Loading..

মুজিব শতবর্ষ

০৯ আগস্ট, ২০২৩ ০৫:৪০ অপরাহ্ণ

সাংবাদিক শেখ মুজিব 2

১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনের কিছু আগে বিখ্যাত সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমদ হক সাহেবের কৃষক প্রজা পার্টি ছেড়ে মুসলিম লীগে যোগ দেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী যখন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী, তখন হাশেম-সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের উদ্যোগে দৈনিক ইত্তেহাদ বের হয় কলকাতা থেকে।

১৯৯ পার্ক স্ট্রিটে ছিল ইত্তেহাদ অফিস। আবুল মনসুর আহমদ হন সম্পাদক। পত্রিকাটি তরুণ প্রজন্মের বাঙালি মুসলমান পাঠকদের মধ্যে বিশাল জনপ্রিয়তা লাভ করে।

আবুল মনসুর আহমদের দৃষ্টি ছিল প্রতিশ্রুতিশীল তরুণদের দিকে। তিনি তাদের সাংবাদিকতার দিকে টানতে চেয়েছেন। তিনি দৃষ্টি দিয়েছিলেন শেখ মুজিব ও তফাজ্জল হোসেন মানিক (পরবর্তীকালে ঢাকায় দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক) মিয়ার দিকে।

মানিক মিয়া চাকরি নিয়েছিলেন ইত্তেহাদের ব্যবস্থাপনা বিভাগে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ইত্তেহাদে দু-চার কলম লিখতেন। তিনি তাকে সাংবাদিক হওয়ার জন্য উৎসাহিত করেন। শেখ মুজিবকেও উৎসাহ দিয়েছিলেন।

কিন্তু শেখ মুজিব তাকে বলেছিলেন : মনসুর ভাই, মিল্লাতের মতো ইত্তেহাদেও আমি লিখব। কিন্তু সাংবাদিক হব না। সাংবাদিকতা আমার নেশা। কিন্তু পেশা রাজনীতি। আমি রাজনীতিক হব।

বঙ্গবন্ধুর মতো মানিক মিয়াও ছিলেন মুসলিম লীগের হাশেম-সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের সমর্থক। একই রাজনৈতিক আদর্শের অনুসারী।

সম্ভবত কলকাতায় শহীদ সোহরাওয়ার্দীর থিয়েটার রোডের বাসা অথবা ইত্তেহাদের পার্ক স্ট্রিটের অফিসে শেখ মুজিব ও মানিক মিয়ার পরিচয়, এই পরিচয় পরে ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়। স্থাপিত হয় বড় ভাই ও ছোট ভাইয়ের সম্পর্ক। বঙ্গবন্ধু মানিক মিয়াকে ডাকতেন মানিক ভাই। মানিক মিয়া তাকে ডাকতেন মুজিবর মিয়া।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুজিব-মানিক মিয়া জুটির অভ্যুদয় এক ঐতিহাসিক ঘটনা। একজন রাজনৈতিক নেতা, অপরজন সাংবাদিক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে এই দুটি নাম ইতিহাসে সমানভাবে উচ্চারিত হবে। মানিক মিয়াকে বঙ্গবন্ধু কতটা সম্মান করতেন তার প্রমাণ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকার সবচেয়ে বড় রাস্তাটির নামকরণ মানিক মিয়া এভিনিউ করা।

বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে আমার আগেকার এক লেখায় লিখেছি, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় বরিশালে ১৯৪৯ সালে। আমি নবম শ্রেণির ছাত্র জেনে বলেছিলেন, ‘মেট্রিক পাস করে ঢাকায় এলে আমার সঙ্গে দেখা করো।’

১৯৫০ সালে মেট্রিক পাস করে ঢাকায় আসি এবং বঙ্গবন্ধুকে (তখন মুজিব ভাই ডাকি) খুঁজতে গিয়ে তাকে পাই পুরান ঢাকার কারকুন বাড়ি লেনের সাপ্তাহিক ইত্তেফাক অফিসে। বাংলা ভাগের পর মানিক মিয়া কলকাতা থেকে বরিশালে তার বাড়ি ভাণ্ডারিয়া চলে যান।

ঢাকায় তখনও আসেননি। মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবের উদ্যোগে সাপ্তাহিক ইত্তেফাক প্রকাশিত হয়। অফিস ছিল কারকুন বাড়ি লেনে। সম্পাদক ছিলেন ফজলুর রহমান খান।

মুজিব ভাই ইত্তেফাকের সেই সপ্তাহের লেখাজোকা সম্পর্কে সম্পাদকের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন। আমাকে দেখে খুব খুশি হলেন। তিনি আমাকে ইত্তেফাক অফিসে এসে মাঝে মাঝে লেখাজোকার ব্যাপারে সাহায্য করতে অনুরোধ জানালেন।

বললেন, তিনিও ইত্তেফাকে নিয়মিত না হলেও লিখছেন। রাজনৈতিক ব্যস্ততার জন্য সময় পাচ্ছেন না। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ঢাকায় এলে শেখ মুজিবই তাকে ডেকে এনে সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের সম্পাদকের পদ গ্রহণে সম্মত করান। পরে মানিক ভাই যখন ’৫৪ সালের নির্বাচনের আগের বছর দৈনিক ইত্তেফাক প্রকাশ করেন, তখনও তাকে সাহায্য জোগান মুজিব ভাই।

শেখ মুজিব নিজে পত্রিকা বের করেন ১৯৫৬ কী ১৯৫৭ সালে। নাম সাপ্তাহিক ‘নতুন দিন’। তিনি নিজে ছিলেন প্রধান সম্পাদক এবং কবি জুলফিকার ছিলেন সম্পাদক। কবি জুলফিকার ছিলেন মুজিব ভাইয়ের রাজনীতির ঘনিষ্ঠ অনুসারী। পত্রিকাটি কিছুদিনের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

এই সময় বঙ্গবন্ধু একটি আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলনের নাম ‘দুই অর্থনীতির আন্দোলন’। ঢাকার মাহবুব আলী ইন্সটিটিউটে (এখন আছে কি না জানি না) দুই অর্থনীতির দাবিতে তিনি একটি সম্মেলন করেন। তাতে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকসহ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদরা যোগ দিয়েছিলেন। এমনকি পাকিস্তানভক্ত অধ্যাপক সাজ্জাদ হোসেনও যোগ দিয়েছিলেন।

এই সভায় শেখ মুজিব বলেন, পাকিস্তানের শাসকরা পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের উৎপাদিত পণ্যের কনজুমার মার্কেটে পরিণত করার চক্রান্ত করছে। পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পোন্নয়নের কোনো ব্যবস্থাই তারা করছেন না। এমনকি কৃষি ব্যবস্থারও সংস্কার করছেন না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, পূর্ব পাকিস্তানে ভূমি কম, এখানে শিল্পোন্নয়ন দরকার। পশ্চিম পাকিস্তানে অনাবাদি ভূমি বিস্তর। সেখানে কৃষি উন্নয়নের ব্যবস্থা হওয়া সঙ্গত। কিন্তু পাকিস্তানের অবাঙালি কেন্দ্রীয় সরকার শিল্পোন্নয়ন ও কৃষি উন্নয়ন দুটোই চালাচ্ছেন পশ্চিম পাকিস্তানে।

পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে তারা অধিকৃত উপনিবেশের মতো ব্যবহার করছেন। তার পাট থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রাও পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে ব্যবহৃত হচ্ছে।

শেখ মুজিব শুধু দুই অর্থনীতি নিয়ে বক্তৃতা দিয়েই ক্ষান্ত হননি, তিনি তার সম্পাদিত নতুন দিন কাগজে ধারাবাহিকভাবে প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন- দুই অর্থনীতি কেন? এই প্রবন্ধে তিনি বলেন, পাকিস্তানের দুই অংশের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং অর্থনৈতিক চাহিদা সম্পূর্ণ ভিন্ন।

এই অবস্থায় বাস্তবতাকে স্বীকার করে দেশের দুই অংশের জন্য দুই ধরনের অর্থনীতি প্রণয়ন ও অনুসরণ দরকার। তার এই প্রবন্ধটি তখন পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী মহলে সাড়া তৈরি করেছিল। নতুন দিন পত্রিকাটি কারও সংগ্রহে আছে কি না জানি না।

কারও কাছে থাকলে তা থেকে এই প্রবন্ধটি গ্রন্থাগারে প্রকাশিত হলে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাভাবনায় যে তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই বাঙালির স্বার্থ অধিকারের কথা প্রাধান্য পেয়েছে তা বোঝা যেত। দুই অর্থনীতির আন্দোলন থেকে ছয় দফার আন্দোলন এবং তা থেকে স্বাধীনতার যুদ্ধ- এই ইতিহাসই বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।

লেনিন বিপ্লবী রাজনীতিক হয়েও সাংবাদিকতা করতেন। নির্বাসিত জীবনে লন্ডন থেকে রুশ ভাষায় ইসক্রা নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করতেন। সেই পত্রিকাই ছিল রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের মুখপত্র।

বঙ্গবন্ধুও রাজনৈতিক জীবনের পাশাপাশি সংবাদপত্র বের করেছেন, যা ছিল বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের একটি দীপশিখার মতো। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করার পর শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়। নতুন দিনের প্রকাশ সামরিক সরকার বন্ধ করে দেয়। বঙ্গবন্ধুর সাংবাদিকতা সম্পর্কে আরও তথ্য আমার জানা আছে। ভবিষ্যতে সময় ও সুযোগ পেলে তা লিখব।

লন্ডন, ১৫ মার্চ, রবিবার, ২০২০

আরো দেখুন