প্রভাষক
২৮ জুন, ২০২২ ১১:২৯ পূর্বাহ্ণ
মদিনা শরীফের যিয়ারতের ফজিলত
হজ্বের কোন আহকাম বা হুকুমে (ফরয, ওয়াজিব, সুন্নত) মদিনা শরীফ জিয়ারতের কথা নাই। কাজেই হজ্ব শেষে ক্লান্ত- পরিশ্রান্ত শরীর নিয়ে মদিনা গিয়ে রওজা জিয়ারতের কোন দরকার নাই- (নাউজুবিল্লাহ) অথবা
রওজা জিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদিনা যাওয়া যাবেনা- এটা শিরিকের পর্যায়ে পড়ে, কারণ তিন মসজিদ ছাড়া ইবাদতের উদ্দেশ্যে সফর করা নিষেধ।{যদিও এমন কথা বলা লোকগুলো সারা বছর মসজিদে মসজিদে ঘুরে বেড়ায় }
=> ইদানীং এই রকম কিছু কথাবার্তা বলে একদল লোক সহজ সরল ইমানদার মানুষকে বিভ্রান্ত ও বিপথগামী করছে। তাদের হজ্ব ও আমলগুলো বরবাদ করার চক্রান্ত করছে। আসলে তারা লা-মাযহাবি বা আহলে হাদিস নামধারী মোনাফেক, দুশমনে রাসুল।
ইনশা আল্লাহ, এ বিষয়ে কুরআন- হাদিসের আলোকে কিঞ্চিত আলোচনা করবো। পাঠকগণকে, বিশেষ করে সম্মানিত হজ্বগামীদের গুরুত্ব ও মনোযোগ দিয়ে পড়ার অনুরোধ করছি। তারপর নিজেই সিদ্ধান্ত নিন।
পাঠ্য নং- ০১:
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর (রাদি.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ওফাতের পর আমার রওজা জিয়ারত করবে, সে যেন জীবিত অবস্থায় আমার সাথে সাক্ষাৎ করলো। অন্যত্র এসেছে, রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার ওফাতের পর আমার রওজা জিয়ারত করলো, সে যেন আমাকে আমার জীবদ্দশায় দর্শন করল।’ -বায়হাকি শরিফ।
=> এই হাদিস মতে, রওজা জিয়ারত করলে তেমনি ভাবে হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম) এঁর সাক্ষাত পাওয়া যায় যেভাবে সাহাবাকেরাম হায়াতে জিন্দেগীতে দেখা করেছেন- সুবাহানাল্লাহ। আর যে একবার এই সুযোগ পেল, তাঁর জীবনের গুনাহ মাফ হয়ে গেল এবং জান্নাত ওয়াজিব হয়ে গেল। যা ইবলিশ চায় না। তাই, লা-মাযহাবি বা আহলে হাদিস নামধারী মোনাফেক, রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম) এঁর দুশমনরা সহজ সরল ইমানদার মানুষকে বিভ্রান্ত করে এই অপার সুযোগ হতে বঞ্চিত করতে চায়। কারণ ইবলিশ আদম সন্তানদের জাহান্নামে নেয়ার শপথ করেছে আর কুরআনের ঘোষণা, নিশ্চয় শয়তান তোমাদের সরাসরি দুশমন।
.
পাঠ্য নং - ০২:
যে আমার সাথে সাক্ষাত করলো, কাল হাশরে তার জন্য সুপারিশ করা আমার প্রতি ওয়াজিব হয়ে গেল। বা
যে আমার রওজা জিয়ারত করলো, তার জন্য আমার সুপারিশ ওয়াজিব হয়ে গেলো। -সহিহ মুসলিম।
অন্যত্র এসেছে, হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম) এরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার রওজা জিয়ারত করবে তার জন্য শাফাআত করা আমার কর্তব্য হয়ে যাবে।’
=> যে রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম) এঁর সুপারিশ পেলো তাঁর ইহকাল ও পরকাল কল্যাণময় হয়ে গেল তাতে কোন সন্দেহ নাই। আল্লাহ বলেন, হে রাসুল, আমার কোন বান্দার দ্বারা যদি গুনাহ হয়ে যায় অতঃপর সে যেন আপনার দরবারে চলে আসে এবং এসে আমার নিকট ক্ষমা চায় এবং আপনি রাসুল যদি তাঁর পক্ষে সুপারিশ করেন তবে নিশ্চয় সে আল্লাহকে ক্ষমাশীল হিসেবে পাবে। চিন্তার বিষয়, আল্লাহ বলছেন, বান্দারা তোমারা আমার রাসুলের দরবারে যাও এবং ক্ষমা প্রার্থনার সাথে উনার সুপারিশের আবেদন করো আর তারা বলছে যাওয়া লাগবে না- নাউজুবিল্লাহ।
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর (রাদি.) আরও বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অন্য কোনো গরজ তাড়িত না হয়ে শুধুমাত্র আমার রওজা জিয়ারত করতে আসবে, তার জন্য পরকালে শাফাআত করা আমার কর্তব্য হয়ে যাবে এবং কেয়ামতের দিন আমি তার পক্ষে সাক্ষ্য প্রদানকারী হব।
=> আবার একই সাথে রওজা জেয়ারতে কাল হাশরে হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম) এঁর শাফাআত নসীব হবে। যে হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম) এঁর শাফাআত পাবে তাঁর না আছে কোন ভয়, না আছে চিন্তা।
পাঠ্য নং- ০৩:
যে ব্যক্তি মক্কায় হজ্জ আদায় করলো কিন্তু মদিনায় এসে আমার রওজা জিয়ারত করলো না, সে যেন আমার প্রতি জুলুম করলো- (তিরমিজি শরিফ, ইবনে আদি, সুনানে হাসান, শারহে লুবাব)।
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলে খোদা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি হজ্জ করলো, কিন্তু আমার রওজা জিয়ারত করলো না, সে যেন আমার প্রতি অসৌজন্য প্রকাশ করলো বা আমার প্রতি জুলুম করলো।
=> হায়; হায়, যে রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম) উসিলায় তামাম জাহান, এই হজ্ব পেয়েছি যার উছিলায়, নামাজ রোযা পেলাম যার উছিলায়, যার শাফায়াত ছাড়া কস্মিনকালেও কেউ পার পাবেনা, সেই রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম) এঁর প্রতি যদি জুলুম হয়ে যায়, এমন আমল কবুল তো হবেই না বরং তার মানবজীবনই বৃথা, নিশ্চিত ধ্বংস তার জন্য। আল্লাহ কুরআনে বলেন, তোমরা যদি আমার রাসুলের শানে কোন বেয়াদবি করো তাহলে আমি তোমাদের সারাজীবনের আমলগুলো ধ্বংস করে দিবো আর তোমরা তা টেরও পাবে না। আস্তাগফিরুল্লাহ। সামান্য বেয়াদবির পরিণাম যদি এই হয় তবে জুলুম করার পরিণাম কি হতে পারে ? আর হ্যাঁ, আমার দয়াল নবীজীর সাথে জুলুম করেছে আবু লাহাব, আবু জাহেলের মতো কাফেররা। তাহলে আজ যারা সেই জুলুম করবে তারাও তো ঐ দলেরই অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাদি.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম) বলেন, ‘যে ব্যক্তি হজ্ব করলো এবং আমার ওফাতের পর আমার রওজা জিয়ারত করলো, সে আমার জিয়ারতের সৌভাগ্য ঠিক তার মতোই লাভ করলো, যে আমার জীবদ্দশায় আমার জিয়ারত লাভ করেছে।’ (বায়হাকি, শুআবুল ইমান, মিশকাত শরিফ)।
অন্যত্র এসেছে রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম) বলেন ‘আমার উম্মতের মধ্যে যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও আমার রওজা জিয়ারত করলো না, তার কোনো ওজরই গ্রহণযোগ্য নয়।’ (ইলমুল ফিকহ)।
আবার রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম) বলেন ‘যে ব্যক্তি আমার রওজা জিয়ারতের জন্য এলো এবং এছাড়া তার আর অন্য কোনো কাজ ছিল না, তার জন্য শাফায়াত করা আমার ওপর হক (দায়িত্ব ও কর্তব্য) হয়ে গেল।’ (ইলমুল ফিকহ)।
=> এসব হাদিস শরিফ থেকে প্রমাণিত হয়, রওজা পাক জিয়ারত করা ওয়াজিব। মুজতাহিদ ইমাম ও ফকিহ উলামারা এই ফাতাওয়া ও সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। (আসান ফিকাহ, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা:২৫০- ২৫১)।
এমন অসংখ্য হাদিস ও আয়াত রয়েছে যা রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম) এঁর শান-মান ও উনার রওজাপাক জিয়ারতের সুস্পষ্ট দলিল। সব লিখতে গেলে লেখার কলেবর বৃদ্ধি পাবে এবং পাঠকগণের ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে পারে। তবে বুঝদারগণের জন্য এইটুকুই যথেষ্ট হবে বলে আশা রাখছি। আর যাদের তাকদিরে আল্লাহ হেদায়েত নসীব করেননি, তাদের হাজারটা বাণী শুনালেও কাজ হবে না। কারণ- আল্লাহ বলেন, আমি তাদের অন্তর বা কালবকে সিলগালা করে দিয়েছি। তাদের যতোই বুঝান কোন লাভ হবেনা।
=>>> শেষকথা, তবে কেন আল্লাহ বা রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম) মদিনা বা রওজাপাক জিয়ারতকে হজ্বের অংশ করলেন না? প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ তবে ইমানদার ও চিন্তাশীলদের জন্য উত্তর সহজ। মনে করে দেখুন, হযরত আদম (আঃ) যা করেছেন, আল্লাহ তা হজ্বের অন্তর্ভুক্ত করেছেন, হযরত ইব্রাহীম (আঃ) যা করেছেন, আল্লাহ তা হজ্বের অন্তর্ভুক্ত করেছেন, হযরত ইসমাইল (আঃ) যা করেছেন, আল্লাহ তা হজ্বের অন্তর্ভুক্ত করেছেন, হযরত মা হাজেরা (আঃ) যা করেছেন, আল্লাহ তা হজ্বের অন্তর্ভুক্ত করেছেন আর যার কারণে এবং যার আগমন ও রেসালতের বার্তা পৌঁছানোর জন্য উনারা সৃষ্ট ও নবী হলেন, সকল নবী ও রাসুলগনের সরদার, যাকে সৃষ্টি না করলে আল্লাহ কিছুই সৃষ্টি করতেন না, এমনকি উনারাও সৃষ্টি হতেন না। আল্লাহ তাঁর সেই প্রিয় মাহবুব, রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম) এঁর রওজা জিয়ারতকে কেন বাইলে রাখলেন ! এককথায়, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের একটি পরীক্ষা রেখেছেন এখানে, মহব্বতের পরীক্ষা, ঈমানের পরীক্ষা। উনি দেখবেন, যে হে বান্দারা, আমি যা বলেছি তোমরা তা করেছো, কিন্তু যার প্রেমে আমি সব করেছি সেতো পাগল উম্মতের। আমি দেখি, তাঁর উম্মত তাঁর জন্য কতোটা পাগল। হয়ে যাক, মহব্বতের পরীক্ষা, ঈমানের পরীক্ষা। এখানেই যাচাই-বাছাই হয়ে যাবে, কাল কবর, হাশর, মিজান, পুলসিরাতে কে নাজাতপ্রাপ্ত।
"বান্দা পাগল ক্বাবার জন্য, ক্বাবা পাগল মাবুদের,
মাবুদ পাগল নূর নবীজীর, নবী পাগল উম্মতের"
।। আল্লাহ মালিক ।।