Loading..

ম্যাগাজিন

০৭ জানুয়ারি, ২০২২ ০৭:২৫ অপরাহ্ণ

ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে তখন বিস্তর গবেষণা চলছে গোটা ইউরোপজুড়ে, মোছাঃ মার্জুয়ারা বেগম,প্রধান শিক্ষক, দক্ষিণ বালাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ডিমলা নিলফামারি।

বহুসাধ্যসাধনা করেও যেমন, বিজ্ঞানীরা অনেক সূত্র বা বৈজ্ঞানিক বস্তু আবিষ্কার করতে পারেন, তখন শ্রেফ অনাকাঙ্খিতভাবে অনেক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হাতে এসে যায়। তারমানে এই নয়, হঠাৎই হাওয়া থেকে আবিষ্কার হয়ে যায়। হ্যাঁ, তবে এক জিনিস আবিষ্কার করতে গিয়ে আরেক জিনিস আবিষ্কারের উদাহরণ পদার্থবিজ্ঞানে কম নয়।

ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে তখন বিস্তর গবেষণা চলছে গোটা ইউরোপজুড়ে। আরই এই গবেষণার সূত্র ধরেই প্রথমে ইলেকট্রন এবং পরে পরে প্রোটন আবিবষ্কার হয়েছে। ১৮৯৫ সাল। তখনও নিশ্চিত হয়নি ক্যাথোড রশ্মিই ইলেক্ট্রনের স্রোত। দিনটা ছিল ৮ নভেম্বর। ল্যাবরেটির কাজকর্ম শেষ করে ঘরে ফেরার প্রস্ততি নিচ্ছেন ভিলহেম কোনার্ড রন্টজেন। টেবিলের ওপর ক্যাথোড টিউব রাখা আছে। পাশেই রয়েছে ক্যাথোড টিউবের আশপাশে বেরিয়াম প্লটিনোসায়ানাইডের প্রলেপ দেওয়া কাগজ। সেদিনের মতো কাজ শেষ। তাই ক্যাথোড টিউবটা একটা কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলেন। তারপর নিভিয়ে দিলেন ঘরের বাতি। কিন্তু ক্যাথোড টিউবে সাথে সংযুক্ত বিদ্যুৎ প্রবাহ বন্ধ করেননি। হয়তো সুইচ বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিলেন।

ঘরের বাতি নেভানোর সাথে সাথে একটা আলোর ঝলক দেখতে পেলেন রন্টজেন। ঝলকটি দেখলেন বেরিয়াম প্লাটিনোসায়ানাইডের প্রলেপ দেওয়া কাগজের ওপর। থেমে গেলেন রন্টজেন। চমকেও উঠলেন। আবার ঘুরে এলেন। বারবার ক্যাথোড টিউবের সুইচ বন্ধ ও চালু করে দেখলেন। একই ঘটনা ঘটছে বারবার। এ ঘটনার ব্যাখ্যা কী?

রন্টজেন নিশ্চিত জানেন, আলোর ঝলক ক্যাথোড টিউবের ভেতর থেকে আসছে না। কারণ, তিনি জানেন ক্যাথোড রশ্মির ক্ষমতা নেই টিউবের ওপর রাখা কালো কাপড় ভেদ করে বেরিয়ে এসে বেরিয়াম প্লাটিনোসায়ানাইডের পর্দায় ঝলক তোলার। তাহলে এই নতুন ঝলক নিশ্চয়ই অন্য কিছু। এবং সেটা আসছে ক্যাথোড নলের ভেতর থেকেই। তাহলে কি এটা অন্যকোনো রশ্মির কারশাজি? ক্যাথোড নলের ভেতরে ক্যাথোড রশ্মি ছাড়াও অন্য কোনো রশ্মি উৎপন্ন হয়?

এরপর বেশ কিছুদিন অনেক পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে দেখলেন রন্টজেন। বেশি কিছু জানতে পারলেন না। শুধু একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হলেন, বিদ্যুৎ প্রবাহমাত্রা বাড়ালেই সেই রশ্মির ভেদনক্ষমতা বাড়ে। এমনকী পুরু দেয়াল পর্যন্ত ভেদ করে যেতে পারে। রশ্মিটি বৈজ্ঞানিক সমাজে তখন অচেনা। রন্টজেন তাই নাম দিলেন এক্স রশ্মি।

এটা নিয়ে তখনই বৈজ্ঞানিক সমাজে মুখ খুললেন না রন্টজেন। কেউ হয়তো বিশ্বাসই করতে চাইবে না তাঁর কথা। তাই চুপচাপ কাজ করে গেলেন। শুরু হলো নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা। তাতে নতুন কোনো ফল পেলেন না। ততদিনে এক্স-রে ব্যবহার করে ছবি তোলার প্রক্রিয়া শিখে গেছেন। নিজের মতো করে বানিয়ে নিয়েছেন ফটোগ্রাফিক প্লেট।

এতদিন স্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয়টি নিয়ে টুঁ শব্দটি করেনি। কিন্তু একসময় সিদ্ধান্ত নিলেন ব্যাপারটা স্ত্রীকে জানানোর। সেটাও নাটকীয়ভাবে। একদিন ল্যাবে ডেকে নিলেন স্ত্রী বার্থাকে। বার্থা এলেন। তখন রন্টজেন বললেন হাতটা ফটোগ্রাফিক প্লেটের ওপর রাখতে। তারপর এক্স-রে নিক্ষেপ করলেন প্লেটের ওপর। বার্থার মাথায় কিছুই ঢুকছে না, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন স্বামীর দিকে। বার্থাকে অপেক্ষা করতে বলে রন্টজেন ফটোগ্রাফিক প্লেটটা ডেভেলপ করে নিয়ে এলেন । ধরলেন বার্থার চোখের সামনে। সেই ছবি দেখে চমকে উঠলেন বার্থা, ভয় পেলেন এবং চিৎকার দিয়ে উঠলেন। সেটাই স্বাভাবিক। রন্টজেন বার্থার সুস্থ-সবল হাতের ছবি তুলেছিলেন; কিন্তু ছবিতে তো হাতের কঙ্কাল দেখা যাচ্ছে! প্রতিটা হাঁড়, হাঁড়ের জোড়া চেনা যাচ্ছে স্পষ্ট করে। বার্থার হাতে একটা আংটি ছিল। সেটাও ছবিতে খুব ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু হাতের মাংস, চামড়ার ছবি বেশ হালকা।

বার্থাার হাতের সেই ছবি, সেটাই পৃথিবীর প্রথম এক্স-রে ফটোগ্রাফ। এরপর রন্টজেন সাজিয়ে-গুছিয়ে একটা প্রবন্ধ লেখা শুরু করলেন। এক্স-রে নিয়ে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ। সেই প্রবন্ধে জুড়ে দিলেন বার্থার হাতের এক্স-রে ছবি। ১৮৯৫ সালের ৮ নভেম্বর প্রথম এই বিকিরণের খোঁজ পান রন্টজেন। কিন্তু সে খবর বিজ্ঞান দুনিয়াকে জানালেন ২৮ ডিসেম্বর। অবশ্য প্রবন্ধটা ছাপা হয় আরও পরে। প্রবন্ধটা ছাপা হবার পর রাতারাতি বিখ্যাত বনে গেলেন রন্টজেন। সারা পৃথিবীতে তুমুল আলোড়ন তুলল এক্স-রশ্মি।

এই আবিষ্কারের জন্য ১৯০১ সালের রন্টজেন পদার্থবিদ্যার নোবেল প্রাইজ পেলেন। তিনিই নোবেল বিজয়ী প্রথম পদার্থবিদ। ১৯০১ সালেই তো নোবেল দেওয়া শুরু হয়।

এক্স রশ্মি নিয়েও শুরু হয় জল্পনা-কল্পনা। যেমনটা হয়েছিল ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে। এক্স রশ্মি কী? তরঙ্গ না কণা? কেউ কেউ মনে করেছিলেন এটা হয়তো আলোক রশ্মিই নয়। শব্দের মতো অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ।

১৮৯৬ সালের ২৩ জানুয়ারি রন্টজেনের প্রবন্ধ প্রকাশ হয়। সেটা দৃষ্টি আকর্ষণ করে জে জে টমসনের। তিনিও এক্স-রশ্মির কথা জানতেন বলে শোনা যায়। অজানা কারণে এটা নিয়ে তিনি হইচই করেননি। তবে তাঁর ছাত্রকে লাগিয়ে দিলেন এক্স-রশ্মির পেছনে। সেই ছাত্রই পরে প্রমাণ করেন এক্স-রশ্মি আসলে তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ অর্থাৎ সত্যিকারের আলোক রশ্মি। সেই ছাত্রটি হলেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড।

রাদারফোর্ড এক্স-রশ্মি নিয়ে উঠেপড়ে লাগলেন। অন্যরাও কিন্তু বসে নেই তখন। বিশেষ করে ফরাসী বিজ্ঞানী হেনরি বেকরেল।

দুই

আলো কণা না তরঙ্গ, এ নিয়ে বিস্তর বিতর্ক ছিল তিন শতাব্দী ধরে। নিউটন বলেছিলেন আলো কণা, সমসাময়িক বিজ্ঞানী হাইগেনস বলেছিলেন আলো তরঙ্গ। দুজনের তত্ত্বেই যুক্তি ছিল। কিন্তু দুশো বছর পর আরেক ব্রিটিশ টমাস ইয়ং ডাবল স্লিট পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করেন আলো আসলে তরঙ্গ। রন্টজেন এক্স রশ্মি আবিষ্কার পর এটা নিয়েও কিন্তু দ্বিধাদ্বন্দে ছিলেন বিজ্ঞানীরা। ক্যাথোড রশ্মি নিয়েও বিজ্ঞানীদের এই দ্বিধা ছিল। শেষমেশ প্রমাণিত হয়, ক্যাথোড রশ্মি আসলে ইলেকট্রন কণার স্রোত। তাই এক্স রশ্মি নিয়েই কোনো সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব ছিল না রন্টজেনের পক্ষে। তবে এক্স-রশ্মি একবার আবিষ্কার হওয়ার পর সেটা নিয়ে শুধু রন্টজেনই মাথা

ঘামালেন না, একে একে অনেক বিজ্ঞানীই এর পেছনে আদাজল খেয়ে নামলেন।

লেখাটি নিউক্লিয়ার ফিজিকস বইয়ের অংশবিশেষ

এক্স রশ্মির আবিষ্কারক রন্টজেন এই রশ্মিকে তরঙ্গই ভেবেছিলেন। তরঙ্গবাদীদের সামনে তখন নতুন সমস্যা দেখা দিল। এটা যদি তরঙ্গই হয়, তাহলে কী ধরনের তরঙ্গ? শব্দের মতো অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ, নাকি আলোর মতো অনুপ্রস্থ তরঙ্গ? তা নিয়ে তৈরি হয় বিতর্ক। রন্টজেন নিজে মনে করতেন এক্স রশ্মি তরঙ্গ। তিনি আরও ব্যাপক পরিসরে গবেষণা শুরু করেন। রন্টজেন প্রথমেই ভাবেন এক্সরে কেন ও কীভাবে তৈরি হয়?

এক্স রে তৈরি হয় ক্যাথোড টিউব থেকে। বায়ূশূন্য ক্যাথোড টিউবের দেয়ালে আঘাত করে ক্যাথোড রশ্মি, সেই আঘাতের ফলেই উৎপন্ন হয় এক্স রে। কিন্তু আঘাতের কারণেই বা কেন এক্স রে উৎপন্ন হলো?

ক্যাথোড রশ্মি হলো ইলেকট্রন কণার স্রোত। সে সব ইলেকট্রন অতি উচ্চগতির। প্রবল বেগে ধেয়ে চলা এসব ইলেকট্রন যখন ক্যাথোড টিউবের দেয়ালে আঘাত করে, তখন এরা বাধা পায়, ফলে কমে যায় গতি। সুতরাং কমে যায় ইলেকট্রনের গতিশক্তিও। এই হারানো গতিশক্তিটা কোথায় যাবে? শক্তির সংরক্ষণশীলতা নীতি বলে, কোনো শক্তি পুরোপুরি ধংস হয়ে যেতে পারে না। এক শক্তি আরেক শক্তিতে রূপান্তরিত হয় মাত্র। ক্যাথোড টিউবে যেসব ইলেকট্রন আঘাত করে, ফলে কমে যায় তাদের গতিশক্তি, সেই হারানো গতিশক্তিটা রূপান্তরিত হয়ে তৈরি করে বিদ্যুৎচুম্বকীয় শক্তি, এক্স রশ্মির বিকিরণ রূপে। অর্থাৎ বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হলেন এক্স রশ্মি আসলে এক ধরনের বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গ।

এই ঘটনা, এই ব্যাখ্যা থেকে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হলেন, কাচের মতো স্বচ্চ পদার্থও প্রবল গতির ইলকট্রনের গতি কমিয়ে দিতে সক্ষম। তখন বিজ্ঞানীদের মাথায় এলো নতুন ভাবনা। যদি কাঁচের চেয়েও আরও ঘন আর আরও বস্তুর ভেতর দিয়ে ক্যাথোড রশ্মি অর্থাৎ ইলেকট্রনকে যেতে দেওয়া হয়, তাহলে কী ঘটবে?

নিশ্চয়ই ইলেকট্রনের গতি কমবে আরও দ্রুত কমবে? তাই যদি হয় ইলেকট্রন বেশি করে গতিশক্তি হারাবে, সেই বেশি বেশি হারানো গতিশক্তি দিয়ে যে এক্স রশ্মি উৎপন্ন হবে তার শক্তি নিশ্চয়ই আরও বেশি হবে?

এই ব্যাপারটিই পরীক্ষা করে দেখার কথা ভাবলেন বিজ্ঞানীরা। কাচের চেয়েও ভারী ও ঘন বস্তু তাহলে কী হতে পারে? ধাতব পাতের চেয়ে আদর্শ বস্তু এক্ষত্রে আর কি হতে পারে? বিজ্ঞানীরা ধাতব পাত দিয়ে ক্যাথোড টিউব থেকে উৎপন্ন ইলেকট্রনের গতি কমিয়ে দেখলেন। এক রকম ধাতব পাত নয়, বিভিন্ন ধাতুর পাত দিয়ে পরীক্ষাটা করলেন।

এই পরীক্ষাগুলো করা হলো ক্যাথোড নলের ভেতরেই। ক্যাথোড রশ্মি নির্গত হয় যে পাথ থেকে, তার পাশে বসানো হলো ধাতব পাত। অর্থাৎ ক্যাথোড রশ্মি বা ইলেকট্রনের স্রোত ক্যাথোড পাত থেকে নির্গত হয়ে যে পথে ছুটে চলে সেই পথেই বসানো হলো ধাতব পাত। সুতরাং ক্যাথোড পাত থেকে নির্গত ইলেকট্রনের স্রোত সহজেই বাধা পেল ধাতব পাতের দ্বারা। এই ধাতব পাতগুলির নাম দেওয়া হলো অ্যান্টি ক্যাথোড। এই অ্যান্টি ক্যাথোডে বাধা পেয়ে ইলেকট্রনের স্রোত গতিশক্তি হারিয়ে ফেলে। তার ফলে উৎপন্ন হয় শক্তিশালী এক্স রশ্মি।

১৯১৭ সালে বৃটিশ বিজ্ঞানী চার্লস গ্রোভার বার্কলা পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান। কী এমন কাজ করেছিলেন তিনি, যেজন্য নোবেল উঠল তাঁর ঝুলিতে। বার্কলা এক ঐতিহাসিক আবিষ্কার করেন ১৯১১ সালে। তিনি দেখেন, এক্স রশ্মির ভেদনক্ষমতা রয়েছে। এই আবিষ্কারটা নতুন নয়। রন্টজেনই দেখেছিলেন ব্যাপারটা। বার্কলার আবিষ্কারটা অন্য রকম। তিনি লক্ষ্য করেন, আন্টি ক্যাথোডে ব্যবহার করা ধাতুর ওপরে নির্ভর করে এক্স রশ্মির ভেদনক্ষমতা। অর্থাৎ অ্যান্টি ক্যাথোডে ব্যবহার করা প্রতিটি ধাতুর জন্য উৎপন্ন এক্স রশ্মির ভেদনক্ষমতা নির্দিষ্ট। এই বিষয়টা আরও ভালোভাবে খতিয়ে দেখতে গিয়ে বার্কলা আবিষ্কার করলেন একটা নির্দিষ্ট ধাতু থেকে নির্দিষ্টি তরঙ্গদৈর্ঘের এক্স রে উৎপন্ন করে।

বার্কলার চমক এখানেই শেষ হলে না। তিনি দেখলেন, কিছু কিছু ধাতু দুই ধরনের অর্থাৎ দুই তঙ্গ দৈর্ঘের আলাদা আলাদা এক্স রশ্মি বিকিরণ করছে। তরঙ্গ দৈর্ঘ আলাদা, তাই দুই ধরনের ভেদনক্ষমতাও তাই আলাদা। এখানেই থামলেন না বার্কলা, বিভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘের ও ভেদক্ষমতাও এক্স রে আবিষ্কার করলেন।

বার্কলার কাজটিকে আরেকধাপ এগিয়ে নিলেন আরেক ব্রিটিশ বিজ্ঞানী হেনরি মোসলে। ১৯১৩ সালে এক্স রে ক্রিস্টালোগ্রাফির সাহায্যে বিভিন্ন বিভিন্ন উৎস থেকে নিঃসরিত বিভিন্ন ধরনের এক্স রশ্মির ধর্ম ব্যাখ্যা করলেন।

তিন

এক্স বিজ্ঞানীদের দ্বিধা-দ্বন্দের কথা অধ্যায়ের শুরুতেই বলা হয়েছে। এক্স রেকে কেউ কেউ কণা মনে করতেন, কেউ কেউ মনে করতেন তরঙ্গ। কিন্তু দিন যত এগোয়, গবেষণা যত বাড়ে, তরঙ্গবাদীদের ভীত তত মজবুত হয়। বিজ্ঞানীরা মেনে নিতে বাধ্য হন, এক্স রে আসলে তঙ্গধর্মী। তরঙ্গধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য দরকার ডাবল স্লিট পরীক্ষার। যে পরীক্ষাটা প্রথম ১৮০২ সালে করেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী টমাস ইয়ং। তার আগে খোদ আলো নিয়েই দ্বিধাদ্বন্দে ছিলেন বিজ্ঞানীরা। নিউটন মনে করতেন আলো কণাধর্মী জিনিস আর জার্মান বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান হাইগেনস বলেছিলেন আলো আসলে একধরনের তরঙ্গ। পরে ইয়ংয়ের পরীক্ষায় প্রমাণ হয় আলো তরঙ্গ।

ইয়ংয়ের ডাবল স্লিটের পরীক্ষায় উতরে যায় এক্স রশ্মি বিজ্ঞানীরা স্বীকার করে নিলেন, আলো আসলে তরঙ্গ। কিন্তু এর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য খুব ছোট। তাই সমস্যা হলো, ডাবল স্লিটের পরীক্ষায় খুব ভালো ফল পাওয়া যায় না। তরঙ্গ দৈর্ঘ্য যত কম হবে, ডাবল স্লিটের পরীক্ষায় দুটি ছিদ্রের মধ্যে দূরত্ব তত কম হতে হবে, নইলে ব্যতিচার নকশা তত অনুজ্জ্বল হবে। সুতরাং সাধারণ ডাবল স্লিটের পরীক্ষায় এক্স রশ্মির ইন্টারফারেন্স পরীক্ষায় ভালো ফল পাওয়া মুশকিল। তখন এক্স রে তরঙ্গবাদীরা অন্য চিন্তা করলেন। কাঁচের প্লেটের ওপর পাশাপাশি দুটো আঁচড় কেটে তৈরি করলেন অপনর্ত্ন গ্রেটিং। এর সাহায্যে অনেক ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘের আলোরও ব্যাতিচার ঘটানো যায়। আমরা আগেই দেখেছি একেক রকম ধাতু থেকে একেক তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের এক্স রে নির্গত হয়। যেগুলো মোটামুটি বড় তরঙ্গ দৈর্ঘের, তাদের নিয়ে কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু যেসব এক্স রের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য অত্যন্ত ক্ষুদ্র, সেগুলোর ক্ষেত্রে অপবর্তন গ্রেটিংয়েও ভালো কাজ হয় না। তখন অপবর্তন গ্রেটিকীভাবে দুই ছিদ্রের মধ্যে ব্যবধান কমানো যায়, তা নিয়ে চলল বিস্তর গবেষণা, এমন কোনো ক্ষুদ্র ব্যবস্থা কি তৈরি করা যায়?

জার্মান পদার্থবিদ ম্যাক্স ভন লু তখন নতুন পথ বাতলে দিলেন। বললেন, কাঁচের প্লেঠের ওপরেই অপবর্তন গ্রেটিং তৈর করতে হবে তার কোনো মানে নেই। বরং আমরা সহজ পথ খুঁজতে পারি। আর সেই সহজ পথটা তৈরি হয়েই আছে।

কী সেই পথ?

সেগুলো হলো বিভিন্ন পদার্থের স্ফটিক, যাকে বেশিরভাগ মানুষ ক্রিস্টাল বলে চেনে।

একটা বস্তু কখন ক্রিস্টাল তৈরি করে? যখন বস্তুর ভেতর অনুগুলো একটা নির্দিষ্ট সজ্জায় থাকে। অর্থাৎ বস্তুর সবগুলো অনুর মধ্যে বন্ধন একই রকম। যেদিক দিকেই দেখে অণুগুলোর সজ্জা একইরকম দেখবেন। তরল পানিতে একটা অুণর সঙ্গে আরেকটা অণুর বন্ধন সুষম নয়। একেক জায়গায় একেক রকম। কিন্তু বরফের মধ্যে পানির অণুগলোর মধ্যে বন্ধ একেবারে সুষম। তাই বরফখণ্ডগুলো একেকটা ক্রিস্টাল বা স্ফটিক। ক্রিস্টালের ভেতর পরমাণুগুলো সজ্জিত থাকে স্তরে সস্তরে। দুটি স্তরে মধ্যে তাই খুব সূক্ষ্ম ফাঁক থাকে। এজন্যই ক্রিস্টালগুলোর ঘনত্ব তুলনামূলক কম থাকে।

এই যে দুই স্তর মধ্যে যে সূক্ষ্ম ফাঁক, এগুলোকে অপবর্তন গ্রেটিংয়ের আঁচড়ের মতো ব্যবহার করা যেতে পারে। এর ভেতর দিয়ে সহজেই আলোক রশ্মি বেরিয়ে যেতে পারে। ক্রিস্টালের ভেতর দুটি স্তরের দূরত্ব খুবই কম। তাই লাওয়া বললেন, সহজেই অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের এক্সে রের ব্যতিচার ঘটনা যেতে পারে। এখানে দুটি স্তরের মধ্যে দূরত্ব একটি অণু বা পরমাণুর সমান।

ক্রিস্টাল নয়, এমন স্বচ্ছ বস্তুর মধ্যে অণু বা পরমাণুর সজ্জা সুষম নয়, এলোমেলো। তাই এদের মধ্য দিয়ে যাদি এক্স রে পাঠানে হয়, তহলে এক্স রেও সেগুলোর সঙ্গে ধ্বাক্কা খেয়ে এলোমেলোভাবে চলবে। ক্রিস্টাল থেকে বেরিয়ে একটা নকশাও তৈরি করবে। সেই নকশাটা হবে গোলাকৃতির। এর মাঝখানটা হবে অন্ধকার একটা ছোট্ট বৃত্তের মতো। বৃত্তের বাইরের দিকটা ক্রমেই উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হবে। কিন্তু কিন্তু টমাস ইয়ং যেমন ব্যতিচার নকশা পেয়েছিলেন, তেমনটা পাওয়া যাবে না। ইয়ংয়ের নকশায় দেয়ালের ওপর যতটুকু জায়গাজুড়ে নকশা তৈরি হয়, তার সব জায়গায় একটার পর একটা অন্ধকার ও উজ্জ্বল বিন্দু বা রেখা পাওয়া যাবে সুষম ভাবে।

লু বললেন, যখন সত্যিকারের ক্রিস্টালের মধ্য দিয়ে যখন এক্স রে যাবে, তখন সেগুলো সুনির্দিষ্ট পথে যাবে। দুটি স্তরের মধ্যে দিয়ে যাওয়া এক্স রশ্মি ক্রিস্টাল থেকে বের হওয়ার পর কোনো দেওয়ালের ওপর যদি পড়ে, তাহলে এরা সত্যি সত্যি একটা ব্যাতিচার নকশা তৈরি করবে। সেটা ইয়ংয়ের নকশার মতো।

সে না হয় হলো, এক্স রে তো দৃশ্যমান আলোকরশ্মি নয়, তাহলে সে দেয়াল বা পর্দার ওপর ব্যতিচার নকশা তৈরি করবে কীভাবে? আর যদি করেও সেটা আমরা দেখতে পাব তো?

ইয়ংয়ের পরীক্ষার মতো সাধারণ দেয়াল বা পর্দা নিয়ে পরীক্ষা করলে ফল পাওয়া যাবে না। কিন্তু সাধারণ পর্দার বদলে ফটোগ্রাফিকব প্লেট ব্যবহার করা হয়, যে সব প্লেট হাড় ভাঙ্গা, কিংবা বুক বা পেটের ভেতরের রোগ নির্ণয় করতে ব্যবহার করা হয়, তাহলে তাতে অবশ্যই ব্যতিচার প্যাটার্ন ফুটিয়ে তোলা যাবে।

ম্যাক্স ভন লু নিজেই একটা পরীক্ষা করেন। ১৯১২ সালে। জিংক সালফাইডের ক্রিস্টালের ভেতর দিয়ে চালনা করেন এক্স রশ্মি। সত্যি যেমনটা অনুমান করেছিলেন লু, ফটোগ্রাফিক প্লেটে ইয়ংয়ের ডাবল স্লিট পরীক্ষার মতোই পাওয়া গেল ব্যতিচার নকশা। এক্স রে ক্রিস্টালগ্রাফির বিশাল এক দুনিয়া উন্মোচিত হলো বিজ্ঞানীদের সামনে, ঠিক যেন আলিবাবার গুহার মতো করে।

বিজ্ঞানীরা শতভাগ নিশ্চিত হলেন, এক্স রশ্মি সত্যি সত্যিই একধরনের আলোক রশ্মি। অর্থাৎ এক্স রে তরঙ্গ এবং সাধারণ আলোক রশ্মির মতো অনুপ্রস্থ তরঙ্গ।

এই বিশাল অবদানের জন্য নোবেল কমিটি অবশ্য স্বীকৃতি দিতে দেরি করেনি। ১৯১৪ সালেই নোবেল দেওয়া হলো লু কে।

ম্যাক্স ভন লুর দেখানো পথে হাঁটলেন দুই ব্রিটিশ বিজ্ঞানী হেনরি ব্র্যাগ ও তাঁর পুত্র লরেন্স ব্র্যাগ। পিতা-পুত্র আদাজল খেয়ে লেগে পড়লেন এক্স রে ক্রিস্টালগ্রাফিতে। তাঁরা দেখালেন, লু ক্রিস্টালের মধ্য দিয়ে এক্স রে প্রবাহিত করে যেমন এর ব্যতিচার নকশা তৈরিতে সক্ষম হয়েছিলেন, একই পদ্ধতিতে এক্স রে তরঙ্গ দৈর্ঘ্যও নির্ণয় করা সম্ভব। এর জন্য অবশ্য একটা শর্ত জূড়ে দিলেন দুই ব্র্যাগ। বললেন, এক্স রের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য এ পদ্ধতি নির্নয় করা সম্ভব, যদি ক্রিস্টালের যে দুই স্তরের মধ্য দিয়ে এক্স রে চালনা করা হচ্ছে, সেই দুই স্তরের মধ্যবর্তী দূরত্ব নির্ণয় করা যায়।

লু যেবছর জিংক সালফাইডের মধ্য দিয়ে এক্স রে প্রবাহিত করে অপবর্তন নকশা তৈরি করেছিলেন, তার পরের বছর অর্থাৎ ১৯১৩ সালে দুই ব্র্যাগ এক্স রের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য নির্ণয় করে দেখালেন। তার দেখালেন অ্যান্টি ক্যাথোডের প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে এক্স রের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের ৫০ হাজার ভাগের এক ভাগ থেকে ৫০ ভাগের এক ভাগ হয়। স্বীকৃতিও মিলল শিগগির, ১৯১৪ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেলেন হেনরি আর লরেন্স ব্র্যাগ।

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি