Loading..

খবর-দার

১৩ মে, ২০২২ ১০:১৩ পূর্বাহ্ণ

থ্যালাসেমিয়া : মা-বাবা থেকে সন্তানে

থ্যালাসেমিয়া : মা-বাবা থেকে সন্তানে

জিনগত এই রোগে মা-বাবার মাধ্যমে সন্তান আক্রান্ত হয়।   



থ্যালাসেমিয়া : মা-বাবা থেকে সন্তানে

রক্তের এক ধরনের অসুখ থ্যালাসেমিয়া। এ অসুখটি মা-বাবার জিন থেকে সন্তানে আসে। এটি কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। একজন থেকে অন্যজনের শরীরে এটা ছড়ায় না। মানুষের রক্তে তিন ধরনের কণিকা থাকে। লোহিত রক্তকণিকা, শ্বেত রক্তকণিকা এবং অণুচক্রিকা। লোহিত রক্তকণিকায় থাকে হিমোগ্লোবিন। এই হিমোগ্লোবিন ফুসফুস থেকে শরীরের বিভিন্ন কোষে অক্সিজেন পরিবহন করে শরীরের স্বাভাবিক কার্যকলাপ বজায় রাখতে সাহায্য করে। আর থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্তের শরীরে এক ধরনের অস্বাভাবিক হিমোগ্লোবিন তৈরি হয়। এতে লোহিত রক্তকণিকা ধ্বংস হয়ে যায় এবং শরীরে রক্তস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়া তৈরি হয়। সব থ্যালাসেমিয়া এক নয়লোহিত রক্তকণিকার ভেতরে থাকা হিমোগ্লোবিনে দুই ধরনের প্রোটিন থাকে-আলফা গ্লোবিন ও বিটা গ্লোবিন। থ্যালাসেমিয়াতে এই গ্লোবিন আক্রান্ত হয়। কোন ধরনের গ্লোবিন প্রোটিন আক্রান্ত, তার ওপর ভিত্তি করে থ্যালাসেমিয়া ভাগ করা হয়। এ কারণে থ্যালাসেমিয়া দুই ধরনের-আলফা থ্যালাসেমিয়া এবং বিটা থ্যালাসেমিয়া। আবার উপসর্গ আছে কি নেই এর ওপর ভিত্তি করেও থ্যালাসেমিয়াকে ভাগ করা হয়। এ হিসাবেও এটি দুই ধরনের-থ্যালাসেমিয়া মেজর ও থ্যালাসেমিয়া মাইনর। মেজরে উপসর্গ থাকে, মাইনরে থাকে না বা কম থাকে।

সাধারণত মা-বাবা উভয়ই যদি থ্যালাসেমিয়া জিনের বাহক হয়, তাহলে সন্তান থ্যালাসেমিয়া মেজরে আক্রান্ত হতে পারে। আর যদি একজন থ্যালাসেমিয়া জিনের বাহক হয়, তবে মাইনর হতে পারে। মা-বাবার যেকোনো একজন বাহক হলে তাদের সন্তানও জিনটির বাহক হতে পারে।

সারা পৃথিবীতেই থ্যালাসেমিয়া রোগী দেখা যায়। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এবং মধ্যএশিয়া, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল, মধ্যপ্রাচ্য, ভারত উপমহাদেশ ও উত্তর আফ্রিকায় থ্যালাসেমিয়া রোগী বেশি দেখা যায়। এর কারণ ম্যালেরিয়া বলে মনে করা হয়। এসব অঞ্চলে ম্যালেরিয়া হয় বলে শরীরে এক ধরনের প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে ওঠে, যা আবার থ্যালাসেমিয়া করতে পারে।

বিশ্বজুড়ে দেড় শতাংশ মানুষ বিটা থ্যালাসেমিয়া ও পাঁচ শতাংশ মানুষ আলফা থ্যালাসেমিয়ার বাহক বলে মনে করা হয়। বহু বাহক সারা জীবন জানতেই পারেন না যে তিনি এ রোগের বাহক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অন্য কোনো রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময় তিনি যে বাহক তা জানতে পারেন।

 থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ

থ্যালাসেমিয়া মাইনরে সামান্য অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা ছাড়া সাধারণত বড় কোনো উপসর্গ থাকে না। থ্যালাসেমিয়া মেজরে সাধারণত শিশুর জন্মের দুই বছরের মধ্যে উপসর্গসহ স্পষ্ট হয়। উপসর্গের মধ্যে আছে-

* অতিরিক্ত কান্নাকাটি করা

* ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া

* অল্পতেই হাঁপিয়ে যাওয়া

* সংক্রামক রোগে বেশি আক্রান্ত হওয়া

* ক্ষুধামান্দ্য বা খেতে অনীহা

* শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধি না হওয়া

* জন্ডিস (হলুদ চামড়া)

* প্লীহাস্ফীতি ইত্যাদি।

অনেক সময় এই লক্ষণ এত বেশি থাকে যে শিশুকে নিয়মিত রক্ত দিতে হয়।

আলফা থ্যালাসেমিয়ায় শরীরের হাড়ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে সহজেই হাড় ভেঙে যায়, সঙ্গে রক্তস্বল্পতা, জন্ডিস, প্লীহাস্ফীতি ও অপুষ্টি থাকে। আলফা থ্যালাসেমিয়ার একটি খারাপ ধরন হলো, হাইড্রপস ফিট্যালিস। এ ক্ষেত্রে শিশু জন্মের আগেই অথবা জন্মের কিছু পরেই মৃত্যুবরণ করে।

থ্যালাসেমিয়া রোগীকে নিয়মিত রক্ত দিতে হয়। এতে আবার কিছু প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অতিরিক্ত আয়রন বা লোহা শরীরে জমা হয়ে হৃৎপিণ্ড, লিভার ও অনালগ্রন্থিতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। রোগী থাইরয়েড হরমোনজনিত অসুখ, ডায়াবেটিস, অ্যাড্রেনাল ও পিটুইটারি হরমোনজনিত অসুখে আক্রান্ত হতে পারে।

 রোগ নির্ণয়

ডাক্তাররা রোগের ইতিহাস, লক্ষণ, সাধারণ শারীরিক পরীক্ষা করে থ্যালাসেমিয়া সন্দেহ হলে কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট পরীক্ষা করে রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ দেখে থাকেন। প্রয়োজন মনে করলে হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস পরীক্ষাও করা হয়।

এক্স-রে করে দেখা হয় হাড় কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সাধারণত মাথা ও মুখমণ্ডলের এক্স-রে করা হয়। বুকের এক্স-রে পরীক্ষায় অনেক সময় দেখা যায় পাঁজরের হাড় বিকৃতি ঘটেছে। অনেকের হার্টও আকারে বড় হয়ে যায়।

 চিকিৎসা

* যাদের রোগটির লক্ষণ নেই তাদের জন্য আলাদা কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। তবে তাদের ক্ষেত্রে আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ না করা উচিত।

* নিয়মিত রক্তপরিসঞ্চালনের জন্য থ্যালাসেমিয়ায় আয়রন জমা হয়। কিন্তু রক্তে হিমোগ্লোবিন কম থাকায় বা ক্ষতিগ্রস্ত থাকায় আয়রনজাতীয় খাবার খেলে তা বেশি পরিমাণ শোষিত হয়। গরু বা খাসির মাংস, কলিজা, ডিমের কুসুম, তরমুজ, খেজুর, শিম, আলু, বাদাম ইত্যাদিতে প্রচুর আয়রন থাকে। থ্যালাসেমিয়া রোগীর এগুলো এড়িয়ে চলা উচিত। আবার ডাক্তারি পরামর্শ ছাড়া অযথা মাল্টিভিটামিন বড়ি খাওয়া উচিত নয়। খাবারের সঙ্গে চা খেলে শরীরে আয়রনের শোষণ কম হয়। এ রোগীদের ধূমপান ও মদ্যপান করা উচিত নয়।

* নিয়মিত রক্ত নেওয়া

* লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা যেমন : সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক সেবন

* অস্থিমজ্জা বা বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন। (ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও হয়। )

* প্লীহা বড় হয়ে গেলে অপারেশন করা ইত্যাদি।

 থ্যালাসেমিয়ার পরিণতি

* থ্যালাসেমিয়া মাইনর রোগী অন্যান্য স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবনধারণে সক্ষম; কিন্তু এই রোগী থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক।

* থ্যালাসেমিয়া মেজরে আক্রান্ত রোগী সাধারণত ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সে হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে মৃত্যুবরণ করে।

* হাইড্রপস্ ফিটালিস সাধারণত জন্মের আগে অথবা জন্মের অব্যবহিত পরেই মৃত্যুবরণ করে।

থ্যালাসেমিয়া রোগী কত দিন বাঁচবে অথবা তার জীবনগতি কেমন হবে, তা নির্ভর করে রোগের প্রকারভেদ বা ধরনের ওপর।

 জেনেটিক কাউন্সেলিং বা পরামর্শ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে বহু মানুষ থ্যালাসেমিয়ার বাহক এবং প্রতিবছর ছয় হাজার থ্যালাসেমিক শিশু এ দেশে জন্মগ্রহণ করে। কাজেই বাহক পিতা-মাতার জন্য জেনেটিক কাউন্সেলিং চিকিৎসা নেওয়া উচিত। গর্ভধারণের সঙ্গে সঙ্গে কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে অনাগত শিশু থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত হতে পারে কি না সে বিষয়ে ধারণা পাওয়া যায়। এ পরীক্ষাটির নাম অ্যামনিওসেন্টেসিস।

পিতা ও মাতা উভয়ই জিনটির বাহক হলে 'থ্যালাসেমিয়া মেজর' আক্রান্ত শিশু জন্ম নেওয়ার আশঙ্কা ২৫ শতাংশ এবং বাহক শিশু জন্ম নেওয়ার আশঙ্কা ৫০ শতাংশ। সুস্থ শিশু জন্ম নেওয়ার আশা মাত্র ২৫ শতাংশ। একজন বাহক হলে শিশুও জিনটির বাহক হতে পারে। নিকট আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে হলেও সন্তানের থ্যালাসেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।