Loading..

প্রেজেন্টেশন

০৩ ডিসেম্বর, ২০২২ ০৯:৫১ অপরাহ্ণ

জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে

আমরা জীবনে কী চাই? আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী হওয়া উচিত? এ সম্পর্কে একটা ধারণা থাকা প্রত্যেক মানুষের দরকার। এ প্রসঙ্গে একটা গানের কথা মনে পড়ল—‘যদি লক্ষ্য থাকে অটুট, বিশ্বাস হৃদয়ে, হবেই হবে দেখা, দেখা হবে বিজয়ে। ’ এর পরও মানুষ তার লক্ষ্য ও বিশ্বাস অনুযায়ী গন্তব্যে পৌঁছাতে না-ও পারে। এতে ভেঙে পড়ার কিংবা হতাশ হওয়ার কিছু নেই।


প্রয়োজন ও সময়ের পরিবর্তন বলে দেবে মানুষের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এখন কী হওয়া উচিত। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালামের স্বপ্ন ছিল মিলিটারি বেইসের একজন ফাইটার পাইলট হওয়া। তরুণ কালাম ইন্টারভিউ দিতে গেলেন দেরাদুন বিমানবাহিনীর অধীনে। এই ইন্টারভিউ দেওয়ার সময় কালাম লক্ষ করলেন বিমানবাহিনীতে শিক্ষা ও দক্ষতার পাশাপাশি শারীরিক সক্ষমতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এ জন্য তাদের কাছে হ্যাংলা-পাতলা প্রার্থীর চেয়ে স্বাস্থ্যবান প্রার্থীই ছিল বেশি পছন্দের। ফলাফলেও তার প্রতিফলন ঘটল। মাত্র ৯ জন প্রার্থীর মধ্যে আটজনই নির্বাচিত হলেন, শুধু বাদ পড়লেন আব্দুল কালাম। এতে তিনি খুব হতাশ হলেন। ভগ্ন মন নিয়ে তিনি হৃষিকেশ ফিরে যান। সেখানে গিয়ে সাক্ষাৎ পেলেন স্বামী শিবানন্দের। কালাম স্বামীজিকে সব খুলে বলার পর স্বামীজি তাঁকে বিশ্বাস না হারাতে পরামর্শ দেন। স্বামীজির কথা শুনে তিনি অনুপ্রাণিত হয়ে ওঠেন ও নতুন করে স্বপ্ন দেখতে থাকেন।

আশাবাদী মানুষ সব সময় সফল হয় এবং তারা তাদের লক্ষ্যকে সঠিকভাবে নির্ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। ম্যাকক্লিল্যান্ড তাঁর অ্যাচিভমেন্ট মোটিভেশন থিওরিতে বলেছেন, আমাদের লক্ষ্য ও চাহিদা সে পর্যন্তই থাকা উচিত যে পর্যন্ত আমরা পৌঁছাতে পারব। কাল্পনিক বা অসম্ভব কোনো লক্ষ্য ও চাহিদা আমাদের থাকা উচিত নয়। এই মূল্যবান কথাটির সামাজিক, মনস্তাত্ত্ব্বিক ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। আমাদের সমাজে আজকাল আমরা দেখতে পাচ্ছি মানুষের চাহিদা তার সক্ষমতার চেয়ে বেশি। আবার মানুষ ভাবছে টাকার মাধ্যমে ক্ষমতাকে কিনে ফেলবে। ফলে মানুষের মধ্য থেকে মানবিক আচরণগুলো নির্বাসিত হয়ে স্বার্থকেন্দ্রিক চিন্তাধারা সৃষ্টি হচ্ছে। এই স্বার্থকেন্দ্রিক মনোভাব তার মধ্যে লোভ ও ভোগবাদিতার জন্ম দিচ্ছে। এর প্রভাবে তার আয়ের বাইরে মানুষ অধিক অর্থ উপার্জনের জন্য দুর্নীতির মতো অবৈধ বিষয়কে তার অধিকার বলে মনে করছে। এর সঙ্গে তৈরি হয়েছে সুবিধাবাদিতা। ফলে জীবনাচরণের মূল উপাদানগুলো মানুষের জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এ জন্য মানুষকে তার জীবন, তার লক্ষ্য, তার প্রয়োজন, তার সক্ষমতা ও চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য নিয়ে আসতে হবে। কারণ প্রত্যেক মানুষের জীবনপ্রণালী যেমন ভিন্ন ভিন্ন, তেমনি প্রত্যেক মানুষের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, চাহিদা ও সক্ষমতাও ভিন্ন ভিন্ন। যখন মানুষ এ বিষয়গুলোকে একইভাবে দেখার বা বোঝার চেষ্টা করবে, তখনই মানুষ তার নিজের ব্যক্তিসত্তা হারিয়ে ফেলবে।

একবার দার্শনিক ডায়োজিনিস আলেকজান্ডারকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাপু, তোমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?’ আলেকজান্ডার বললেন, ‘সমস্ত গ্রিস নিজের দখলে আনা। ’ তারপর? সমস্ত এশিয়া মাইনর নিজের আয়ত্তে আনা। তারপর? সমস্ত পৃথিবী নিজের আয়ত্তে আনা। নাছোড়বান্দা ডায়োজিনিস লেগে থাকেন, ‘তারপর?’ তারপর আর কী! বাড়িতে বসে বসে বিশ্রাম নেব! ডায়োজিনিস তখন মিটিমিটি হাসেন, বললেন, ‘হে হে, সে কাজটি এখন করলেই তো পারো!’ বিষয়টি আলেকজান্ডার তখন না বুঝলেও বুঝেছিল, তবে অন্তিম সজ্জায়। মাত্র ৩৩ বছরের আলেকজান্ডার মৃত্যুর পূর্বক্ষণে তাঁর সেনাপতিদের ডাকলেন, সবচেয়ে বিশ্বস্ত, কাছের মানুষ, পৃথিবীর এ মাথা থেকে ও মাথা তাঁর পাশে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে যারা। তিনি সবাইকে সমবেত করে বললেন, ‘আমি ওপারের ডাক শুনতে পাচ্ছি, বুঝতে পারছি খুব তাড়াতাড়ি পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নেব। আমার অন্তিম তিনটি ইচ্ছা আছে, সেগুলো যেন অক্ষরে অক্ষরে পালিত হয়। ’ সেনাপতিরা অশ্রুসজল চোখে আলেকজান্ডারের কথায় সম্মতি জানালেন। আলেকজান্ডার বলা শুরু করলেন, ‘আমার প্রথম ইচ্ছা—আমার শবদেহ সমাধিক্ষেত্রে বহন করে নিয়ে যাবে কেবল আমার চিকিৎসকরা। ’ একটু থেমে তিনি টেনে টেনে শ্বাস নিয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে আবার বললেন, ‘আমার দ্বিতীয় ইচ্ছা—সমাধি পানে আমার শবদেহ বয়ে নিয়ে যাবে যে পথে—সেই পথে আমার অর্জিত সব সোনা-রুপা, মণি-মুক্তা, ধনরত্ন ছড়িয়ে দেওয়া হবে। ’ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার তিনি বললেন, ‘আমার তৃতীয় এবং শেষ ইচ্ছা হলো, শবদেহ বহনের সময় আমার হাত দুটি কফিনের ভেতর থেকে বাইরে বের করে রাখবে। ’

আলেকজান্ডারের প্রিয় সেনাপতি তাঁর হাতে গভীর শ্রদ্ধামাখা চুম্বন করে বললেন, ‘আমরা অবশ্যই আপনার এসব ইচ্ছা পূরণ করব। ’ কিন্তু মহান সম্রাট! আমাদের বড় কৌতূহল জাগছে; আপনি অনুগ্রহ করে বলবেন, কেন এমন আদেশ?’ আলেকজান্ডারের চোখের কোণে অশ্রু চিকচিক করে উঠল, কিন্তু ঠোঁটের কোণে খেলছে রহস্যময় হাসি। তিনি বললেন, ‘আমি আমার জীবনের বিনিময়ে তিনটি বিষয় শিখেছি, তা পৃথিবীর কাছে পৌঁছে দিতে চাই। প্রথমত, আমার শবদেহ চিকিৎসকরা বহন করবে, যেন সবাই উপলব্ধি করতে পারে—মানুষের জীবনপ্রদীপ ফুরিয়ে এলে পৃথিবীর কোনো চিকিৎসকের পক্ষে সম্ভব নয় তাকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনা। দ্বিতীয় ইচ্ছার ব্যাখায় আলেকজান্ডার বলেন, ‘সমাধিপানের পথে ধনরত্ন ছড়িয়ে দেবে, যেন সবাই জেনে যায়—আমি সারাটি জীবন ব্যয় করেছি সম্পদ অর্জনের পেছনে, কিন্তু তার কিছুই সঙ্গে করে নিতে পারছি না! তৃতীয়ত, কফিনের বাইরে হাত বের করে রাখবে। কারণ আমি বিশ্বকে জানাতে চাই—আমি পৃথিবীতে শূন্য হাতে এসেছিলাম; আবার যাওয়ার সময় শূন্য হাতেই ফিরে যাচ্ছি। পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে সময় এবং জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে মানুষের জন্য কিছু করা। এ বিষয়টি আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট জীবনের অন্তিম লগ্নে উপলব্ধি করেছিলেন; কিন্তু তখন করার কিছুই ছিল না।

আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে জীবনের একটি পথ রুদ্ধ হয়ে গেলেও মানুষকে কখনো তার বিশ্বাস ও স্বপ্নকে হারালে চলবে না। পৃথিবীতে মানুষের যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। মানুষ অনেক বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারে, তবে সেটি নৈতিকতার নিরিখেই হতে হবে। তা যেন তার ব্যক্তিত্ব, মানবিক মূল্যবোধ ও স্বাধীনসত্তার ওপর প্রভাব ফেলতে না পারে। বেশি লোভ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা যেন মানুষের মরণফাঁদে পরিণত না হয়, সে বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। তবেই মানবজীবন সার্থক হবে।