Loading..

মুজিব শতবর্ষ

১০ আগস্ট, ২০২৩ ১০:১৪ পূর্বাহ্ণ

বিশ্ব মানবতাবাদী শান্তির দূত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।

বিশ্ব মানবতাবাদী শান্তির দূত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব

বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যময় কাজটি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির একটি জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা; এর ভিত্তি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধ। তাৎপর্যপূর্ণ এই জন্য যে, বাঙালির জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায়ের এই লড়াই ও যুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শ্রমিক-কৃষক ও নিুবর্গের মানুষ। বিশ্ব ইতিহাসে জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার সংকীর্ণতা, ফ্যাসিবাদের উত্থান, বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে হিটলারের জার্মানিতে নাৎসিদের মানবতাবিরোধী অপরাধ, মুসেলিনির ইতালিতে ফ্যাসিবাদের তাণ্ডব ও স্পেনীয় গৃহযুদ্ধে জাতীয়তাবাদীদের হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন।

খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের (‘মুজিববাদ’ গ্রন্থের প্রণেতা) সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি তার জাতীয়তাবাদী চিন্তা ও আদর্শের চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন :

‘জাতীয়তাবাদ উগ্রতা কিংবা সংকীর্ণতায় পর্যবসিত হলে হিটলারের জার্মানি, মুসোলিনির ইতালি, ডক্টর ভেরউর্ডের দক্ষিণ আফ্রিকা, পাঞ্জাবি খানদের পাকিস্তান বা ইসরাইলের ইহুদিবাদের মতো অতি জঘন্য রূপ ধারণ করতে পারে। সে জাতীয়তাবাদ দক্ষিণপন্থি ও প্রতিক্রিয়াশীল জাতীয়তাবাদ। কিন্তু আমার জাতীয়তাবাদ বামপন্থি ও প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদ। নাৎসি জার্মানি, ফ্যাসিবাদী পাঞ্জাব, বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইহুদিবাদের মতো উগ্র ও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের চরিত্র ও এর বিকাশধারা লক্ষ করলে দেখতে পাবেন যে একচেটিয়া পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও নয়া-উপনিবেশবাদ এবং আমলাতন্ত্র ও জঙ্গিবাদ উগ্র ও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের মূল শক্তি। তারা গণতন্ত্রেরও শত্রু, সমাজতন্ত্রেরও শত্রু। তাদের জাতীয়তাবাদ শোষকদের জাতীয়তাবাদ। আমার জাতীয়তাবাদ শোষিতের জাতীয়তাবাদ। কারণ, আমার জাতীয়তাবাদের নেতৃত্বে রয়েছেন কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণির সমন্বয়ে গঠিত আওয়ামী লীগ। কাজেই যে জাতীয়তাবাদ আমার মতবাদের অন্যতম প্রধান অঙ্গ, সেই বিপ্লবী ও প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদ ফ্যাসিবাদে রূপান্তরিত হওয়ার কোনো ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও বাস্তব কারণ নেই।’

আরেক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘সাম্প্রদায়িকতাবাদ এদেশের মাটিতে গভীর শিকড় গেড়ে বসে আছে। একে নির্মূল করে তবেই এ দেশের শ্রেণিচেতনার বিকাশসাধন সম্ভব। আর একমাত্র শ্রেণিচেতনাই আন্তর্জাতিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির পূর্বশর্ত। এদেশের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, শ্রেণিচেতনা বিকাশের পথে সাম্প্রদায়িকতা প্রধান অন্তরায়। আর সাম্প্রদায়িকতাবাদ নির্মূল করার রণকৌশল হিসাবেই আমি জাতীয়তাবাদী দর্শন অনুসরণ করেছি। এই মতবাদ কার্যকরী হলে আমার বিশ্বাস, এদেশের ভাবীকালের মানুষ ক্রমে ক্রমে জাতীয়তাবাদের গণ্ডি পার হয়ে উত্তীর্ণ হবে বিশ্বমানবতাবাদী উদার দৃষ্টিভঙ্গিতে।’

জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতা হিসাবে তিনি সারা জীবন বিশ্বমানবতাবাদী উদার দৃষ্টিভঙ্গি লালন করেছেন, যার প্রতিফলন আমরা তার আন্দোলন-সংগ্রামেও যেমন দেখি, তেমনই রাষ্ট্র পরিচালনায়ও তার সমন্বয় দেখি। তার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা আজীবন লালিত আদর্শেরই যৌক্তিক উদ্ভাসন।

২.

একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হলেও বঙ্গবন্ধু জধফরপধষ ছিলেন না। তার হৃদয়ে তখনও রক্তক্ষরণ-পাকিস্তানিদের নির্মম গণহত্যার ক্ষতচিহ্ন। তবু নতুন রাষ্ট্রে তিনি শান্তি ও সম্প্রীতির কথা বলেছেন। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রেখেছেন। চরমপন্থায় বঙ্গবন্ধু বিশ্বাসী ছিলেন না। বরং আজীবন লালিত আদর্শ গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, মানবতাবোধকে তিনি সমুন্নত রেখেছেন। বঙ্গবন্ধু আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের পাশাপাশি তিনি ব্রতী হয়েছিলেন সংবিধান রচনায়।

বস্তুত, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাষ্ট্রস্বপ্নের মূল দর্শন ছিল মানবতাবাদ। যার মূলে ছিল দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর অভিব্যক্তি। জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্তিকেও দেখেছেন দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে। তিনি জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কার লাভ করেন ১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর, যা বিশ্বশান্তি পরিষদ কর্তৃক ১৯৭৩ সালের ২৩ মে ঢাকায় আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তাকে দেওয়া হয়। ২০ নভেম্বর আওয়ামী লীগ আয়োজিত সংবর্ধনা সভায় তার প্রদত্ত বক্তব্য এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘কিন্তু আমরা যারা দুঃখী মানুষ, যাদের শতকরা আশিজন মানুষ আজ পেট ভরে খেতে পায় না, তারা আমরা দুনিয়ায় শান্তি চাই, তাদের সকলের কাছে সহযোগিতা চাই-যাতে আমরা দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারি। আমরা শান্তি কায়েম করতে পারি।’

বঙ্গবন্ধুর এই বিশ্বমানবতাবাদী শান্তির দর্শন আজও প্রাসঙ্গিক যুদ্ধ ও অশান্তিপীড়িত পৃথিবীতে।

আরো দেখুন