৎ, সময়মতো টিকা ও বুস্টার ডোজ নেওয়া, লক্ষণগুলো শরীরে দেখা দিলে পরীক্ষা করানো এবং জনসমাগম ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ এড়িয়ে চলা, সর্বোপরি সর্বদা মাস্ক পরে থাকা। একমাত্র সচেতনতাই পারে আমাদের রক্ষা করতে।

পরিস্থিতির ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি

করোনার নতুন ধরনটির সংক্রমণের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বজুড়ে আর্থিক বাজার বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এবং সব দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভ্রমণ সীমিত করতে উৎসাহিত হয়ে পড়েছে। যখন ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে নতুন করে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ বাড়ছিল, তখন এমন একটি ভীতিকর খবরে সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। কিন্তু পরিস্থিতির ভারসাম্য বজায় রাখাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেন : শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ; সভাপতি, বাংলাদেশ শিশু চিকিৎসক সমিতি