সহকারী অধ্যাপক
০২ আগস্ট, ২০২৩ ১২:২০ পূর্বাহ্ণ
আষাঢ়ী পূর্ণিমায় ত্রৈমাসিক বর্ষাবাসের শিক্ষা
আষাঢ়ী পূর্ণিমায় ত্রৈমাসিক বর্ষাবাসের শিক্ষা
আজ শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা। বৌদ্ধদের অন্যতম পবিত্র একটি দিন ও তিথি। এ
শুভ তিথিতে সবাইকে জানাই মৈত্রীময় শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। আজ থেকে বিশ্বের বৌদ্ধদের
ত্রৈমাসিক বর্ষাব্রত শুরু হলো। এ তিন মাস বৌদ্ধ ভিক্ষু ও গৃহীরা তাদের আত্মসংযম,
বিদ্যা ও ধ্যানচর্চা এবং উপোসথব্রতের মাধ্যমে আত্মদর্শন ও আত্মোপলব্ধির শিক্ষা
গ্রহণ করেন। তাই এ পূর্ণিমা তিথিটি বৌদ্ধজীবনে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও গুরুত্ববহ।
এ পূর্ণিমার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিকগুলো হলো-এ তিথিতে গৌতম বুদ্ধ সিদ্ধার্থরূপে
মাতৃগর্ভে প্রতিসন্ধি গ্রহণ করেন। জরা, ব্যাধি, মৃত্যু ও বিমুক্তলাভী সন্ন্যাসী-এ
চার দৃশ্য দেখে কুমার সিদ্ধার্থ এ পূর্ণিমা তিথিতেই গৃহত্যাগ করেন।
আবার বুদ্ধত্ব লাভের পর এ পূর্ণিমা তিথিতে সারনাথের ঋষিপতন মৃগদাবে
তিনি পঞ্চবর্গীয় শিষ্যের (কৌণ্ডণ্য, বপ্প, ভদ্দিয়, মহানাম ও অশ্বজিৎ) নিকট তার
নবলব্ধ ধর্ম প্রচার করেন এবং ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র দেশনা করেন। এ পূর্ণিমা
তিথিতে তিনি তার প্রয়াত মাতৃদেবীকে দর্শন ও সদ্ধর্ম দেশনার জন্য তাবতিংস স্বর্গে
গমন করেন। এ পূর্ণিমাতেই বৌদ্ধ ভিক্ষুসংঘ ত্রৈমাসিক বর্ষাবাস অধিষ্ঠান গ্রহণ করেন।
তাই শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিটি বিশ্বের সব বৌদ্ধের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও
তাৎপর্যমণ্ডিত।
বৌদ্ধবিনয় মতে, আষাঢ়ী পূর্ণিমা, বর্ষাবাস ও উপোসথ এ তিনটি ধর্মীয়
বিধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। আর ধর্মীয় উৎসবগুলোর
মধ্যে বর্ষাবাস হলো অন্যতম। ভিক্ষুগণ বর্ষায় তিন মাসের জন্য ব্রত গ্রহণ করেন বলেই
এর নাম বর্ষাবাস। এটি বৌদ্ধ ভিক্ষু ও গৃহী জীবনে একটি অপরিহার্য বিনয়ব্রত কর্ম, যা
ব্যক্তির নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও আত্মসংযমের বিষয়টিকে অধিক গুরুত্ব দান করে।
মানবজীবনে আত্মশুদ্ধিতা ও সংযম অত্যন্ত অপরিহার্য কর্ম, যা পবিত্রকর্ম বলেও
ধর্মশাস্ত্রে উল্লেখ আছে। এ দুটি কর্ম ছাড়া জীবন কখনো মানবমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হতে
পারে না। এজন্য বৌদ্ধ ধর্মীয় বিধানে বিনয়কে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বৌদ্ধ মতে,
নীতি-নৈতিকতা ছাড়া জীবন কখনো মাধুর্যমণ্ডিত হয় না। যে জীবন সুনীতি ও শীলপরায়ণ এবং
সংযম ও আত্মসম্ভ্রমে গঠিত, সে জীবনই সুখী, নিরাপদ ও শান্তিতে পর্যবসিত হয়। এজন্যই
বুদ্ধ তার শিষ্য-প্রশিষ্য এবং গৃহীদের বারবার শীল পালনের কথা বলেছেন। এ শীলগৃহীদের
জন্য পঞ্চশীল বা পঞ্চনীতি, ধ্যানলাভী উপাসক-উপাসিকাদের জন্য অষ্টশীল বা অষ্টনীতি,
প্রব্রজিত শ্রামণদের জন্য দশশীল বা দশনীতি আর ভিক্ষুদের জন্য দু’শ সাতাশ নীতি
প্রবর্তিত হয়েছে। সমগ্র বিশ্বের বৌদ্ধগণ এ বর্ষাবাসে এ শীলগুলো পালনে অধিক যত্নবান
হন।
বৌদ্ধমতে ঋতু তিনটি-গ্রীষ্ম, বর্ষা, হেমন্ত। চৈত্র, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ও
আষাঢ় মাস হলো গ্রীষ্ম ঋতু; শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন ও কার্তিক মাস বর্ষা ঋতু এবং
অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ ও ফাল্গুন মাসকে বলা হয় হেমন্ত ঋতু। এ ঋতুগুলোর মধ্যে বর্ষায়
অধিক বৃষ্টিপাত হয়। এ সময় এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করা কষ্টকর হয়। এজন্যই বর্ষাবাসে
বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নিভৃত ধ্যান সাধনার জন্য বলা হয়েছে। আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী
পূর্ণিমা এ তিন মাস বৌদ্ধ ভিক্ষু ও গৃহীগণ ত্রৈমাসিক ব্রত-অধিষ্ঠান গ্রহণ করেন। এ
তিন মাস ভিক্ষু ও গৃহীরা উপোসথব্রত গ্রহণ করেন। আত্মশুদ্ধিতার জন্য সংযম শিক্ষা
করেন, শীল পালন করেন, চিত্ত সমাধি করেন এবং আত্মদর্শনের জন্য ধ্যানশিক্ষা করেন।
এটাকে বৌদ্ধ পরিভাষায় বলা হয় শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞা শিক্ষা।
এছাড়া বর্ষাবাসের মাধ্যমে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জ্যেষ্ঠতা নির্ণয় করা হয়।
জন্মগত বয়স দিয়ে ভিক্ষুদের বয়স নির্ধারণ করা হয় না। বিনয় মতে, যে ভিক্ষু বর্ষাবাস
যাপন করেন, তিনিই কঠিন চীবর লাভ করতে পারেন। বুদ্ধের সময় ভিক্ষুদের বর্ষাবাস
যাপনের জন্য গড়ে ওঠে নানা সংঘারাম, বিহার ও ধ্যানাগার। এগুলো পরবর্তী সময়ে
ভিক্ষু-শ্রামণদের বিদ্যা, ধ্যান ও ধর্ম-বিনয়চর্চা এবং শিক্ষাকেন্দ্র হিসাবেও
পরিগণিত হয়। আজকের শিক্ষাকেন্দ্রগুলোর উৎসস্থল হলো প্রাচীন বৌদ্ধ মঠ, বিহার,
মন্দির ও সংঘারামগুলোর শিক্ষা। প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থা ছিল ওইসব মঠ, বিহার ও
আশ্রমগুলোতেই। পরে গুরুগৃহে শাস্ত্র শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। এজন্যই প্রাচীন
বিদ্যাশিক্ষা ব্যবস্থায় গুরুগৃহ ও গুরু-শিষ্যের হৃদয়বন্ধন ছিল গভীর এবং গুরুর
প্রতি শিষ্যের শ্রদ্ধা-ভক্তিও ছিল অটল ও অনন্যসাধারণ।
বিশেষত বর্ষাবাসেই উপোসথব্রত গ্রহণ করা হয়। উপোসথ হলো ধর্মময় জীবন
গঠনের উত্তম প্রশিক্ষণ কর্ম, যেখানে মানবজীবনের সব কর্তব্য ও ব্রত সম্পাদন করা
যায়। জীবনকে উন্নত করতে গেলে ধ্যান ও সংযমের কোনো বিকল্প নেই। পালি ‘উপোসথ’ শব্দটি
‘উপবসথ’ শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো গুরুর নিকটে বসে ধর্মচর্চা করা। অষ্টমী,
অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে বৌদ্ধ উপাসকগণ দান, শীল, ভাবনা করে আধ্যাত্মিক জীবন
গঠন করেন। বৌদ্ধমতে উপোসথ চার প্রকার-প্রতিজাগর, গোপাল, নির্গ্রন্থ ও আর্য উপোসথ।
এ চারটির মধ্যে আর্য উপোসথব্রতই উত্তম। কারণ ধর্ম-বিনয়ে সংযত আর্য শ্রাবকদের
পালনীয় উত্তমব্রত বলেই এর নাম আর্য উপোসথ। আর্য উপোসথধারীগণ অষ্টশীলের মধ্যে কোনো
শীল ভঙ্গ করেন না। তারা প্রাণী হত্যা করেন না, কোনো চৌর্যবৃত্তি করেন না, মিথ্যা
ভাষণ দেন না, নেশা বা মাদকদ্রব্য সেবন করেন না, কোনো ধরনের কামাচার করেন না, রাতে
আহার গ্রহণ করেন না। তারা কোনো ধরনের সুগন্ধি দ্রব্য লেপন ও ব্যবহার করেন না, মালা
ধারণ করেন না; এমনকি কোনো উচ্চ আসনে শয়ন কিংবা উপবেশনও করেন না। এগুলোই হলো
বর্ষাবাসে উপোসথধারীদের অবশ্যই পালনীয় কর্ম।
বর্ষাব্রত বৌদ্ধ ধর্মীয় ও শিক্ষা জীবনে একটি পবিত্র অনুকরণীয়
অধিষ্ঠানকর্ম বলেও বিবেচিত হয়েছে। ভিক্ষুজীবনে নৈতিক, মানবিক ও গুণার্জনে অধিক
লাভবান হতে হলে বর্ষাবাস গ্রহণ করা অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে বৌদ্ধশাস্ত্রে উল্লেখ
আছে। বৌদ্ধ বিনয় মতে, কোনো মারাত্মক পরিস্থিতির উদ্ভব না হলে কোনো ভিক্ষু
বর্ষাবাসব্রত ভঙ্গ করতে পারেন না। সংঘ ও সামাজিক প্রয়োজন ছাড়া বর্ষাব্রত ভঙ্গ করা
সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বৌদ্ধ বিনয়শাস্ত্রে উল্লেখ আছে, কেবল সাতটি জরুরি প্রয়োজনেই
ভিক্ষুগণ বর্ষাবাসে নিজ বিহার থেকে বাইরে অবস্থান করতে পারবেন-ভিক্ষু-শ্রামণ
অসুস্থ হলে, শাসনের ক্ষতি হলে, সংঘকর্মে, বাসস্থানে বন্যজন্তু কিংবা
দস্যু-ডাকাতদের উপদ্রব হলে, বাসস্থান ভেঙে গেলে, অগ্নিদগ্ধ বা পুড়ে গেলে এবং
বিহারের দায়ক-দায়িকার মধ্যে ঝগড়া-বিবাদের সৃষ্টি হলে।
উপোসথ দিবসে ব্যক্তি আত্মসংযম, আত্মশাসন ও চিত্ত-সাধনাকে নিয়ন্ত্রণ
করে। সব ধরনের অকুশল চিন্তা ও কর্ম থেকে বিরত রাখে। ব্যক্তি তার নানা ধরনের
কুচিন্তা, কুমানসিকতা এবং অসৎ প্রবণতা থেকে নিজেকে দূরে রাখে। এজন্য বৌদ্ধ
জীবনবিধানে বর্ষাবাস ও উপোসথ ধ্যান সাধনার উত্তম পথ বলে বিবেচ্য। এটি প্রজ্ঞা
লাভেরও একটি উত্তম কর্ম। দুঃখ নিবৃত্তি এবং নির্বাণ সাধনার জন্যও এটি একটি উত্তম
বা মহৎ সাধনপথ বলে বৌদ্ধশাস্ত্রে উল্লেখ আছে। এজন্যই বৌদ্ধরা ত্রৈমাসিক বর্ষাবাসকে
অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। ধর্মের মূল শিক্ষা হলো আত্মসংযম, আত্মবিশুদ্ধি এবং
নিজেকে মানবিক ও মনুষ্যত্ব গুণে পরিপূর্ণ করা। বৌদ্ধ বর্ষাবাসের শিক্ষাও অনুরূপ।
আসুন আমরা এই বর্ষাবাসের তাৎপর্য অনুধাবন করি এবং আত্মসংযম, আত্মজ্ঞান
ও আত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হই। সব ধরনের মন্দ ও অনৈতিক কর্ম থেকে বিরত থাকি। শীলবান হই,
সতত সৎ জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ হই। সব ধরনের মানবিক গুণ লাভ করি। সমাজ ও দেশের জন্য
মঙ্গল কর্ম করি, শান্তি কামনা করি। সবাই মঙ্গল লাভ করুক। বাংলাদেশ সমৃদ্ধ হোক।
বিশ্বে শান্তি বিরাজ করুক।