Loading..

খবর-দার

০১ জুলাই, ২০২২ ০৭:১৭ পূর্বাহ্ণ

চাঁদে প্রথম মানুষ।চাঁদে প্রথম মানুষ।চাঁদে প্রথম মানুষ।চাঁদে প্রথম মানুষ।

চাঁদে প্রথম মানুষ।চাঁদে প্রথম মানুষ।চাঁদে প্রথম মানুষ।চাঁদে প্রথম মানুষ।


চাঁদে প্রথম মানুষ

চাঁদে প্রথম মানুষ

১৯৬৯ সালের ১৬ জুলাইয়ের সকাল। যুক্তরাষ্ট্রের কেপ কেনেডি স্পেস সেন্টারের আশপাশের কয়েক কিলোমিটার লোকে লোকারন্য। গত রাত থেকেই কার, জিপ, বাস, নৌকা এমনকি ছোট ছোট বিমানও গাদাগাদি অবস্থা গোটা এলাকা। অনেকেই ছোট ছোট তাবু খাটিয়ে অস্থায়ী আবাস বানিয়ে নিয়েছেন। কেউ কেউ খোলা আকাশের নিচেই আছেন বহাল তবিয়তে। হাতে ক্যামেরা, দুরবীন, রেডিও নিয়ে কৌতুহলে অধীর অপেক্ষা আর উত্তেজনার প্রহর গুনছেন তারা।

এদের বেশিরভাগই এসেছে আনন্দ-উল্লাস করতে। কেউ কেউ হাতে প্ল্যাকার্ড, ব্যানার নিয়ে এসেছে মহাকাশ খাতে মার্কিন সরকারের বিপুল অর্থ অপচয়ের বিক্ষোভ-প্রতিবাদ জানাতে। কিন্তু পক্ষ হোক আর বিপক্ষ হোক, সেদিন সেখানে উপস্থিত সবাই জানত, তারা আজ মানবজাতির অনেক বড় এক ইতিহাসের সাক্ষী হতে যাচ্ছেন। এ এমন এক ইতিহাস যা যুগ যুগ ধরে বলে গেলেও পুরোনো হবে না।

কিছুক্ষণ পরেই দুঃসাহসী তিন নভোচারীকে নিয়ে প্রায় তিন লাখ ৮৪ হাজার কিলোমিটার দূরের চাঁদের পানে ছুটে যাবে অ্যাপোলো ১১ নামের নভোযান। শুধু তাই নয়, মানব ইতিহাসে এবারই প্রথম পৃথিবীর বাইরে পা রাখবে মানুষ, চরকা কাটা চাঁদের বুড়ির দেশে পা রাখবে। হ্যাঁ, যন্ত্র নয়, আস্ত জলজ্যান্ত মানুষ। এর মাধ্যমেই সেদিন মহাকাশ প্রতিযোগিতায় চির প্রতিদ্বন্দ্বী সোভিয়েত ইউনিয়নকে দাঁত ভাঙা জবাব দেবে যুক্তরাষ্ট্র। তাই গোটা মার্কিনজাতি (নাকি মানবজাতি) যেনো কল্পনার ডানায় সেদিন তিন নভোচারী- নীল আর্মস্ট্রং, বাজ অলড্রিন ও মাইকেল কলিন্সের সাথে চাঁদের পথে রওয়ানা হয়েছিল।

স্থানীয় ঘড়িতে ৯টা বেজে ২৩ মিনিট। কেপ কেনেডির দিগন্তরেখায় আকাশমুখি করে রাখা রকেটের তলদেশে উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠতে শুরু করল। তীব্র আগুনের হলকার সাথে সাদা ধোয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যেতে লাগল চারদিক। ধুমকেতুর মত লেজে আগুনেপুচ্ছ রেখে ধীরে ধীরে আকাশের দিকে ছুটতে শুরু করল স্যাটার্ন ভি রকেট। ক্রমেই বাড়তে লাগল তার বেগ। রকেটটির ওপরের দিকে বিশেষ কায়দায় বসানো হয়েছে কমান্ড মডিউল ও লুনার মডিউল। তার মধ্যেই তখন বসে দাঁতে দাঁত চেপে মহাকর্ষের শক্ত বাধন ছিন্ন করছেন তিন নভোচারী।

পৃথিবীর মহাকর্ষের মায়া কাটিয়ে মহাশূন্যে অ্যাপোলো ১১-কে উঠার দৃশ্য দেখে নিচে দাঁড়িয়ে থাকা হাজার হাজার মানুষ উল্লাসে ফেটে পড়ল। কেউ কেউ অবশ্য আবেগের ভার সইতে না পেরে কেঁদে ফেলতেও দ্বিধা করল না। ঠিক তখন রকেটের মাথায় সুরক্ষিত নিয়ন্ত্রণকক্ষে বসে থাকা তিন নভোচারীর উত্তেজনা এখন অনেকটাই শান্ত হয়ে এসেছে। কারণ বিগত কয়েক বছর ধরে তারা এ দিনটির জন্য অপেক্ষা করে আসছিলেন। সেজন্য অনেক কঠিন সব প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে কৃত্রিম পরিবেশে। বাস্তবের চেয়ে অনেকক্ষেত্রে প্রশিক্ষণটাই কঠিন ছিল। তাই ভবিতব্য ঘটনাগুলো তাদের কাছে মুখস্তই ছিল।

স্যাটার্ন ভি রকেট উৎক্ষেপনের ৩ ঘন্টার পর পৃথিবীর কক্ষপথে এসে রকেট থেকে কলাম্বিয়া ও ঈগল আলাদা হয়ে গেল। তারপর দুই নভোযান একত্রে পৃথিবীর কক্ষপথে ছেড়ে চাঁদের পথে তিন দিনের যাত্রা শুরু করল। এই দীর্ঘ যাত্রার শুরুতেই অভিযাত্রীরা কলাম্বিয়ার পেছন থেকে লুনার মডিউল ঈগলকে বের করে এনে কলাম্বিয়ার সাথে জুড়ে দিলেন। এরপর দুই মডিউলের মধ্যে তারা প্রয়োজনমত যাতায়াত করতে লাগলেন। এই দুটো যানের নাম দেওয়া হয়েছে মার্কিন দুই জাতীয় প্রতীকের ওপর ভিত্তি করে। প্রথমটির আমেরিকার নারীরূপ কলাম্বিয়া আর দ্বিতীয়টি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পাখি ঈগল।

আগের অ্যাপোলো মিশনগুলো ছিল আসলে এই চূড়ান্ত অ্যাপোলো ১১ মিশনের জন্য স্রেফ প্রস্তুতি এবং মহড়া। তাই এই পথে কীভাবে যেতে হবে তা অ্যাপোলোর তিন অভিযাত্রী তথা নাসার জানাই ছিল। চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছার আগ পর্যন্ত তারা দুটো মডিউলের নানা যন্ত্রপাতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখলেন, কোথাও কোন ত্রুটি আছে কিনা। শুধু খাওয়া, ঘুম আর পৃথিবীবাসীর সাথে টিভিতে সরাসরি সম্প্রচারের সময়টুকু বাদে একটু বিশ্রাম নিতে পারলেন তিন নভোচারী-কমান্ড মডিউল পাইলট মাইকেল কলিন্স, লুনার মডিউল পাইলট বাজ অলড্রিন এবং কমান্ডার নীল আর্মস্ট্রং।

মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল পি. হান্টিংটনের আলোড়ন সৃষ্টিকারী বই দ্য ক্ল্যাশ সিভিলাইজেশন অ্যান্ড দ্য রিমেকিং অব ওয়ার্ল্ড অর্ডার। সে বইতে তিনি বলেছেন, ‘সাধারণ মানুষ বুঝে হোক, বা না বুঝে হোক সবসময়ই আমরা ও তারা, আমাদের ও তাদের দল, আমাদের সভ্যতা ও তাদের বর্বরতা- এরকম বিভক্ত হতে পছন্দ করে।’ এরকমই এক বিভক্তি এবং তা থেকে জন্ম নেওয়া চরম প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের চাঁদে অভিযানের এই পরিকল্পনা। এটা যতটা না বৈজ্ঞানিক গবেষণার স্বার্থে, তার চেয়েও অনেকগুণ বেশি ছিল রাজনৈতিক। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা-নাসার অ্যাপোলো অভিযান শুরু হয়েছিল আসলে রাশিয়ার (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন) সাথে ঠান্ডা যুদ্ধের কারণে।

মহাকাশ গবেষণায় যুক্তরাষ্ট্রকে একের পর এক হারিয়ে দিচ্ছিল প্রতিদ্বন্দ্বী সোভিয়েত ইউনিয়ন। মহাকাশে প্রথম স্যাটেলাইট স্পুটনিক-১ পাঠিয়েছিল রাশিয়া (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন)। সেই স্যাটেলাইট যখন পৃথিবীর কক্ষপথে বসে যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে উড়ে আলোক সংকেত দিচ্ছিল, তখন গোটা মার্কিনবাসীর মুখে মাছি ঢোকার মত হা করে চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। মহাকাশে প্রথম প্রাণী, লাইকা নামের এক কুকুর। সেও সোভিয়েত কৃতিত্ব। ১৯৬১ সালে মহাকাশে প্রথম মানুষ, ইউরি গ্যাগারিন। সারা বিশ্বে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে আবারও সোভিয়েত ইউনিয়ন, সেই সাথে সমাজতন্ত্রের। ১৯৬৩-র ১৬ জুন ভোস্তক ৬ নভোযানে চড়ে মহাকাশে যান প্রথম নারী এবং বেসামরিক নাগরিক ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভা। সে অর্জনও সোভিয়েতের। চাঁদের মাটিতে নামা প্রথম নভোযান লুনা ২। সে কৃতিত্বটাও সমাজতন্ত্রী সোভিয়েত ইউনিয়নের দখলে। পুঁজিবাদী পরাশক্তির নাকের ডগা দিয়ে একের পর এক সমজাতন্ত্রী স্পর্ধা আর কাহাতক সহ্য করা যায়। সেই তুলনায় মার্কিন অর্জন বলতে গেলে তেমন কিছুই নেই। তারাও মহাকাশে একে একে সবই করেছে। কিন্তু গোটা বিশ্ববাসীর কাছে সেগুলো সোভিয়েত ইউনিয়নের পদাঙ্ক অনুসরণ ছাড়া আর কিছু নয়। তাই মহাকাশে পাঠানো প্রথম মার্কিন প্রাণী, প্রথম মানুষ, প্রথম নারীর খোঁজ কিংবা মনে রাখেনি বিশ্ব। মার্কিন প্রশাসন অনেক চেষ্টা করেও মহাকাশে কোন ক্ষেত্রেই প্রতিযোগিতায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে পেরে উঠল না। তবে কি পুঁজিবাদী মার্কিনীরা সমাজতন্ত্রের কাছে পদানত? বিশ্ব যে আজ দিকে দিকে সমাজতন্ত্রের জয়গান করছে?

এভাবে মার্কিন জনগণের মনে জমতে লাগল ক্ষোভ আর অপমানের পাহাড়। সেই ক্ষোভ শেষপর্যন্ত আগ্নেয়গিরি হয়ে বেরিয়ে এলো ১৯৬০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। মহাকাশ গবেষণায় আরও জোর দেওয়ার কথা বলে প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারকে হটিয়ে নির্বিঘ্নে ক্ষমতার মসনদে বসলেন জন এফ. কেনেডি। আসলে মার্কিন জনগণের মনের কথাটা ঠিকঠিক বুঝতে পেরেছিলেন কেনেডি। বুঝতে পেরেছিলেন, মহাকাশ গবেষণায় (বলা ভালো, প্রতিযোগিতায়) সোভিয়েত ইউনিয়নকে টেক্কা দিতেই হবে যেকোন মূল্যে। কিন্তু সেটি কীভাবে করা সম্ভব? কারণ মহাকাশের সবগুলো ক্ষেত্রেই তো এরই মধ্যে প্রথম হয়ে বসে আছে তারা। অনেক আলোচনা আর বাকবিতণ্ডার পর কেনেডি প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিল, একমাত্র চাঁদে মানুষ পাঠিয়েই সোভিয়েত বেড়ায়াপনার দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া সম্ভব। তাই ১৯৬১ সালের ২৫ মে মাসে কংগ্রেসের এক যৌথ অধিবেশনে তিনি ঘোষণা দিলেন, ‘আমার বিশ্বাস, এই দশক শেষ হওয়ার আগেই চাঁদের মাটিতে মানুষ পাঠিয়ে তাকে নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনাটাই এই জাতির লক্ষ্য অর্জন করতে প্রতিজ্ঞা করা উচিত।’