প্রভাষক
২১ অক্টোবর, ২০২৩ ০৩:০৪ অপরাহ্ণ
একজন আদর্শ শিক্ষকের গুণাবলি গুলি কী কী হওয়া প্রয়োজন?
একজন আদর্শ শিক্ষকের গুণাবলি গুলি কী কী হওয়া প্রয়োজন?
Quality of Teachers
শিক্ষকের গুণাবলি (Quality of Teacher)
জন অ্যাডামস শিক্ষককে “Maker of Man” বলে অভিহিত করেছেন। তিনি আরও বলেছেন, “শিক্ষক হলেন জাতির আলোকবর্তিকাবাহী এবং মানবজাতির ভবিষ্যৎ রূপকার।”
আধুনিক শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিক্ষকের ভূমিকা গৌণ হলেও শিক্ষকের সাহায্য ছাড়া কোনো শিক্ষা- সম্ভব নয়। যে-কোনো শিক্ষাকে ফলপ্রসূ করতে হলে চাই আদর্শ শিক্ষক। আদর্শ শিক্ষক হতে গেলে কতকগুলি বিশেষ গুণ থাকা প্রয়োজন। আদর্শ শিক্ষকের গুণগুলিকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়, তা হল :
১. ব্যক্তিগত গুণাবলি (Personal Qualities) : একজন আদর্শ শিক্ষকের যেসকল ব্যক্তিগত গুণাবলি থাকা প্রয়োজন, তা হল :
(i) চরিত্রবান : একজন আদর্শ শিক্ষক হবেন চরিত্রবান। তিনি আদর্শের প্রতীক হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন। ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ এই প্রসঙ্গে বলেছেন, “Their (Teacher) own character should be such that there is no difference between what they say and do.” অর্থাৎ, তাদের চরিত্রে, কথায় ও কাজে কোনো পার্থক্য থাকবে না।
(ii) দায়িত্বশীল : শিক্ষক হবেন দায়িত্বশীল। শিক্ষকের ব্যক্তিগত আচার-আচরণ শিক্ষার্থীদের মনের ওপর গভীর রেখাপাত করে। শিক্ষক দায়িত্বের সঙ্গে শিক্ষার কাজগুলি করবেন।
(iii) ব্যক্তিত্বের অধিকারী : শিক্ষক হবেন সুব্যক্তিত্বের অধিকারী। শিক্ষার্থীর সঙ্গে তাঁর আচরণ হবে প্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ। তিনি শিক্ষার্থীর সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে মেলামেশা করবেন। তাঁর ব্যক্তিত্বের মাধুর্যে শিক্ষার্থী ও সমাজ তাঁর প্রতি সহজেই আকৃষ্ট হবে।
(iv) নিয়মানুবর্তিতা : শিক্ষক তাঁর প্রতিটি কাজেই নিয়মানুবর্তিতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। তাঁর এই নিয়মানুবর্তিতাবোধ শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিফলিত হবে।
(v) সুস্বাস্থ্যের অধিকারী : একজন আদর্শ শিক্ষক হবেন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। অর্থাৎ, তিনি হবেন নীরোগ শরীরের অধিকারী। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হলে তিনি কাজে উৎসাহিত হবেন।
(vi) প্রগতিশীলতা : শিক্ষক হবেন চিন্তায় এবং আচরণে প্রগতিশীল। তার দৃষ্টিভঙ্গি যথেষ্ট উদার ও ব্যাপক হবে।
(vii) ধৈর্যশীল : একজন আদর্শ শিক্ষক হবেন ধৈর্যশীল। ধৈর্য ধরে বিভিন্ন শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করবেন। এই ধৈর্যশীলতাই সকল শিক্ষার্থীকে শিক্ষাগ্রহণে উৎসাহিত করবে।
(viii) ন্যায়-নিরপেক্ষ : আদর্শ শিক্ষক ন্যায় ও নিরপেক্ষ গুণের অধিকারী হবেন। তিনি সকল শিক্ষার্থীর কাছে সমান। কারও প্রতি তিনি পক্ষপাতিত্ব করবেন না।
(ix) সুবিবেচক : শিক্ষক হবেন সুবিবেচক। শিক্ষকের মধ্যে থাকবে প্রবণতা, ধৈর্য, সহানুভূতি, সহযােগিতা প্রভৃতি। তিনি যেসকল কাজ করবেন তা বিচক্ষণতার সঙ্গেই করবেন।
(x) মানসিক স্বাস্থ্যসম্পন্ন : শিক্ষক মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকারী হবেন। তাঁর মধ্যে ক্ষোভিক ভারসাম্য থাকবে। তিনি রাগ, অস্থিরচিত্ত, খামখেয়ালি এইসকল সমস্যা থেকে দূরে থাকবেন।
(xi) ছাত্রপ্রেমী : আদর্শ শিক্ষক হবেন ছাত্রপ্রেমী। তিনি শিক্ষার্থীর বন্ধু, দার্শনিক এবং পথপ্রদর্শক হিসাবে কাজ করবেন।
(xii) পেশার প্রতি ভালোবাসা : একজন শিক্ষক প্রথমে শিক্ষক হবেন এবং শেষেও শিক্ষক থাকবেন। অর্থাৎ, তাঁর পেশার প্রতি সবসময় ভালোবাসা থাকবে।
(xiii) নৈর্ব্যক্তিকতা : আদর্শ শিক্ষকের ব্যক্তিগত একটি বিশেষ গুণ হল নৈর্ব্যক্তিকতা। শিক্ষকের কোনাে বিশেষ শিক্ষার্থীর বিশেষ দল বা বিশেষ মতবাদের ওপর তাঁর পক্ষপাতিত্ব থাকা বাঞ্ছনীয় নয়।
(xiv) উন্নত জীবনাদর্শ : একজন আদর্শ শিক্ষকের উন্নত জীবনাদর্শ থাকা প্রয়ােজন। শিক্ষকতাকে কেবল বৃত্তি হিসাবেই গ্রহণ। না -করে ব্রত হিসাবে বিদ্যাদান কর্তব্য। এই প্রসঙ্গে Roofinae বলেছেন, “The teacher is like the candle which lights others in consuming itself.”
(xv) জ্ঞানপিপাসু : শিক্ষক হবেন জ্ঞানপিপাসু। তিনি সারাজীবন ধরে জ্ঞান আহরণে সচেষ্ট হবেন, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞান অর্জনে উৎসাহিত করবে।
(২) পেশাগত গুণাবলি (Professional Quality : একজন আদর্শ শিক্ষকের যেসকল পেশাগত গুণাবলি থাকা দরকার, তা হল :
(i) বিষয়বস্তুর জ্ঞান : একজন আদর্শ শিক্ষকের শিক্ষণীয় বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। শিক্ষকতা বৃত্তিতে সফল হতে হলে শিক্ষককে রীতিমতাে জ্ঞানচর্চা করতে হবে।
(ii) মনােবিদ্যার জ্ঞান : শিক্ষকের মধ্যে শিশু-মনোবিদ্যার জ্ঞান থাকতে হবে। শিশুর বিকাশ এবং তৎ-সংক্রান্ত সমস্যাবলির সম্পর্কে জানতে শিশু-মনোবিদ্যা বিশেষভাবে সাহায্য করে।
(iii) শিক্ষণ পদ্ধতির জ্ঞান : শিক্ষকের শুধু বিষয়বস্তুর জ্ঞান থাকলেই চলবে না, সেই জ্ঞান শিক্ষার্থীদের মধ্যে কীভাবে সঞ্চালিত করা যাবে সেই সম্পর্কে শিক্ষকের জ্ঞান থাকা দরকার।
(iv) শিক্ষাপােকরণ ব্যবহার সম্পর্কে জ্ঞান : শিক্ষকরা বিভিন্ন ধরনের শিক্ষাপােকরণ ব্যবহার করে শিক্ষণ শিখন পদ্ধতিকে সজীবন ও সার্থক করে তােলে। তাই শিক্ষকের বিভিন্ন ধরনের শিক্ষাপোকরণ যেমন – চার্ট, চিত্র, ম্যাপ, প্রাফ, দৃষ্টি ও শ্রুতিনির্ভর প্রভৃতির ব্যবহারকৌশল-এর জ্ঞান থাকা দরকার।
(v) মূল্যায়ন সম্পর্কিত জ্ঞান : শিক্ষার্থীদের পারদর্শিতার অগ্রগতি পরিমাপের জন্য বর্তমানে বিদ্যালয়ে পরীক্ষা গ্রহণের রীতির অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। প্রচলিত বা গতানুগতিক রচনাধর্মী পরীক্ষার পরিবর্তে নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। কীভাবে নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি এবং শিক্ষার্থীদের জন্য সার্বিক পরিচয়লিপি তৈরি করতে হয় সে সম্পর্কে শিক্ষকের জ্ঞান থাকা দরকার।
(vi) সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি পরিচালনা : শিক্ষার্থীর বৌদ্ধিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সার্বিক বিকাশ ঘটাতে গেলে প্রয়ােজন সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি। তাই সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি পরিচালনায় শিক্ষকের জ্ঞান থাকা দরকার।
(vii) বিদ্যালয় পরিচালনার জ্ঞান : একজন আদর্শ শিক্ষকের পেশাগত গুণ হিসাবে পেশাগত নিয়মকানুন যেমন জানা দরকার তেমনি বিদ্যালয় সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য পরিচালন-সংক্রান্ত জ্ঞান থাকা দরকার।
(viii) গবেষণামূলক মনোভাব : একজন আদর্শ শিক্ষকের একটি অন্যতম পেশাগত গুণ হল তার গবেষণামূলক মনোভাব বা পরীক্ষামূলক মনােভাব। তিনি যে-কোনো বিষয় নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখবেন এবং শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করবেন।
(ix) প্রশ্নকরণের দক্ষতা : শিক্ষক প্রশ্নকরণের দক্ষতা অর্জন করবেন। তিনি সঠিক প্রশ্ন সঠিকভাবে উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে শ্রেণিকক্ষকে আরও গতিশীল করে তুলতে পারবেন।
(৩) নাগরিক হিসাবে গুণাবলি : একজন আদর্শ শিক্ষকের ব্যক্তিগত এবং পেশাগত গুণাবলি ছাড়াও আরও কিছু নাগরিক গুণাবলি দেখা যায়, তা হল :
(i) সমাজসেবী : একজন আদর্শ শিক্ষক অবশ্যই সমাজসেবী হবেন। সামাজিক দায়দায়িত্ব পালন তার পক্ষে অতি আবশ্যিক কর্তব্য। শিক্ষার্থীদেরও সেবামূলক কাজে উৎসাহিত করবেন অর্থাৎ, তিনি সেবামূলক মানসিকতা নিয়ে কাজ করবেন।
(ii) রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য : শিক্ষক এক রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য থাকবে। রাষ্ট্রের উন্নয়নের দিকে লক্ষ্য রেখে তিনি তার দায়িত্ব পালন করবেন।
(iii) নাগরিকের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা : শিক্ষক কেবল নিজে সুনাগরিক হবেন তা নয়, ছাত্রদেরও উপযুক্ত নাগরিক হিসাবে গঠন করার প্রয়াসী হবেন।
সুতরাং, একজন আদর্শ শিক্ষকের কর্মসফলতার জন্য এই তিন ধরনের গুণাবলি সমানভাবে প্রয়োজন। তবে অনেক শিক্ষার্থী মনে করেন, শিক্ষকের যেমন কিছু গুণাবলি জন্মগত, তেমনি কিছু গুণাবলি অর্জিত। তাই বলা যায়, শিক্ষক যেমন জন্মায় তেমনি তৈরিও করা যায়।
মোঃ সাখাওয়াত হোসেন
প্রভাষক
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
আগানগর ডিগ্রি কলেজ,
বরুড়া, কুমিল্লা।
সেরা কনটেন্ট নির্মাতা ও
ICT4E at a2i
(সূত্রঃ অনলাইন ডেস্ক )