সহকারী শিক্ষক
৩০ আগস্ট, ২০২৩ ০৯:৪৬ অপরাহ্ণ
লেন্সকে বলা হয় ‘ক্যামেরার চোখ’কেন?
যেভাবে কাজ করে ক্যামেরার লেন্স
লেন্সকে বলা হয় ‘ক্যামেরার চোখ’। কাঙ্ক্ষিত কোনো
বস্তু বা দৃশ্যের ছবি তোলার পর ছবিটা দেখতে কেমন হবে, তার ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলে লেন্স।
ফটোগ্রাফি থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজে
যারা দক্ষ হতে চান, ক্যামেরার লেন্স কীভাবে কাজ
করে বুঝতে পারাটা তাদের জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এমনকি ছবি তোলার কাজে আগ্রহী আর কৌতূহলী সাধারণ
মানুষও ক্যামেরা ব্যবহারে দক্ষ হয়ে উঠতে পারেন লেন্সের কার্যক্রম বোঝার মাধ্যমে।
তাই এবার ফোকাস দূরত্ব বা ‘ফোকাল লেন্থ’ থেকে শুরু
করে অ্যাপার্চার, শাটার স্পিড কিংবা আইএসও এর মত
লেন্স এর সাথে সম্পর্কিত জরুরি সব ধারণা নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে।
একইসঙ্গে বিভিন্ন ধরনের লেন্স এর কাজ এবং কোন
ধরনের ছবি তোলার জন্য কোন লেন্স ব্যবহার করতে হয়, সে ব্যাপারেও বলা হবে এখানে।
.
# ক্যামেরার লেন্স যেভাবে কাজ
করে
লেন্স অনেকটা মানুষের চোখের মত একই পদ্ধতিতে কাজ
করে। মূলত ক্যামেরার সঙ্গে যুক্ত লেন্স এর কাজ হল ক্যামেরায় প্রবেশ করা আলোর
পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা।
প্রতিটি লেন্সের ভেতরেই উত্তল এবং অবতল আকারের
একাধিক ক্ষুদ্র ও সূক্ষ্ম যন্ত্রাংশ থাকে। এসব যন্ত্রাংশ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে
ক্যামেরার ওপর পড়া আলো নির্দিষ্ট কোণে বাঁকানো হয়। মূলত এই আলো প্রতিসরণের
মাধ্যমেই নির্দিষ্ট একটি বস্তু বা দৃশ্যের ওপর ক্যমেরার ফোকাস ঠিক করা হয়।
.
# ‘ফোকাল লেন্থ’ বা ফোকাস দূরত্বের
অর্থ কী? আর তা কীভাবে কাজ করে?
প্রতিটি লেন্সেরই একটি নির্দিষ্ট ‘ফোকাল লেন্থ’
থাকে, যাকে ম্যাগনিফিকেশন নাম্বারও বলা হয়। ‘ফোকাল লেন্থ’
সাধারণত মিলিমিটারে পরিমাপ করা হয়।
প্রতিটা লেন্সের গায়েই ফোকাল লেন্থ এর ব্যাপ্তি
লেখা থাকে। ছবি তোলার সময় লেন্স ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এর ফোকাল লেন্থ ঠিক করা হয়।
ফোকাল লেন্থ যত বেশি হবে, লেন্সের ম্যাগনিফিকেশন বা বিবর্ধন তত বেশি হবে। ফটোগ্রাফিতে
‘ম্যাগনিফিকেশন’ বলতে কোনো কিছুকে তার আসল আকারের চেয়ে বড় করে দেখার ক্ষমতাকে
বোঝায়।
ফোকাল লেন্থ যত কম হবে, লেন্স এর ম্যাগনিফিকেশন তত কম হবে। উদাহরণস্বরূপ, ২০০ মিলিমিটার ফোকাল লেন্থের একটি লেন্সের তুলনায় ২৪ মিলিমিটার ফোকাল
লেন্থের একটি লেন্স থেকে কম ম্যাগনিফিকেশন পাওয়া যাবে।
.
# অ্যাপার্চার বা ‘এফ-নাম্বার’
কী? এবং তা কাজ করে কীভাবে?
সহজ কথায়, কোনো
লেন্সের আলোক গ্রহণ ক্ষমতাই হল সেই লেন্স এর অ্যাপার্চার। অ্যাপার্চার দিয়ে এমন এক
প্রবেশপথকে বোঝানো হয়, যার মাধ্যমে ক্যামেরার সেন্সরে
কতখানি বাইরের আলো প্রবেশ করবে, তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
মানুষের চোখের মণির মতই লেন্স এর অ্যাপার্চার
নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আমাদের চোখের মণি যেমন এর ওপর পড়া আলোর ওপর নির্ভর করে
প্রসারিত বা সংকুচিত হয়, তেমনি ছবি তোলার সময় পরিবেশের
আলোর ওপর নির্ভর করে নিয়ন্ত্রণ করা যায় লেন্স এর অ্যাপার্চার।
ফটোগ্রাফিতে কোনো লেন্সের অ্যাপার্চারকে
‘এফ-নাম্বার’ বা ‘এফ-স্টপ’ এর মাধ্যমে পরিমাপ করা হয়। এবং লেন্সের গায়ে সাধারণত
অ্যাপার্চারের মাত্রা লেখা থাকে এভাবে: “F/4.5 - 5.5”।
অর্থাৎ কোনো লেন্সের গায়ে “F/4.5 - 5.5” সংখ্যার উল্লেখ থাকার অর্থ হল ফোকাল লেন্থ এর ওপর নির্ভর সেই লেন্সটির
সর্বনিম্ন অ্যাপার্চার f/4.5 থেকে f/5.5 এর মধ্যে পরিবর্তন করা যাবে।
সাধারণত, ‘এফ-স্টপ’
এর মান যত ছোট হবে, অ্যাপার্চার এর ওপেনিং বা প্রবেশপথ তত
বড় হবে। একইভাবে ‘এফ-স্টপ’ এর মান যত বড় হবে, অ্যাপার্চার
এর ওপেনিং বা প্রবেশপথ হবে তত ছোট।
.
# ‘ডেপথ অফ ফিল্ড’ বা ক্ষেত্রের
গভীরতা
ছবির বিষয়বস্তুর ‘ডেপথ অফ ফিল্ড’ বা ক্ষেত্রের
গভীরতাও নিয়ন্ত্রণ করা হয় অ্যাপার্চার এর মাধ্যমে। মূলত ছবির বিষয়বস্তুকে এর
ব্যাকগ্রাউন্ড বা পটভূমি থেকে আলাদা করতে ব্যবহার করা হয় ‘ডেপথ অফ ফিল্ড’।
f/1.8 এর মত ‘এফ-স্টপ’ এর মান
যদি কম হয়, তাহলে বিষয়বস্তু স্পষ্টভাবে ফোকাস করা যাবে
এবং ব্যাকগ্রাউন্ড হয়ে উঠবে মৃদু ঝাপসা। আবার ‘এফ-স্টপ’ এর মান f/16 এর মত বড় হলে ‘ডেপথ অফ ফিল্ড’ বা ক্ষেত্রের গভীরতাও বাড়বে। এর ফলে ছবির
বিষয়বস্তু সহ এর ব্যাকগ্রাউন্ডও ফোকাস করা সম্ভব হবে।
.
# ‘শাটার স্পিড’ বা
আলোকসম্পাতকাল
‘শাটার স্পিড’ শব্দটা থেকেই এর
অর্থ বোঝা যায়। ছবি তোলার মুহূর্তে ক্যামেরার লেন্স এর শাটার বন্ধ হওয়ার গতিই হল
এর শাটার স্পিড। শাটার স্পিড এর গতি দ্রুত হলে ছবি তোলার সময় লেন্সে কম আলো পড়বে।
একইভাবে শাটার স্পিড এর গতি ধীর হলে লেন্সে পড়া আলোর পরিমাণ বেশি হবে।
.
# আইএসও কী? কীভাবে কাজ করে আইএসও?
ক্যামেরায় থাকা সেন্সর আলোর প্রতি কতটা সেন্সিটিভ
বা সংবেদনশীল হবে, তা নিয়ন্ত্রণ করা যায় আইএসও
দিয়ে। উজ্জ্বল দিনের আলোতে ছবি তোলার সময় কিংবা আলোকিত কোনো জায়গার দৃশ্য ধারণ
করার সময় আইএসও এর মান ১০০ বা ২০০ এর মত কম রাখতে হয়।
আবার আইএসও এর মান বাড়িয়ে ৩২০০ বা ৬৪০০ এর মত ঠিক
করা হলে তখন কম আলোতেও দৃশ্য ধারণ করা যায়।
তবে আইএসও এর মান বাড়ালে তাতে ছবির মান খারাপ হয়ে
আসে। তাই ছবির মান বজায় রাখার জন্য আইএসও এর মান যতটা সম্ভব কম রাখা ভাল।
.
# ‘এক্সপোজার ট্রায়াঙ্গেল’
ছবি তোলার ক্ষেত্রে অ্যাপার্চার, শাটার স্পিড এবং আইএসও, এই তিনটি বিষয় খুবই
গুরুত্বপূর্ণ। এবং এই তিনটি বিষয় একটা আরেকটার ওপর নির্ভরশীল। তাই ভাল ছবি তুলতে
হলে এই তিন বিষয়ের মধ্যে থাকা সম্পর্ক ভালভাবে বুঝতে হয়। সাধারণত এই তিনটি বিষয়কে
একত্রে ‘এক্সপোজার ট্রায়াঙ্গেল’ বলা হয়ে থাকে।
ছবি তোলার সময় আশেপাশের পরিবেশ ও পরিস্থিতির ওপর
নির্ভর করে ‘এক্সপোজার ট্রায়াঙ্গেল’ ঠিক করতে হয়।
যেমন কম আলোর পরিবেশেও আইওএস এর মান কম রেখে শাটার
স্পিড-এর দ্রুততা বাড়িয়ে সুন্দর ছবি তোলা যায়, যদি
অ্যাপার্চার এর মান f/2.8 এর মত কম ঠিক করা হয়।
মূলত অ্যাপার্চার এর মান কম রাখলে লেন্সের মধ্য
দিয়ে বেশি পরিমাণ আলো প্রবেশ করতে পারে।
অন্যদিকে, অল্প
আলোতে অ্যাপার্চার এর মান f/16 এর মত বাড়ানো হলে লেন্সের
মধ্য দিয়ে সীমিত পরিমাণ আলো প্রবেশ করে। তখন স্পষ্টভাবে ছবি তুলতে হলে আইএসও এর
মান বাড়াতে হয় বা শাটার স্পিড এর দ্রুততা কমাতে হয়।
.
# বিভিন্ন ধরনের লেন্স এবং ফোকাল
লেন্থ
বিভিন্ন আকার ও দৈর্ঘ্যের লেন্স রয়েছে। ভিন্ন
ভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করতে এসব লেন্স কাজে লাগানো
হয়।
.
• জুম লেন্স
জুম লেন্সের বিভিন্ন রকম ফোকাল লেন্থ থাকে। ফলে
প্রয়োজন অনুসারে ফোকাল লেন্থ ঠিক করে এই লেন্স দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ছবি তোলা যায়।
পেশাদারভাবে যারা ছবি তোলেন, তাদের অনেকেই জুম লেন্সকে প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন। বিশেষ করে যেসব
ফটোগ্রাফার ভ্রমণ করেন এবং একাধিক লেন্স বহন করতে চান না, তাদের অনেকের কাছেই জুম লেন্স ক্যমেরার অপরিহার্য এক অংশ।
.
• প্রাইম
লেন্স
যে লেন্সে কেবলমাত্র একটি ফোকাল লেন্থ থাকে, সেটাকে প্রাইম লেন্স বলে। প্রাইম লেন্স দিয়ে ছবি তোলার সময় জুম করা যায়
না।
তবে অনান্য লেন্সের তুলনায় প্রাইম লেন্স-এ উপাদান
বা যন্ত্রাংশ থাকে কম। ফলে এই লেন্স দিয়ে তোলা ছবির মান অনেক উন্নত হয়।
প্রাইম লেন্স এর অ্যাপার্চার ভ্যালুও কম থাকে। এ
কারণে এই লেন্স দিয়ে তোলা ছবিতে এক ধরনের অগভীর ‘ডেপথ অফ ফিল্ড’ বা ক্ষেত্রের
গভীরতা তৈরি হয়। তাই কারো পোর্ট্রেট ছবি তোলা থেকে শুরু করে পণ্য প্রচারণার জন্য
প্রোডাক্ট ফটোগ্রাফির মত যে ধরনের ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড হালকা ঝাপসা করার প্রয়োজন হয়, সেসব ছবি তুলতে প্রাইম লেন্সই সবচেয়ে উপযুক্ত।
আবার, প্রাইম
লেন্স-এ অ্যাপার্চার এমনভাবে নির্ধারণ করা থাকে যেন ক্যামেরায় বেশি পরিমাণে আলো
প্রবেশ করতে পারে। ফলে অল্প আলোর পরিবেশেও প্রাইম লেন্স দিয়ে সুন্দর ছবি তোলা
সম্ভব হয়।
.
• টেলিফটো
লেন্স
মূলত বড় ফোকাল লেন্থযুক্ত লেন্সকে টেলিফটো লেন্স
বলে। দূরের বিষয়বস্তুর দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করার জন্যে টেলিফটো লেন্সই সবচেয়ে
উপযুক্ত।
বন্যপ্রাণীর ছবি তোলার সময় কিংবা ক্রীড়াবিদদের
ছবি তোলার সময় এ ধরনের লেন্স ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে পশু বা ক্রীড়াবিদদের
কাছে না গিয়েও জুম করে তাদের ছবি তুলতে পারেন ফটোগ্রাফাররা।
.
• ওয়াইড
অ্যাঙ্গেল লেন্স
তুলনামূলক অল্প ফোকাল লেন্থযুক্ত লেন্সকে ওয়াইড অ্যাঙ্গেল
লেন্স বলে। এর সাহায্যে বড় পরিসরে দৃশ্য ধারণ করা যায়।
কোনো স্থাপত্যকর্ম বা দালানের অভ্যন্তরে ছবি তোলার
জন্য কিংবা ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্স সবচেয়ে
উপযুক্ত।
.
• ম্যাক্রো
লেন্স
ম্যাক্রো লেন্সের মাধ্যমে অত্যন্ত কাছের বিষয়বস্তুও
জুম করা যায় ও এর ফোকাস ঠিক করা যায়। কোনো বস্তুকে তার বাস্তব আকারের চেয়ে বড়
করে এবং আরো বিশদভাবে ছবিতে ফুটিয়ে তোলা যায় ম্যাক্রো লেন্স দিয়ে।
পোকামাকড় বা ফুলের মত যেকোনো ক্ষুদ্র বস্তুকে বড়
করে দেখার জন্যে এবং সূক্ষ্মভাবে সেটার দৃশ্য ধারণ করার জন্য ম্যাক্রো লেন্স
আদর্শ।
.
# বিশেষায়িত অন্যান্য লেন্স
সাধারণত ওপরে উল্লিখিত ৫ ধরনের লেন্সই বেশি
প্রচলিত। তবে এর বাইরেও কিছু বিশেষায়িত ক্যামেরা লেন্স রয়েছে। এসব লেন্স এর
সাহায্যে বাস্তবের তুলনায় একেবারে ভিন্নভাবে কোনো বস্তু বা দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি
করা যায়।
অনেক ধরনের বিশেষায়িত লেন্স রয়েছে। এর মধ্য
প্রধান কয়েকটির উদাহরণ দেয়া হল:
.
• ফিশআই
লেন্স
ফিশআই লেন্স দিয়ে ক্যামেরার চারপাশে সম্পূর্ণ ১৮০
ডিগ্রি ব্যাসার্ধের দৃশ্য ধারণ করা যায়। ফলে একে ‘আল্ট্রা ওয়াইড অ্যাঙ্গেল
লেন্স’ও বলা হয়। এই লেন্স দিয়ে তোলা ছবি বাস্তবের তুলনায় অনেকটা বিকৃত দেখায়। যেমন, ফিশআই লেন্স দিয়ে তোলা একটি ঘর দেখতেও বুদ্বুদের মত মনে হবে। মূলত এই
লেন্স দিয়ে তোলা ছবির এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই ‘ফিশআই লেন্স’ এর এমন নামকরণ করা
হয়েছে।
.
• টিল্ট-শিফট
লেন্স
টিল্ট-শিফট লেন্স দর্শকের ছবি দেখার পারস্পেক্টিভ
বা দৃষ্টিকোণ পাল্টে দেয়। যেমন, ছবির বিষয়বস্তুকে তার আসল
আকারের চেয়ে ছোট করে দেখানো যায় টিল্ট-শিফট লেন্স দিয়ে।
.
• ইনফ্রারেড লেন্স
এই লেন্স দিয়ে ক্যামেরায় কোন ধরনের আলো আসবে, তা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। মূলত ইনফ্রারেড লেন্স দিয়ে ছবি তোলার সময়
ক্যামেরায় ইনফ্রারেড বা অবলোহিত আলো ছাড়া অন্য কোনো আলোর তরঙ্গ আসতে পারে না। এতে
করে এই লেন্স দিয়ে তোলা ছবিতে অসাধারণ সব রঙ ফুটে ওঠে।
সৌঃ সি বি