Loading..

প্রেজেন্টেশন

০৩ এপ্রিল, ২০২২ ০২:৩৪ অপরাহ্ণ

যানবাহন সমস্যার সমাধান

যানবাহন সমস্যার সমাধান



বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরে পরিবহন সমস্যা বিরাট আকার ধারণ করেছে। হানাদার পাকিস্তানিদের রেখে যাওয়া কয়েকটি পুরোনো বাস নিয়ে বিআরটিসি যাত্রা শুরু করলেও একই সময় বেশ কয়েকটি বাস প্রাইভেট সেক্টরে চালু হয়। আমার এখনো মনে পরে বাসগুলো তখন ঢাকা থেকে নয়ারহাট, গুলিস্থান কমলাপুর লাইনে যাতায়াত করতো। অনেকে এই পুরানো বাসগুলোকে বলতো মুড়ির টিন। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় তখন প্রয়োজনের তুলনায় বাসের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত নগণ্য।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সরকারের অর্থনৈতিক অবস্থা তখন শূন্যের কোটায়। এমনি এক পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু সরকার দ্রুত যানবাহন সমস্যা সমাধানের লক্ষে ভারত থেকে কয়েকটি টাটা কোম্পানির বাস আমদানি করে। কিন্তু তৎকালীন জাসদ ভারত থেকে কেন আমদানি করা হয়েছে এই অভিযোগ তুলে বেশ কয়েকটি বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়। অথচ পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পরবর্তীতে যারা ক্ষমতায় ছিলেন তখন শুধু টাটা কোম্পানির বাসই নয়, ভারতীয় গাড়ি কোম্পানির ওয়ার্কশপ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জাসদ এই সময় ভারতের কোনো প্রতিবাদ জানিয়ে বাস জ্বালানো তো দূরের কথা ভারতের বিরুদ্ধে কোনো টু শব্দ পর্যন্ত করেনিl

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পরবর্তীতে দীর্ঘ ২১ বৎসর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল না। তাহলে বাংলাদেশ বাণিজ্যে ভারতের ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হলো কেন? আসলে ওই সময়ের ক্ষমতাসীনদের রাজনীতি ছিল মুখে ভারত বিরোধী আর কাজে ভারতপ্রীতি। রাজনীতির এই খেলায় যে জাসদ একদিন ভারত থেকে আমদানি করা বাস জ্বালিয়ে দিয়েছিলো সেই জাসদের কয়েকজন নেতা এখন নৌকায় স্থান করে নিয়েছেন। অথচ এই জাসদ স্বাধীনতার পর নানাভাবে মিথ্যা ও বানোয়াট বক্তব্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করে। হরতাল ডেকে যানবাহন জ্বালিয়েছে। বিষয়গুলো আমার চেয়ে আরও ভালো বলতে পারবেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ভাইl কারণ আমরা সকলেই তখন একসাথে মুজিববাদী ছাত্রলীগে সক্রিয় থেকে জাসদের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ প্রতিহত করেছিলামl

ঢাকা শহর এখন আর ৭২-৭৫ ঢাকা শহর নয়। সীমানা পেরিয়ে এখন উত্তরা সাভার পর্যন্ত এসে ঠেকেছে। দিন দিন এই পরিসীমা আরও বর্ধিত হচ্ছেl সাথে সারা দেশে মানুষের সংখ্যা এখন প্রায় ১৮ কোটিতে এসে দাঁড়িয়েছেl আর বঙ্গবন্ধুর আমলে ছিল মাত্র ৮ কোটিl এদিকে জনসংখা বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে আজ পর্যন্ত কোনো সরকারই নিরাপদ সড়ক ও পর্যাপ্ত বাস ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সামর্থ হয়নিl অন্যদিকে ক্ষমতায় থাকা সব সরকার বিআরটিসি বাসের সংখ্যা চাহিদা অনুসারে বৃদ্ধি না করে যানবাহন সমস্যা সমাধানে প্রাইভেট সেক্টরকে উৎসাহিত করেl ফলে দেশে চলাচলরত যানবাহন দিন দিন প্রাইভেট সেক্টরের উপর নির্ভরশীল হয়ে পরেl এভাবেই ঢাকা শহরসহ সারা দেশের যানবাহন ব্যবস্থা এখন প্রাইভেট সেক্টর দ্বারা নিয়ন্ত্রিতl

এই কারণে নানা দাবি জানিয়ে কথায় কথায় বাস মালিক সমিতি ধর্মঘটের ডাক দিয়ে সরকার ও জনগণকে দুর্দশায় ফেলার সুযোগ পায়l জনগণের চাহিদা অনুসারে বিআরটিসির বাসের সংখ্যা বৃদ্ধি করলে ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা এভাবে প্রাইভেট সেক্টরের নিয়ন্ত্রণে যেতে পারতো নাl

অনুসন্ধান করে দেখা গেছে যে বেশিরভাগ বাস ট্রাকের মালিক সরকারি আমলা, পুলিশ, সামরিক বাহিনী, ক্ষমতাসীন দলের নেতা, অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধতন সরকারি কর্মকর্তা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, এমপি, মন্ত্রিসহ ক্ষমতাবান ব্যক্তিl ফলে গাড়ির চালকেরা নিজেদের অত্যন্ত শক্তিশালী মনে করেl গাড়ি চালাতে গিয়ে আইনতো দূরের কথা কোনো কিছুকেই তারা ভয় করে নাl ড্রাইভারদের এই অতিরিক্ত সাহস রাস্তায় পাল্লা দিয়ে বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাতে উৎসাহিত করেl এসকল যানবাহনের চালকের আসনে অনেকসময় লাইসেন্সবিহীন কম বয়সের হেলপারদেরও বসতে দেখা যায়l

অনুসন্ধান করে দেখা গেছে ঢাকায় এ পর্যন্ত যতগুলো দুর্ঘটনা ঘটেছে তার বেশিরভাগ বাস ব্যক্তিগত মালিকানাধীনl সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয় বছরের পর বছর দেখেও না দেখার ভান করছেl সমস্যাটা যে শুধু বর্তমান সরকারের সৃষ্টি তা কিন্তু নয়l বঙ্গবন্ধু সরকারের পরবর্তীতে যারা ক্ষমতায় আসে তারা যানবাহন সমস্যা সমাধান ও নিরাপদ সড়ক দিতে ব্যর্থ হয়l সরকার শুরুতেই বিষয়টির উপর গুরুত্ব দিলে প্রতিবৎসর হাজার হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করতো না।

ঢাকা শহরে খুব সম্ভবত এখন পাঁচ হাজারের কাছাকাছি বাস চলাচল করে। এদের মধ্যে সরকারি মালিকানাধীন বাসের সংখ্যা নামমাত্র। যদিও সরকারের বার্ষিক বাজেটের একটা বড় অংশ যানবাহন ক্ষেত্রে বরাদ্দ করা হয়েছে। তবুও কেন সরকারকে প্রাইভেট সেক্টরের উপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে? এখানেই সরকারের এক বিরাট ভুলl

বর্তমান সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ভাইকে যদি এখন প্রশ্ন করা হয়, এ পর্যন্ত জনগণের চাহিদার উপর নির্ভর করে আপনার মন্ত্রণালয় কতগুলো সরকারি মালিকানাধীন বাস চালু করেছে? জানিনা তাহলে তিনি কি উত্তর দেবেনl হয়তো বলবেন একটা সংখ্যার কথাl কিন্তু সংখ্যাটি কি জনসংখা বৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য?

প্রাইভেট সেক্টরের উপর নির্ভরশীল না হয়ে সরকারের উচিত হবে আরও বেশি বিআরটিসি বাস রাস্তায় নামানো। সেই সাথে বাস চালকদের মজুরি বৃদ্ধি, দৈনন্দিন কাজের সময়, অতিরিক্ত ওভারটাইম কাজ করার উপর নিয়ন্ত্রণ, বাৎসরিক ছুটিসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবেl

বাংলাদেশের বাস চালকেরা জীবনযাত্রার ন্যূনতম মানদণ্ড অনুসারে উপযুক্ত মজুরি পায় না। লাভের বেশিরভাগ অংশ চলে যায় মালিকপক্ষের পকেটেl মালিকদের অর্থবিত্ত ও প্রভাব বেশি থাকায় ও চাকরি হারানোর ভয়ে শ্রমিকরা তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে পারে নাl এছাড়া মালিকপক্ষ তাদের স্বার্থের ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ। শ্রমিকদের অর্থবিত্ত নেই। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক কারণে অনৈক্য বেশি। রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে তারা তেমন বিদ্রোহী ভূমিকা রাখতে পারে নাl এভাবে বিভক্ত হয়ে শ্রমিকরা দিন দিন দুর্বল হচ্ছেl

শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় ট্রেড ইউনিয়ন করার আইনি সুযোগ থাকলেও মালিকপক্ষের নানা তৎপরতার কারণে তারা সংগঠিত হতে পারে না। ফলে বেঁচে থাকার তাগিদে তারা বাসে অবৈধভাবে অতিরিক্ত যাত্রীবহন করে অসৎ পথে আয় করতে উৎসাহিত হয়l মালিক ও আইনি কর্তৃপক্ষ জেনেও না জানার ভান করেl

ট্রান্সপোর্ট সমস্যা সমাধানে সরকারকে নিজস্ব মালিকানাধীন অর্থাৎ বিআরটিসি বাসের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি করা উচিতl প্রয়োজন অনুসারে প্রতিবছর বাসের সংখ্যা বৃদ্ধি করলে যানবাহন ব্যক্তিগত মালিকানাধীন থেকে অটোমেটিক সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবেl উন্নত মানের বিআরটিসি বাস চালু ও সাথে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন বাস থেকে কম ভাড়া নির্ধারণ করলে জনগণ সবসময় সরকারি বাসে যাতায়াতে উৎসাহিত হবেl উপযুক্ত বেতন দিলে সরকারি বাসের চালকদের পাল্লা দিয়ে গাড়ি চালানোর কোনো প্রয়োজন হবে নাl এজন্য সরকারকে তাদের একটা নির্ধারিত মানসম্পন্ন সরকারি মাসিক বেতন দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবেl সাথে বাসের চলাচল গতি ও অবৈধ যাত্রী পরিবহন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিভিন্ন স্থানে কন্ট্রোল রুম বসাতে হবেl এক্ষেত্রে প্রতিটি বাসে ক্যামেরা বসাতে হবেl এছাড়া বাসের যাত্রীদের জন্য মাসিক, সাপ্তাহিক, ২৪ ঘণ্টা ও এস এম এস টিকেট সিস্টেম চালু করতে হবেl তাহলে একদিকে বাসে অতিরিক্ত যাত্রী উঠানো যেমন কমবে তেমনি অন্যদিকে বাস চালকের নিরাপত্তার কোনো প্রশ্ন আসবে নাl

শুধু তাই নয়, বাস যাতায়াতে ক্যাশ লেনদেন না থাকলে ছিনতাইয়ের সম্ভাবনা থাকবে নাl তা সত্ত্বেও দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবেl সুইডেনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এখন বাস ট্রেন যাতায়াত ইলেক্ট্রনিক কার্ড সিস্টেম চালু করেছেl বাংলাদেশ চাইলে এই পথে এগিয়ে আসতে পারেl

সবশেষে আওয়ামী লীগের সম্প্রতি হয়ে যাওয়া কাউন্সিল অধিবেশন নিয়ে একটা কথা বলতে চাইl এই সম্মেলনে সবাইকে অবাক করে দিয়ে সাবেক জাসদ নেতা, সাবেক মন্ত্রী ও বাস মালিক সমিতির হর্তাকর্তা শাজাহান খানকে দলের প্রেসিডিয়ামের সদস্য করা হয়েছেl তাহলে কি সাবেক জাসদ নেতা শাজাহান খানের উপর আওয়ামী লীগ এখন নির্ভরশীল? পরিবহন সমস্যা সমাধানে সরকার কি এতই দুর্বল যে শাজাহান খানের মতো একজন সমালোচিত ব্যক্তিকে প্রেসিডিয়ামের সদস্য করতে হবে?

অতীতে মন্ত্রী থাকাকালীন তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে বিভিন্ন সময় অনৈতিক বক্তব্য দিয়ে সমস্যায় ফেলেন। শুধু তাই নয় সম্প্রতি নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের নেতা ইলিয়াস কাঞ্চনের বিরুদ্ধে তিনি মিথ্যা দুর্নীতির অভিযোগ তুলে এখন চুপ করে বসে আছেনl দুঃখজনক হলেও সত্য যে শাজাহান খানকে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামের সদস্য দেখে আজ আওয়ামী লীগের অনেক শুভাকাঙক্ষীদের মনে প্রশ্ন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ আজ চলছে কোন পথে?