Loading..

প্রকাশনা

২৬ নভেম্বর, ২০২২ ১০:২০ অপরাহ্ণ

শিখন মূল্যায়ন কী ও কেন- মূল্যায়নের গুরুত্ব-

আমার পরিচিত একজন বাবা। তার কন্যা ঢাকার একটি মোটামুটি নামকরা স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। একটি ভালো স্কুলে ভর্তি করাতে পেরে অন্য অনেক বাবা-মায়ের মতো তিনিও অনেকটা তৃপ্তিতে থাকেন এই ভেবে যে, তার কন্যাটি ভালো বিদ্যাপীঠের ভালো শিক্ষকগণের কাছে পড়াশোনা শিখছে। কিন্তু সেই বাবার আনন্দ কিছুটা বিঘ্নিত হয় তার প্রথম শ্রেণি পড়ুয়া কন্যার পরীক্ষার প্রশ্নপত্র দেখে। তিনি সাম্প্রতিক ওই শিশুর স্কুলের মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। একটি সামাজিক মাধ্যমে শিশুটির স্কুলের একটি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও সংযুক্ত করে দিয়েছেন। প্রশ্নকাঠামো দেখে আমিও একমত তার ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণে। প্রথম শ্রেণির মতো একটি শ্রেণিতে চার পৃষ্ঠার ইংরেজি প্রশ্নপত্র দিয়ে শিশুকে মূল্যায়ন করা হয়েছে। প্রশ্ন দেখে আমি ক্ষুব্ধ হইনি; তবে শিশুটির জন্য ও তার মতো আরও অনেক শিশুর জন্য মন খারাপ হয়েছে। মূল্যায়ন যেখানে হওয়া প্রয়োজন শিশুর শিখনকে ত্বরান্বিত করার জন্য, সেখানে তা না হয়ে শিশুকে একটি মুখস্থের যন্ত্রে পরিণত করছে। আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে, বাংলাদেশের শিক্ষাক্রম অনুযায়ী চার মাসে প্রথম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীর পড়ার দক্ষতা ঠিক কতটুকু অর্জিত হবে বলে প্রত্যাশা করা হয়? সংযুক্ত প্রশ্নপত্রটির উত্তর দিতে হলে প্রথমেই শিক্ষার্থীকে প্রশ্নপত্রটি পড়ে বুঝতে হবে। এবার একই প্রশ্ন লেখার দক্ষতার ক্ষেত্রেও করা যায়। যে প্রশ্নের উত্তরগুলো লিখে দিতে হবে তা ঠিক কোন শ্রেণির শিশুর অর্জিত যোগ্যতা হওয়া প্রয়োজন? তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কি তাদের নিজস্ব শিক্ষাক্রম ও স্ব-নির্ধারিত যোগ্যতার ওপর ভিত্তি করে চলছে। জাতীয় পর্যায়ের শিক্ষাক্রম কি তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য নয়?

আজকাল আমরা সৃজনশীল মূল্যায়নের কথা শুনি। স্কুলে নাকি সৃজনশীল পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। আর এদিকে মায়েদের ঘুম হারাম হয়ে যাচ্ছে সে সৃজনশীল পদ্ধতিতে মূল্যায়নের প্রশ্নপত্র ও উত্তর শিক্ষার্থীদের মুখস্থ করাতে গিয়ে। এদিকে গাইডবুক প্রণেতা ও কোচিং ব্যবসায়ীদেরও পোয়াবারো। সৃজনশীল পদ্ধতিতে মূল্যায়ন নিয়ে তৈরিকৃত গাইড ও কোচিং ব্যবসারও রমরমা অবস্থা। প্রশ্ন হচ্ছে, সৃজনশীল মূল্যায়ন মানে কি মূল্যায়ন পদ্ধতি সৃজনশীল হবে? নাকি মূল্যায়নের উপকরণ সৃজনশীল হবে? নাকি মূল্যায়ন কৌশল ও পদ্ধতি এমন হবে যাতে শিশুর সৃজনশীল হওয়ার দ্বার উন্মোচন করে দেয়?

আমরা সবাই জানি, শিক্ষার বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। শিক্ষা মানুষের জ্ঞান, দক্ষতা আর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে। আর শিক্ষাব্যবস্থা এমন একটি পরিবেশ তৈরি করে দেবে যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রকাশ করতে পারে। এ জ্ঞান, দক্ষতা আর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে শিক্ষার্থীর অবস্থা ও অবস্থান নির্ণয় করার জন্যই মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশে মূল্যায়নকে যতোটা সঙ্কুচিতভাবে দেখা হয়, মূল্যায়ন আসলে ততোটা সঙ্কুচিত হওয়ার কথা নয়। মূল্যায়নের তিনটি উদ্দেশ্য থাকা প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন:

– শিখনের জন্য মূল্যায়ন (Assessment for Learning)
– শিখন হিসেবে মূল্যায়ন (Assessment as Learning) এবং
– শিখনের মূল্যায়ন (Assessment of Learning)।

প্রথম দুইটি উদ্দেশ্য মূলত গাঠনিক মূল্যায়ন যা শিক্ষার্থীর সবলতা চিহ্নিতপূর্বক দুর্বলতা নিরোধের জন্য পরিকল্পনা করা হয়। সাধারণত শিখন-শেখানো পদ্ধতির অংশ হিসেবে চলমান বা অব্যাহত মূল্যায়ন ও স্ব-মূল্যায়নের মাধ্যমে এটি পরিচালনা করা হয়ে থাকে। উন্নত বিশ্বে এ ধরনের মূল্যায়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। আর মূল্যায়নের শেষ উদ্দেশ্যটি সামষ্টিক মূল্যায়ন। এরও প্রয়োজন আছে শিক্ষার্থীর ধাপোত্তীর্ণের জন্য। আমাদের দেশে এ মূল্যায়নটিকে একমাত্র মূল্যায়ন হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। তবে আমাদের দেশে মূল্যায়নের সমস্যা আরেকটি জায়গায়। তা হলো প্রশ্নপত্রে।

সহযোগিতামূলক মনোভাবে শিখন দীর্ঘস্থায়ী হয়

গবেষণায় দেখা গিয়েছে, শিশুরা বিভিন্ন স্তরে শেখে। আর মূল্যায়ন যেহেতু শিশুর শেখাকে সহায়তা করার জন্য; তাই মূল্যায়নের প্রশ্নপত্রও বিভিন্ন স্তরের ওপর ভিত্তি করে হওয়া প্রয়োজন। বেঞ্জামিন ব্লুম এর ওপর একটি তত্ত্ব দিয়েছেন যা ব্লুমস ট্যাক্সোনমি নামে পরিচিত। তিনি বলেন, মূল্যায়ন হওয়া উচিৎ ছয়টি স্তরে:

– জ্ঞান যাচাইয়ের জন্য (Knowledge)
– বোধগম্যতা যাচাইয়ের জন্য (Understanding or comprehension)
– প্রয়োগ দক্ষতা যাইয়ের জন্য (Application)
– বিশ্লেষণ দক্ষতা যাচাইয়ের জন্য (Analysis)
– সংশ্লেষণ দক্ষতা যাচাইয়ের জন্য (Synthesis)
– মূল্যায়ন বা মতামত দক্ষতা যাচাইয়ের জন্য (Evaluation)।

এ ছয়টি দক্ষতা যাচাইয়ের জন্য কী কী প্রশ্ন করা যায় বা কী কী শব্দ ব্যবহার করা যায় তাও তিনি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আমাদের দেশে বর্তমানে যে সৃজনশীল মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু হয়েছে, তা মূলত এ তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই। তারপরও প্রশ্নপ্রণেতা ও মূল্যায়ন গ্রহণকারীদের জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতার কারণেই তা সফলতার মুখ দেখছে না।

আমাদের দেশের প্রাথমিক স্তরের বর্তমান শিক্ষাক্রম যোগ্যতানির্ভর। মূল্যায়ন পদ্ধতি শিক্ষাক্রমের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাহলে মূল্যায়ন পদ্ধতিকে কেন এখন পর্যন্ত মূল্যায়ন গ্রহণকারীগণ বিষয়বস্তু নির্ভর করে রেখেছেন? সৃজনশীল মূল্যায়ন পদ্ধতি তো বিষয়বস্তুর পরিবর্তে যোগ্যতানির্ভর মূল্যায়নের জন্য দিকনির্দেশনা দেয়। তাহলে আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর কি সেদিকে নজর দেয়ার প্রয়োজন নয়? আমাদের নীতি-নির্ধারকদের ভেবে দেখা প্রয়োজন মূল সমস্যাটি কোথায়—মূল্যায়নে সৃজনশীল পদ্ধতি বাস্তবায়নে আমাদের দক্ষতার অভাব, নাকি দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতায়? যথাযথ সমস্যা চিহ্নিতপূর্বক সমাধান। 

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি