মোঃ আরমান আলী সরকার প্রকাশ
অটিজম কি?
অটিজম শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ জনিত
একটি সমস্যা যেখানে আক্রান্ত শিশুর অন্যান্য মানুষের সাথে পারস্পরিক
সামাজিক যোগাযোগ ও সম্পর্ক তৈরির ক্ষমতায় ঘাটতি থাকে। অর্থাৎ এরা অন্য কারো
সাথে সামাজিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে পারে না এবং মনের ভাব আদান-প্রদান
করতে পারে না। পাশাপাশি এই ধরনের শিশুর কিছু কাজের পুনরাবৃত্তি করার
প্রবণতা থাকে এবং বিশেষ কিছু আচরণ পরিলক্ষিত হয়। অটিজমে আক্রান্ত শিশুর
শারীরিক গঠন জনিত কোনো সমস্যা থাকে না। এমনকি এদের দৃষ্টি শক্তি ও শ্রবণ
শক্তিরও তো কোনো সমস্যা থাকে না।
রোগের উপসর্গ কি?
জন্মের প্রথম বছরে অটিজমের লক্ষণ
তেমনভাবে প্রকাশ পায় না। এই বয়সে শিশু অন্যান্য স্বাভাবিক শিশুর মতোই বেড়ে
ওঠে। তবে ১৮ থেকে ২৪ মাস বয়সের মধ্যে সাধারণত উপসর্গগুলো বোঝা যায়। অটিজমে
আক্রান্ত শিশুদের উপসর্গগুলো হলো:
** অটিজমে আক্রান্ত শিশু কারও চোখে চোখে তাকায় না।
** এরা চারপাশে উপস্থিত লোকদের কথা শুনতে আগ্রহ দেখায় না, এমনকি তাদের কোনো কথায় সাড়া দেয় না।
** এই শিশুরা সহসা নিজেদের আনন্দ অনুভূতি অন্যের সাথে ভাগ করতে পারে না। নিজের চাওয়া, নিজের অনুভূতি কারো কাছে প্রকাশ করতেও পারে না।
** কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে এই শিশুরা সেটা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় না।
** অন্যের অনুভূতি এরা বুঝতে পারে না। অন্য কেউ ক্ষোভ, দুঃখ বা স্নেহ প্রদর্শন করলেও এরা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না, নির্লিপ্ত থাকে।
**
সমবয়সী অন্য শিশুদের সাথে এই শিশুরা মিশতে পারে না। এই শিশুরা একা একা
খেলতে পছন্দ করে। এরা নিজেদের চারপাশে আলাদা একটা জগৎ তৈরি করে তার ভিতর
বাস করে এবং আক্রান্ত শিশুদের এই ধরনের আচরণের জন্য অন্য কোনো শিশুও এদের
সাথে মিশতে চায় না।
** কেউ কোনো প্রশ্ন করলে উত্তর দেওয়ার পরিবর্তে সেও একই কথার পুনরাবৃত্তি করে।
** নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম কানুনের বাহিরে এরা যেতে চায় না।
**
এই ধরনের শিশুদের মাঝে একই রকম কাজ বারবার করার প্রবণতা দেখা যায়। এরা
নির্দিষ্ট কোনো অঙ্গভঙ্গি বারবার করে যেমন: কোনো বস্তুর চতুর্দিকে ঘুরছে,
দরজার কপাট বারবার খুলছে এবং বন্ধ করছে। কোনো হাত অকারণেই বারবার নাড়াচ্ছে।
** এই ধরনের শিশুরা একটু দেরিতে কথা বলতে শিখে।
**
পারস্পরিক সম্পর্কগুলো অনেক ক্ষেত্রেই তারা বুঝতে পারে না। যেমন এসব
শিশুরা যদিও বাবা-মা বলা শিখে। কিন্তু দেখা যায় নিজের বাবা-মাকে এরা
‘বাবা-মা’ বলে, পাশাপাশি পাশের বাড়ির কাউকে দেখলেও এরা বাবা-মা বলে ডাকে।
**
দৈনন্দিন জীবন যাপনে প্রক্রিয়ার সামান্য পরিবর্তন এরা পছন্দ করে না। যেমন:
প্রতিদিন যে সময় খাবার খায়, ঠিক সেই সময় তাকে খাবার না দিলে সে বিরক্ত
প্রকাশ করে। তার খেলনাগুলো যেভাবে সাজানো রয়েছে, তার একটু ব্যতিক্রম হলেই
সে বিরক্ত প্রকাশ করে।
** এ ধরনের শিশুদের অনেক
ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য অনুভূতিতে সমস্যা থাকে। যেমন: বিশেষ কোনো শব্দ
শুনলে অনেক শিশু দুই হাত দিয়ে কান চাপ দিয়ে ধরে রাখবে, যেন কানে শব্দ না
ঢোকে। কোনো কোনো শিশু হাটার সময় পায়ের তলায় মেঝের স্পর্শ পছন্দ করে না, ফলে
সে হাঁটার সময় আঙ্গুলের উপর ভর দিয়ে হাঁটার চেষ্টা করে। আবার কোনো কোনো
শিশু যে কোনো কিছু পেলেই তার ঘ্রাণ নেওয়ার বা তা চেটে দেখার চেষ্টা করে।
অটিজম রোগ হবার কারণ কি?
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই
অটিজমের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ এখন পর্যন্ত জানা সম্ভব হয়নি। এর কারণ নিয়ে
এখনও বিস্তর গবেষণা চলছে। তবে সম্ভাব্য কিছু কারণ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া
যায়। যেমন:
** অটিজম হওয়ার জন্য জিনগত কারণ দায়ী থাকতে পারে। দেখা
গেছে কোনো পরিবারের একটি শিশুর অটিজম রয়েছে এবং তার পরে জন্ম নেওয়া
শিশুটিও অটিজমে আক্রান্ত হয়েছে।
** নির্ধারিত সময়ের আগে এবং কম ওজন নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশুর অটিজম আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
** ৩৫ বছরের বেশি বয়সে কোনো মা গর্ভধারণ করলে সেক্ষেত্রে গর্ভের সন্তানের পরবর্তীতে অটিজম হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
** মায়ের যদি গর্ভকালীন সময়ে ডায়াবেটিক রোগ থাকে, তাহলে তার গর্ভজাত শিশুরও এই রোগ হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
**
এর পাশাপাশি শিশুর কিছু কিছু রোগের সাথে এই অটিজম হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
যেমন: কোনো শিশু যদি ডাউন সিনড্রোম, টিউবেরাস ক্লেরোসিস, ফ্র্যাজাইল এক্স
সিনড্রোম, কনজেনিটাল রুবেলা সিনড্রোম, অ্যাঞ্জেলম্যান সিনড্রোম ইত্যাদি
রোগে আক্রান্ত হয় তাহলে সেই শিশুটির অটিজম হবার ঝুঁকি বাড়ে।
কিভাবে এই অটিজম রোগটি নির্ণয় করা হয়?
অটিজম রোগ
নির্ণয়ের সুনির্দিষ্ট কোনো ল্যাবরেটরী টেস্ট নেই। অর্থাৎ রক্ত পরীক্ষা করে
অথবা মস্তিষ্কের কোনো সিটিস্ক্যান বা এমআরআই করে এই রোগ নির্ণয় করা যায় না।
মূলত শিশুর ব্যাপারে তার বাবা-মার কাছ থেকে সমস্যার বিস্তারিত ইতিহাস
জেনে, শিশুটিকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে এবং শারীরিক পরীক্ষা করে এই রোগ
নির্ণয় করা হয়। পাশাপাশি এ রোগ নির্ণয়ের জন্য কিছু চার্ট রয়েছে। সেই চার্ট
অনুযায়ী বাবা-মাকে কিছু প্রশ্ন করে, শিশুর কিছু আচরণ দেখে স্কোরিং
সিস্টেমের মাধ্যমে এই রোগ নির্ণয় করা হয়।
শিশুর কি কি লক্ষণ দেখে বাবা-মার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত?
জন্মের
প্রথম এক-দেড় বছর বয়স পর্যন্ত বেশিরভাগ বাবা-মা বুঝতেই পারে না যে তার
শিশুর এই অটিজম রোগটি রয়েছে। সুতরাং, কিছু লক্ষণের বিষয়ে বাবা-মার সচেতন
হওয়া উচিৎ এবং সেরকম কোনো লক্ষণ বুঝতে পারলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিৎ।
** শিশু যদি ৬ মাস বয়সেও তার সামনে হাসলে, প্রতি উত্তরে যদি সে না হাসে।
** শিশুর ৯ মাস বয়সেও যদি তার মুখের স্বাভাবিক অভিব্যক্তি প্রকাশ না পায়।
** শিশুর ১২ মাস বয়সে যদি মুখ দিয়ে কোনো শব্দ না করে।
**
শিশু ১৪ মাস বয়সেও যদি আঙ্গুল দিয়ে কোনো কিছু নির্দেশনা করে। সাধারণত তার
সামনে কোনো খেলনা থাকলে, তাকে সেই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে সে আঙ্গুল দিয়ে
সেটা দেখিয়ে দেবার কথা।
** শিশু ১৬ মাস বয়সেও যদি একটি শব্দও বলতে না পারে।
** ১৮ মাস বয়সেও যদি শিশু কাউকে অনুকরণ করতে না পারে।
** শিশুর বয়স ২ বছর হয়ে যাওয়ার পরও যদি সে দুই শব্দ যুক্ত কোনো বাক্য বলতে না পারে।
** কোনো শিশু যদি কোনো কথা বা কাজ যা শিখেছিলো সেটা ভুলে যায় অথবা এখন আর করতে সক্ষম না হয়।
দেরিতে কথা বলা কি অটিজমের লক্ষণ?
অটিজমে আক্রান্ত
শিশুরা দেরিতে কথা বলে। কিন্তু দেরিতে কথা বললেই যে সেটা অটিজম, বিষয়টি
সেরকম নয়। কোনো শিশু যদি অন্য কোনো ব্যক্তির চোখে চোখে তাকায়, ডাকলে সারা
দেয় বা অন্যান্য শিশুদের সাথে মিশতে পারে সেক্ষেত্রে সে কথা দেরিতে বললেও
তা অটিজম নয়।
অটিজমের চিকিৎসা কি?
বিভিন্ন থেরাপি হলো এই রোগের
মূল চিকিৎসা। যেমন: আচরণগত থেরাপি, ভাষাগত বা ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি, শিক্ষাগত
বা এডুকেশনাল থেরাপি এবং পেশাগত বা অকুমেশনাল থেরাপি ইত্যাদি। এই রোগের
জন্য নির্দিষ্ট কোনো ঔষধ নেই। তবে এই রোগের সাথে যদি অন্য কোনো সমস্যা
যেমন: অস্থির-চঞ্চলতা, বিষণ্নতা, খিঁচুনি রোগ ইত্যাদি থাকে, তাহলে সেই
সমস্যা অনুযায়ী ঔষধ সেবনের প্রয়োজন হয়।