Loading..

খবর-দার

২৪ ফেব্রুয়ারি , ২০২৩ ০৮:০৯ অপরাহ্ণ

ভাষা আন্দোলন : যেভাবে তৈরি হয়েছিল অমর একুশের শহীদ মিনার

১৭৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার জন্য যে স্থানে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন রফিক উদ্দিন, সেখানেই ২৩ ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে গড়ে ওঠে বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মিনার।

ভাষা সংগ্রামী ও জাতীয় অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘২১ তারিখের পর ২২ ও ২৩ তারিখেও শহরময় গোলমাল চলছিল। এর মধ্যে মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা পরিকল্পনা করেছিলেন যে একুশের প্রথম শহীদ রফিক উদ্দিন যেখানে শাহাদত বরণ করেছেন, সেখানে তারা একটি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করবেন।’

পরিকল্পনা ও নকশা এবং নির্মাণকাজের শুরু
শহীদ মিনার স্থাপনের পরিকল্পনা ও নকশা নিয়ে সাঈদ হায়দার ২০১৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি একটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত নিবন্ধে লিখেছিলেন, ‘২৩ ফেব্রুয়ারি দিনটি ছিল অপেক্ষাকৃত শান্ত; শ্রান্তি নিরসনের।’

তিনি লিখেছেন, ‘তবে এখানে-ওখানে ছোটখাটো জটলা-আন্দোলন এগিয়ে নিতে আর কী করা যায়, তারই আলোচনা। সামনে এলো একটা প্রস্তাব, শহীদদের লাশ যখন আমাদের দাফন করতে দিল না, তাহলে তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমাদের হোস্টেল অঙ্গনেই একটা স্মৃতিস্তম্ভ বানাই না কেন?’

স্মৃতিচারণ করে তিনি আরো লিখেছেন, ‘ঠিক হলো যে শোরগোল করে নয়, যথাসম্ভব নীরবে-নিভৃতে ২৩ ফেব্রুয়ারির এক রাতেই নির্মাণকাজটি সমাধা করতে হবে। নকশা আঁকার ভার দেয়া হয়েছিল বদরুল আলমের ওপর। এ কাজে তার দক্ষতা ও সক্ষমতা দুই-ই ছিল। তিনি যে নকশা নিয়ে আসেন, শৈল্পিক ব্যঞ্জনায় তা বেশ সুন্দর। কিন্তু দুটি বাঁক থাকায় ঢালাইয়ের প্রয়োজন হবে বলে এক রাতে তা শেষ করা যাবে না। এই পরিস্থিতিতেই আমি জড়িয়ে পড়ি কাজটার সাথে। আমি একটা মোটামুটি নকশা (এঁকে) দেখালাম বরুকে (বদরুল আলমের ডাকনাম)। এই সহজ-সরল প্ল্যানটা শুধু ইট-সিমেন্টেই শেষ হবে বলে সহজসাধ্য, বরুরও পছন্দ হলো। আমরা উভয়ে চূড়ান্ত আঁকার কাজ শেষ করে নিয়ে এলে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা, ছাত্রকর্মী সবারই পছন্দ হয়।’

প্রথম শহীদ মিনারটি ছিল ১০ ফুট উঁচু আর ছয় ফুট চওড়া।

সাঈদ হায়দার লিখেছেন, ‘ছাত্র ইউনিয়নের জেনারেল সেক্রেটারি জি এস শরফুদ্দিনের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপ্লোমা ছিল, তার সার্বিক তত্ত্বাবধানেই নির্মাণকাজ আরম্ভ হয়। দিনেই নির্মাণের স্থানটা নির্বাচিত হয়েছিল ১২ নম্বর শেডের ছাত্র হোস্টেলের (ব্যারাকের) পাশে, ছাত্রাবাসের নিজস্ব রাস্তার পাশে, যেখানে গুলিতে নিহত হন প্রথম ভাষা শহীদ। মাত্র একজন পারদর্শী রাজমিস্ত্রির কুশলী হাতে নকশা মোতাবেক কাজ শুরু হলো, মিস্ত্রির একজন হেলপার ছিল বটে। কিন্তু আমাদের ছাত্রকর্মীরাই তো সেদিন সবচেয়ে সক্রিয় জোগালে (সহকারী)। মাত্র কয়েক মিনিটেই আল হাসিম ও মনজুরের সবল হাতে কোদালের কোপে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পাঁচ ফুট গভীর মাটি কাটা শেষ হলো।’

অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘পিয়ারু সরদার সেখানে কন্ট্রাক্টর ছিলেন, তার একটা গুদাম ছিল। সেখান থেকেই মালামাল নিয়ে ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে রাতারাতি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়।’

সাঈদ হায়দার বিস্তারিত লিখেছেন, ‘কলেজ ভবন সম্প্রসারণের জন্য সেখানে স্তূপাকারে রক্ষিত ইট ছাত্ররাই লাইনে দাঁড়িয়ে হাতে হাতে নিয়ে এলো, বালু আর বস্তাভরা সিমেন্ট এলো ছাত্রকর্মী আসগরের তৎপরতায় কন্ট্রাক্টর পিয়ারু সরদারের স্বতঃস্ফূর্ত বদান্যতায়। হোস্টেল প্রাঙ্গণের বিভিন্ন স্থানের ট্যাপ থেকে বালতিতে করে পানি এনেছে ছাত্ররাই। তারাই ইট ভিজিয়েছে, বালু-সিমেন্টের মর্টার বানিয়েছে, নির্মাণ সামগ্রী মিস্ত্রির হাতের নাগালে পৌঁছে দিয়েছে। ব্যারাকবাসী সব শিক্ষার্থী নির্মাণকাজে হাত লাগিয়েছে।’

ভাষা সংগ্রামী ও জাতীয় অধ্যাপক অধ্যাপক ড. ইসলাম বলেছেন, পর দিন ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে প্রথমে শহীদ শফিউরের বাবা শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন।

ড. ইসলাম বলেছেন, ‘২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক ও আইনসভার সদস্য আবুল কালাম শামসুদ্দিন আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন। আর সেদিন থেকেই সেটা বাঙালির কাছে মর্যাদাপূর্ণ স্থানে পরিণত হয়।’

সেখানে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়কালে নির্মিত ছাত্র হোস্টেলের ব্যারাকের দেয়ালে ‘বীরের এ রক্ত স্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা, এর যত মূল্য, সেকি ধরার ধূলায় হবে হারা’ লেখা ছিল।

অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘কিন্তু ২৭ তারিখে পাকিস্তান আর্মি বুলডোজার নিয়ে এসে পুরো শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি গুড়িয়ে দেয়। এরপর সব সিমেন্ট বালি ট্রাকে উঠিয়ে নিয়ে চলে যায়। তখন যে জায়গায় শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি তৈরি করা হয়েছিল, ওই জায়গাটি ছাত্ররা কালো কাপড় দিয়ে ঘিরে রাখে। তখন ওইটি হয়ে যায় প্রতীকী শহীদ মিনার। পরের কয়েক বছর শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ বলতে ছিল সেই কালো কাপড়ে ঘেরা জায়গাটি।’

১৯৫৪ সালে নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ও ছুটি ঘোষণা করা হয়। ওই সময় সরকারিভাবে শহীদ মিনার নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। ১৯৫৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ সরকারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার, মাওলানা ভাসানী এবং শহীদ বরকতের মা হাসিনা বেগম দ্বিতীয়বার শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।

কোনো কোনো ইতিহাসবিদ লিখেছেন, ওই দিন ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন ২২ ফেব্রুয়ারি শহীদ রিকশাচালক আবদুল আওয়ালের ছয় বছরের মেয়ে বসিরণ।

এখনকার শহীদ মিনার
এরপর বেশ কয়েক দফায় শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ হয়। শিল্পী হামিদুর রহমানের নকশা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৫৭ সালের নভেম্বর থেকে শহীদ মিনারের কাজ শুরু হয়। তাকে সহযোগিতা করেন নভেরা আহমেদ। ওই নকশার মূল বিষয়টি ছিল যে মাঝখানে মা, তার চারদিকে চারটি সন্তান, যে সন্তানরা মায়ের ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন। মায়ের মাথাটি একটু নোয়ানো, যেন সন্তানদের দোয়া করছেন।

কিন্তু ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়।

এরপর ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির নেতৃত্ব গঠিত কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী আবার শহীদ মিনারের কাজ শুরু হয়। ওই সময় কিছুটা সংক্ষিপ্ত করে শহীদ মিনারের কাজ সম্পন্ন করা হয়।

১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ওই শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন শহীদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম। তখন থেকেই এই শহীদ মিনার একুশের প্রতীক হয়ে ওঠে। ওই শহীদ মিনার ১৯৭০ সাল পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল। শহীদ মিনারের পাশেই নভেরা আহমেদের তৈরি করা ম্যুরাল ছিল, যেখানে ভাষা আন্দোলন ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল।

অধ্যাপক ইসলাম বলেছেন, ‘হামিদুর রহমান ও নভেরা আহমেদ সারাক্ষণ শহীদ মিনার নিয়ে কাজ করতেন। তারা কুঁড়েঘরের মতো বানিয়ে সেখানে থাকতেন এবং দিবারাত্রি শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ তদারক করতেন। আমরা অনেকবার সেখানে গিয়ে তাদের সাথে আড্ডা দিতাম।’

এরপর ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণ করে, তখন তারা এই শহীদ মিনারটিও ধ্বংস করে দেয়। ম্যুরালগুলোও তখন ধ্বংস করে ফেলা হয়। সেখানে তারা তখন ‘মসজিদ’ লিখে দেয়।

অধ্যাপক ইসলাম বলছেন, ‘১৯৭২ সালে আমরা ওই ভাঙ্গা শহীদ মিনারের ওপরেই শহীদ দিবস পালন করি।’

১৯৭৩ সালে আবার শহীদ মিনার পুননির্মাণ করা হয়। কিন্তু সেখানে পুরনো নকশার অনেক কিছুই আর যোগ করা হয়নি। শেষ পর্যন্ত ১৯৮৩ সালে শহীদ মিনারের চত্বর বিস্তৃত করে বর্তমান অবস্থায় আনা হয়।

ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলছেন, ‘শহীদ মিনার বেশ কয়েকবার তৈরি করা হয়েছে, ভাঙ্গা হয়েছে আবার পুননির্মাণ করা হয়েছে। আজকে যে শহীদ মিনার আমরা দেখছি, সেখানে মূল নকশার যে মূল স্থাপনা ছিল, তা রয়েছে। কিন্তু এখানে পূর্ণ নকশার প্রতিফলন ঘটেনি। মূল নকশায় আরো অনেক কিছু ছিল, যেগুলো পরে আর করা হয়নি। কিন্তু এই আদলটাকেই আমরা শহীদ মিনারের রূপ হিসেবে গ্রহণ করেছি।’

তিনি বলেছেন, কয়েক বছর আগে একবার সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে পুরনো নকশার ভিত্তিতে শহীদ মিনারের রূপ দেয়া যায় কিনা। এমন আলোচনাও হয়েছে, কিন্তু এটি নিয়ে পরে আর কাজ হয়নি।

তিনি জানান, শহীদ মিনারের সাথে হল ঘর, ম্যুরাল, পাঠের কক্ষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেগুলো আর হয়নি পরে।