Loading..

খবর-দার

২৯ মার্চ, ২০২৩ ০২:২৫ অপরাহ্ণ

শিল্পী কামরুল হাসান
ভূমিকাঃ শাশ্বত বাঙালি সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠায় যিনি ছিলেন প্রানান্তর,যার চিত্রকলায় বার বার ঘুরে ফিরে এসেছে বাংলার শৈল্পিক ঐতিহ্যের প্রতিফলন,
তিনি হলেন বাংলাদেশের অন্যতম শিল্পী কামরুল হাসান। তিনি একাধারে ছিলেন- চিত্রশিল্পী,লেখক,সংগঠক ও বক্তা হিসেবে সুবিদিত এবং শাশ্বত বাঙালির ঐতিহ্যের ধারক 
ও বাহক। সবাই তাকে শিল্পী বললেও তিনি নিজে 'পটুয়া' নামে পরিচিত হতে বেশি পছন্দ করতেন। বাংলাদেশের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ শিল্পীগণের ভিতর অন্যতম একজন 
হলেন কামরুল হাসান।

জন্ম ও পরিচয়ঃ শিল্পী কামরুল হাসান ১৯২১ সালের ২রা ডিসেম্বর, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার নারেঙা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার আসল নাম হল- আবু শারাফ মোহাম্মদ কামরুল হাসান। তার বাবার নাম মোহাম্মদ হাশিম এবং মায়ের নাম মোসাম্মত আলিয়া খাতুন। তার বাবা ছিলেন একটি স্থানীয় কবরস্থানের তত্ত্বাবধায়ক।

শিক্ষাজীবনঃ শিল্পী কামরুল হাসান, কলকাতা মডেল এম.ই. স্কুলে পড়াশোনা করতেন। এরপর তিনি কলকাতা মাদ্রাসা এবং পরবর্তীকালে কলকাতা ইন্সটিটিউট অফ আর্টস-এ অধ্যায়ন করেন। ১৯৪৭ সালে তিনি ফাইন আর্টস পাশ করেন।

কর্মজীবনঃ দেশ বিভাগের পর কামরুল হাসান ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকায় জয়নুল আবেদিনের সাথে একত্রে তিনি গভর্মেন্ট ইন্সটিটিউট অফ ফাইন আর্টস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি ১৯৪৮ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ঢাকা চারুকলা ইন্সটিটিউটে শিক্ষকতা করেন। এরপর ১৯৬০ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্ষুদ্র কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) নকশা কেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন৷ তা কর্মজীবনের একটি পর্যায়ে ১৯৭২ সালে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে শিব নারায়ণ দাশ কর্তৃক ডিজাইনকৃত জাতীয় পতাকার বর্তমান রূপ দান করেন তিনি।

শিল্পকর্মের বিষয়বস্তুঃ শিল্পী কামরুল হাসান তার শিল্পকর্মের বিষয়বস্তু হিসেবে মানুষ, স্বদেশীকতা,দেশজ ঐতিহ্য প্রভৃতিকে স্বার্থকভাবে প্রয়োগ করেছেন। এছাড়াও তিনি গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের জীবন-যাত্রা ও বাঙালি রমণীর চিরন্তনী রূপ নিয়ে কাজ করেছেন। সামাজিক,স্বাধীনতা কিংবা গণতন্ত্র মুক্তির সংগ্রামে,তার প্রতিবাদী চিত্র বাঙালি জাতিকে অনুপ্রেরণা যোগায়।

শিল্পকর্মের বৈশিষ্ট্যঃ শিল্পী কামরুল হাসানের শিল্পকর্মের কিছু বৈশিষ্ট্য নিম্নরুপ-

১. প্রত্যক্ষতা ও অনিবার্যতা ছিল তার ড্রইং এর প্রথম শর্ত।
২. তিনি চিত্রকর্মে লোক বৈশিষ্ট্য এবং লোকচিত্রের নানা উপকরণ ব্যবহার করেছেন।
৩. তিনি বহুমাতৃকতা দ্বারা চিত্র নির্মাণ করতেন।
৪. তার প্রায় চিত্রকর্মে কম্পোজিশন ছিল বৃত্তাকার।
৫. তার চিত্রকর্মে পরিপ্রেক্ষিতের উপস্থিতি লক্ষ্যনীয়।
৬. তিনি সহজ-সরল নকশা ব্যবহার করতেন।
৭. তিনি সংক্ষিপ্ত লাইন ব্যবহার করে,বিষয়বস্তুকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতেন।
৮. সরল রেখা ও ফ্লাট বর্ণবিন্যাস ব্যবহার করতেন।
৯. তিনি চিত্রাঙ্কনে পটচিত্রের মত উজ্জ্বল রঙ ব্যবহার করতেন।
১০. উজ্জ্বল রঙ ও বলিষ্ঠ রেখার উপস্থিতি দ্বারা তিনি ছবিকে অলংকরণ ও শিল্পরসধর্মী করে তুলতেন।
১১. তার চিত্রকর্মে স্কেচ-এর গতি চঞ্চল এবং দর্শনে জীবিত মনে হয়।
১২. বিষয় এবং আকারের নির্দিষ্ট গতি,সমতল ভূমির ওপর তিনি অত্যন্ত সতর্কতার সাথেই অলংকৃত করেছেন।

যেসব মাধ্যমে কাজ করেছেনঃ শিল্পী কামরুল হাসান বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করেছেন। যেমন- জলরং,তেলরং,ওয়াশ,টেম্পারা,ছাপচিত্র,এচিং,কাঠখোদাই,লিনোকাট,সেরিগ্রাফ,লিথোগ্রাফ,ভাস্কর্য নির্মাণ প্রভৃতি।

তেলচিত্রঃ
(ক) তিনকন্যাঃ শিল্পী কামরুল হাসানের একটি প্রিয় থিম হলো তিন কন্যা। চিত্রটিতে দেখা যাচ্ছে, তিন পল্লীবধূ কলসি কাঁধে পানি আনতে যাচ্ছে। তিনজনের পরিধানে উজ্জ্বল তিন প্রাথমিক বর্ণ যেমন- লাল,নীল ও হলুদ রঙের শাড়ি। ছবিটিতে ত্রিমাতৃকতা দৃষ্টান্ত। চিত্রটিতে মূলত গ্রামীণ জীবনের একটি সাধারণ দৃশ্য চিত্রিত করা হয়েছে।

(খ) নাইয়রঃ তেল রঙে আকা এই ছবিটি শিল্পী কামরুল হাসানের উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্মের মধ্যে একটি। চিত্রপটে দেখা যায়, গরুর গাড়িতে করে স্বামী,স্ত্রী ও তাদের শিশুপুত্র যাচ্ছে। এখানে বাংলার সুখী দম্পতিদের চিরন্তর রূপের প্রতিক উপস্থাপন হয়েছে। মাতিস কিংবা পিকাসোর শিল্প টঙের প্রবেশ ঘটেছে এই চিত্রে। চিত্রে মধ্যে ব্যবহৃত গরুর মুখের ফর্ম শিল্পী পরবর্তীকালে অনেকবার ব্যবহার করেছেন।তার ব্যবহৃত বিষয়বস্তু লোকজ রীতির অন্তর্গত। গরুর গাড়ি, গরুর মুখ, নারী ও পুরুষ, শিশুর মুখবয়ব সবকিছু আকর্ষণীয়ভাবে বিভিন্ন রেখায় ও ফর্মে ভেঙে উপস্থাপন করা হয়েছে।

(গ) বাউলঃ চিত্রতে বাউলের দিকে তাকালেই কামরুলের পরিচিত স্টাইল দেখা যায়। বাউলের মুখে ব্যবহৃত ফর্ম ১৯৬০ সালে আঁকা সুখী প্রত্যাবর্তনের কথা মনে করিয়ে দেয়। ছবিটিতে ফর্ম ভাঙা হয়েছে। এখানে উজ্জ্বল হলুদ ও লাল মিশ্র নীল ও সবুজের প্রাধান্য দেখা গেছে। এছাড়াও কালো রেখার ব্যবহারও দেখা যায় এ চিত্রটিতে।

https://en.wikipedia.org/wiki/Quamrul_Hassan

জলরংঃ
(ক) নবান্নঃ বাংলায় অগ্রহায়ণ মাসে ধান কাটার মাধ্যমে নবান্নের সূচনা হয়ে যায়। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সেই আনন্দকর্মযোগ্যে শামিল হয়েছিলো। উজ্জ্বল হলুদ জলরঙে আঁকা নবান্ন ছবিতে তেমনি দুজন নারী মাঠে কর্মরত। পটচিত্রের মতো ফ্ল্যাট রঙ ও সাবলীল তীব্র রেখা ব্যবহার এখানে বিশেষ লক্ষ্যনীয়। শিল্পী কামরুল হাসান, সুখী সমৃদ্ধ বাংলার অপরুপ চিত্র এ নবান্ন শীর্ষক চিত্রকর্মটিতে ফুটিয়ে তুলেছেন বিশেষভাবে।

(খ) নারী ও বৃক্ষঃ চিত্রটিতে শিল্পী একজন রমণীর মুখকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যেন চোখের আকৃতি প্রাচ্যের লম্বা ও ক্ষীণ চোখের মত এবং নাক যথেষ্ট লম্বা আকৃতির। বিশেষ ভঙ্গিমায় অংকিত বাঙালী নারীকে রূপময়ী করে উপস্থাপন করা হয়েছে। চিত্রটিতে আরো দেখা যাচ্ছে,নারীটি ভাবনারত অবস্থায় মাথার ঘোমটা বাম হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছে এবং তার পাশে পাতা ও গাছের ফর্ম।

(গ) রমণী যুগলঃ এটি শিল্পী কামরুল হাসানের একটি কাব্যিক চিত্রকর্ম। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে, চাঁদনি রাতে বাগানে দুইজন রমণী দণ্ডায়মান অবস্থায় রয়েছে। তাদের পেছনে গাছের আড়াল থেকে বেড়িয়ে আসছে চাঁদের আলো এবং একটি উড়ন্ত পাখি। রমণীদের মুখাবয়বে গভীর অনুরাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। চিত্রটির রেখা কিছুটা ‘কিউবিক’ ধাঁচের।

https://en.wikipedia.org/wiki/Quamrul_Hassan

রেখাচিত্রঃ
(ক) গরুঃ এ চিত্রটিতে একটি গরুর আনন্দ ভাবকে প্রকাশ করা হয়েছে। গরুটিকে নৃত্যরত অবস্থায় দেখানো হয়েছে। গরুটি দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে নৃত্য করছে। চিত্রটি কালো কালি দিয়ে আঁকা। এখানে,চিকন ও মোটা রেখার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।

(খ) জানোয়ারঃ এটি একটি পোষ্টার অংকন। চিত্রটি মুজিবনগরের তথ্য ও প্রচার দফতর থেকে প্রকাশ পায়। চিত্রে ইয়াহিয়া খানকে বিকৃতভাবে প্রকাশ করা হয়। চিত্রটির উপরে লেখা রয়েছে- “Arrihitate” এবং নিচে লেখা রয়েছে- “These demons”.

(গ) রাধুনিঃ চিত্রটিতে একজন নারীকে রান্না করতে দেখা যাচ্ছে। নারী ফিগারটির সামনে একটি পাতিল রয়েছে। চিত্রটি প্যাস্টেল রঙ দ্বারা আঁকানো। চিত্রে ব্যবহৃত রেখাগুলো তীক্ষ্ণ। এছাড়াও চিকন ও মোটা রেখার মাধ্যমে চিত্রটি সম্পন্ন করা হয়েছে।

মৃত্যুঃ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে কামরুল হাসান ১৯৮৮ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি ইন্তেকাল করেন।

উপসংহারঃ বিখ্যাত এই শিল্পী কামরুল হাসান ছিলেন হাজারো গুণে গুণান্বিত মানুষ। তার চিত্রকর্ম একদিকে যেমন ছিল বাস্তববাদী, তেমনি ছিল বিদ্রোহী মুখর। তার চিত্রের বৈশিষ্ট্য অনেকের থেকে আলাদা ছিল বিধায় আজও তার চিত্রকর্ম সকল জায়গায় উচ্চ সম্মান প্রাপ্ত হয়ে থাকে। পরিশেষে বলা যায় যে, তার চিত্রকর্ম চিত্রকলায় এক অনবদ্য সৃষ্টির ভূমিকা পালন করে।