Loading..

উদ্ভাবনের গল্প

২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ১২:২৩ অপরাহ্ণ

প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের রিডিং দক্ষতা প্রসঙ্গে

একটি শিশু যখন তার শিক্ষাজীবন শুরু করে, তখন তা প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক হোক মূলত শুরু হয় পড়ার দক্ষতা থেকেই। অর্থাৎ শিশু প্রথমেই পড়তে শেখে। শিশুর মুখে আধো আধো ভাষা ফোটে। শিশু প্রথমেই কথা বলতে শিখে। সেই বলা থেকেই সে তার চারপাশের বিভিন্ন প্রকৃতির উপাদানের ছবি দেখে বলা শিখে। এটা হলো বলতে পারার দক্ষতা। যেমন- মা তার সন্তানকে চাঁদ দেখিয়ে সেটা যে চাঁদ তা বলতে শেখায়। এভাবে প্রকৃতির প্রতিটি উপাদান সম্পর্কে সে বলতে শিখে। এমনকি যখন সে বই হাতে নেয়, তখন সেই বর্ণ পরিচয় মুখে বলতে শিখে।

এরপর আসে লেখা। সে মুখে বলে এবং লিখতে পারে। একজন শিক্ষার্থী মূলত যে দুই ধরনের যোগ্যতা অর্জন করে তা হলো পড়তে পারা এবং লিখতে পারা। দেখা যায় যে, শিক্ষার্থী যত ভালোভাবে অর্থাৎ শুদ্ধভাবে এবং দ্রুত রিডিং পড়তে পারে, সেই শিক্ষার্থী ভালো এবং সে নির্ভুলভাবে লিখতেও সক্ষম হয়। রিডিং পড়া একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা। তা সে বাংলা বা ইংরেজি যেকোনো বিষয়েই হতে পারে। তার মস্তিষ্ক যত দ্রুত একটি বর্ণ ধরতে পারে বা সেই সঙ্গে উচ্চারণ করতে পারে, তার ওপর নির্ভর করে তার দক্ষতা কতটুকু। শব্দ বলা থেকে শিশুর পড়ার প্রাথমিক ধাপ শুরু হলেও দুঃখজনকভাবে প্রাথমিক শ্রেণি থেকেই শিক্ষার্থীরা রিডিং পড়ায় দুর্বলতা বোধ করতে থাকে। তাদের একটি বড় অংশই বই দেখে শুদ্ধভাবে এবং দ্রুত পড়তে পারে না। তারা বাড়িতে রিডিং পড়ার চর্চাও করে না। ফলে ক্রমশই তারা দুর্বল হয়ে পড়ে। শব্দ সম্পর্কে তাদের ধারণা কমতে থাকে।

পাঠ দুই ধরনের হয়ে থাকে। একটি হলো সরব পাঠ এবং অন্যটি নীরব পাঠ। আমি মনে করি, সরব পাঠ নীরব পাঠের চেয়ে উত্তম এবং শিশু থেকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শিশু সরব পাঠে অভ্যস্ত হবে। সবাই শিশুকে সেই অভ্যাস গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। তাকে পড়তে পড়তেই শব্দ সম্পর্কে ধারণা অর্জন করতে হবে। আর নীরব পাঠ হলো পূর্ণবয়স্কদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আজকাল অনেক স্কুলের শিক্ষার্থীও নীরব পাঠে অভ্যস্ত।

প্রাথমিক শিক্ষা হলো শিক্ষার ভিত্তি। যেখান থেকে শিশু পঠন-পাঠনের মাধ্যমে শিখন প্রক্রিয়ার স্থায়ী উন্নয়ন ঘটায়। এই স্তরেই শিশুর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে পড়ার দক্ষতা অর্জন করার চেষ্টা করতে হবে। শব্দ যদি নির্ভুলভাবে পড়তে না পারে, সেক্ষেত্রে ওই শব্দ লেখার সময় তার বানান ভুল হওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা থেকে যায়। কারণ শুদ্ধ উচ্চারণের সঙ্গে রয়েছে শুদ্ধ বানান লেখার যোগসূত্র। নির্ভুল পড়তে না পারার জন্য তারা সবার সামনে জোরে বা উচ্চৈঃস্বরে পড়তে লজ্জা পায়।

জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে তৃতীয় শ্রেণিতে অধ্যয়নরত শিশুদের মাত্র ৩৪ শতাংশ পড়তে পারে। এই শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মাত্র ১৮ শতাংশের গুনতে পারার প্রাথমিক দক্ষতা রয়েছে। প্রতিবেদনে ইউনিসেফ বলেছে, বাংলাদেশে ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আবার ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্কুল বন্ধ থাকায় প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ শিশুর পড়তে ও শুনতে পারার প্রাথমিক দক্ষতার ঘাতটি উদ্বেগজনক মাত্রায় বেড়েছে। এই ঘাটতি আগেও ছিল, এখনো আছে এবং আরো কত দিন থাকবে, তা নির্ভর করবে কত দ্রুত এবং দক্ষতার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের এই ঘাটতি পূরণে শিক্ষক এবং অভিভাবক গুরুত্ব দিতে পারেন তার ওপর।

প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর এবং এই স্তরেই মূলত শিক্ষার্থীকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। এখান থেকে যদি শিশুর ভেতর পড়ার দক্ষতা না জন্মে, তাহলে তা হয়তো সারা জীবনই বহন করতে হয় যদি কোনো স্তরে না পৌঁছে পড়ার দক্ষতা অর্জিত হয়। যতটুকু জানি, সরকার শিশুদের রিডিং পড়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে এবং প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়েই শিশুদের রিডিং পড়ার ওপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। কিন্তু মাঝে করোনার প্রকোপে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এই দক্ষতা অর্জনে বাধা সৃষ্টি হয়। শিক্ষার্থীরা অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে। এখন এই চর্চায় তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে।

এজন্য প্রথম দায়িত্ব থাকে শিক্ষকের ওপর। শিক্ষক লক্ষ রাখবেন যে, তার শ্রেণির মোট কতজনের রিডিং পড়তে সমস্যা হয় এবং সেই সমস্যাগুলোর প্রকৃতি কেমন। কেউ হয়তো বর্ণ চিনে, তবে কার এবং ফলাসহ উচ্চারণে বাধাগ্রস্ত হয় বা সমস্যা হয় আবার কেউ দ্রুত বর্ণ ধরতে পারে না। সেক্ষেত্রে শ্রেণিতে পড়তে পারার দক্ষতা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের আলাদা করা যেতে পারে। তারপর তাদের প্রথমে বর্ণ এবং শব্দ তৈরি ও তার উচ্চারণের ধারণা দিতে হবে। বারবার উচ্চারণ অনুশীলন করতে হবে। একই ধরনের আরো শব্দ দিয়ে তাকে অন্য শব্দ উচ্চারণ করে পরীক্ষা করতে হবে। পাঠ্যবইয়ের অল্প অংশ তাদের পড়তে দিতে হবে। প্রতিদিন একটু একটু পাঠ্যাংশ রিডিং পড়ার দক্ষতা অর্জন করার পর তাদের বিভিন্ন শব্দ সম্পর্কে ধারণা জন্মাবে। এভাবে একটি করে শব্দ সম্পর্কে শুদ্ধ উচ্চারণ এবং লিখতে পারার দক্ষতা অর্জন হওয়ার পর অল্প দিনেই প্রচুর শব্দ সে উচ্চারণ করতে পারবে।

বাড়িতে অভিভাবকেরও দায়িত্ব কম নয়। তার সন্তানের দুর্বলতা সম্পর্কে জ্ঞাত হলে তাকে বাড়িতে সরবে রিডিং পড়তে উৎসাহ দিতে হবে। তার ভুল-ভ্রান্তিগুলো তাকে ধরিয়ে সঠিকভাবে শেখাতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে যে, প্রথমে তার এ ধরনের সমস্যা হতে পারে, কিন্তু একবার তা পারলে আর সমস্যা থাকবে না। এতে কোনো সংকোচ বা জড়তা নেই। স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গে বিভিন্ন কার চিহ্ন ব্যবহারে উচ্চারণে কি হবে, তা শেখাতে হবে। যদিও একেবারে শৈশব থেকেই তারা এই ধারাক্রম শিখতে থাকে। এর চেয়েও বড় কথা হলো, দুর্বল শিক্ষার্থীদের মধ্যে আস্থা ফেরাতে হবে। কারণ যে শিক্ষার্থী রিডিংয়ে দুর্বল, সেই শিক্ষার্থী স্বাভাবিকভাবেই পড়ার আগ্রহ দেখায় কম। কোনোভাবেই তাকে দিয়ে সশব্দে পড়ানো যায় না বা পড়তে রাজি হলেও অত্যন্ত দুর্বল স্বরে পড়ে। কারণ সে জানে যে, রিডিং পড়তে তার সমস্যা হয়। ফলে তাদের প্রথমে আগ্রহ ফিরিয়ে আনতে হবে এবং তাদের মনোভাবকে সুদৃঢ় করতে হবে। তারা যে এটা পারবে, এ বিষয়ে তাদের উৎসাহ দিতে হবে।

যে বয়স থেকে শিশুর পড়ার দক্ষতা শুরু হয়, সেই বয়স থেকেই প্রয়োজন সঠিক শব্দ উচ্চারণের প্রতি গুরুত্বারোপ করা। ভুল হলে তা সঙ্গে সঙ্গে ধরিয়ে দেওয়া, যাতে সে সংশোধন করতে পারে। অনেক সময় আমরা শিশুর উচ্চারণে ভুল শুনেও তা সংশোধন করার চেষ্টা করি না অথবা একবার সংশোধন করেই কাজ শেষ করি। আসলে শিশুকে সঠিক শব্দ ও তার উচ্চারণ শেখাতে গেলে ধৈর্যের সঙ্গে তাকে সময় দিতে হবে। একটি শিশু যদি চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণিতে উঠেও নিজ মাতৃভাষার বই স্বাচ্ছন্দ্যে পড়তে না পারে, তাহলে সেই শিশুটি শব্দের প্রতি দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে আরো অনেক সময় নিতে পারে। এতে তার ভবিষ্যৎ শিক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কারণ তাকে ক্রমাগত কঠিন স্তরে যেতে হয়।

মাতৃভাষার পাশাপাশি তাকে ইংরেজি বিষয়েও রিডিং পাঠে দক্ষ করে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে তাকে আলাদা সময় দিতে হবে। একটি পাঠ শ্রেণির কতজন শিক্ষার্থী মোটামুটিভাবে রিডিং পড়ার দক্ষতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে, তা নিশ্চিত করতে হবে এবং আরেকটি বিষয় যে লক্ষ রাখতে হবে, সেই শিশুটি আগের তুলনায় ভালো পড়তে পারছে কি না এবং তার পড়ার সময় যে জড়তা কাজ করত, তা কতটুকু কেটেছে। এভাবে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলে সেই দুর্বল শিক্ষার্থী একসময় ভালোভাবে রিডিং পড়তে সক্ষম হবে।