Loading..

উদ্ভাবনের গল্প

০৭ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০৪:৪০ অপরাহ্ণ

শিক্ষার্থীদের প্রতি ভালবাসা, প্রাপ্তি অপরিমেয়

২০০২ সালে বি.এস-সি পাসের পরই শিক্ষকতা শুরু। ককসবাজারের দীপশিখা একাডেমিতে অনেকটা বিনা পয়সায় চারমাসের শিক্ষকতা। সেখান থেকে ফুফাত ভাইয়ের দীর্ঘ ছুটির শুণ্যতা পূরণে ইলিয়াছ মিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে যাই। শিক্ষকতার প্রতি নেশা আরও বাড়ে। ইত্যবসরে পারিবারিকভাবে প্রেমের বিয়ে সম্পন্ন হয়। পকেট খালি। এক সময় জব্বারিয়া মাদ্রাসায় পড়ানোর জন্য চুক্তিবদ্ধ হই। মাস শেষ না হতেই কৈশরের স্মৃতি বিজড়িত ঈদগাহ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে ডাক পাই। যে সব আলোকিত হৃদয়ের স্যারেরা আমাকে পড়িয়েছেন তাঁদের সাথে চেয়ারে বসতে গিয়ে সে এক অন্যরকম অনুভূতি! নতুন নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করছি। ইতোমধ্যে জানলাম, সরকারী টাকা পেতে এমপিও-ভুক্ত হতে হয় এবং শুণ্যপদ না থাকায় এখানে স্থায়ী হওয়ার সুযোগ নেই। অপরদিকে, স্কুলের বিভিন্ন বিষয়ে ম্যানেজিং কমিটির দলাদলি শুরু হওয়ায় তাদের যাঁতাকলে আমিও পিষ্ট হলাম। মাসের চাকরীতে আমাকে মোট হাজার টাকা সম্মানী দিতে উনাদের খারাপ লাগেনি। আমি কষ্ট পেলাম।


এমপিওভুক্ত হওয়ার আশায় বিভিন্ন স্কুলে পরীক্ষা দিলেও ধরা দেয়নাসোনার হরিণ লিখিত পরীক্ষায় টিকলাম তো ভাইভাতে আউট। যিনি টিকলেন তিনি অমুকের আত্মীয়! কেউবা অনেক বছর ধরে স্কুলে পড়িয়েছেন নিয়োগের আশায়! কষ্টের মাত্রা বাড়লেও শিক্ষকতার নেশা কমেনা। শের আলী স্যার বলতেন, ‘শিক্ষকতায় চল্লিশা (৪০দিন পূর্ণতা) পার হলে নেশা কাটানো কঠিন!’


ইতোমধ্যে বর্তমান চাকরীস্থল ঈদগাহ আদর্শ শিক্ষা নিকেতনে কম্পিউটার শিক্ষকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলো। মনছবিতে নিয়োগের স্বপ্ন কিন্তু সহকর্মী জসিম স্যার বললেন তাঁর জন্য পরীক্ষা দিতে হবে! আমার জন্যও ব্যাংক ড্রাফটসহ কাগজপত্র রেডি করে তিনি জমা দিলেন। পছন্দের পদে অন্যের জন্য পরীক্ষা দেব ভেবে মন খারাপ। সকাল ১১ টায় নিয়োগ পরীক্ষা। অথচ হাইস্কুলে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে শিক্ষার্থীদের ফি উঠাচ্ছি আমি। জসিম স্যারের অবিরত ফোন দেখে রশিদ স্যার বললেন, ‘তুমি যাও, টাকাগুলো আমি বুঝিয়ে দেবো।হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।



সাড়ে ১১ টায় পৌঁছে দেখি আমার অনুপস্থিতিতে কোরাম সংকট, পরীক্ষা স্থগিত। প্রসংগত, তখন স্কুলে চুক্তিভিক্তিক চাকরি করা এক শিক্ষকের জন্য জোর লবিং হয়েছে। জসিম স্যারের পক্ষেও তাই। দুইপক্ষ নিয়োগ কমিটিকে বুঝিয়ে পরীক্ষা নেওয়ার জন্য রাজি করালেন। লিখিত পরীক্ষায় প্রথম হয়ে ভাইভা দিলাম। অপর দুপ্রতিযোগীর জোর লবিং স্বত্ত্বেও পরওয়ারদেগারের ইচ্ছায় আমি নির্বাচিত হলাম। এপ্রিল ২৪, ২০০৪ যোগদান করে সেপ্টেম্বরে এমপিও-ভুক্ত হই।



স্বাচ্ছন্দ্যে পথা চলা শুরু। কোন শিক্ষক বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকলে গ্যাপক্লাস নিই। ইংরেজী, বাংলা, রসায়ন, গণিত কোনটিই বাদ ছিলনা। মাঝে মাঝে কষ্ট হতো। বুঝলাম, আমি অনুপস্থিত থাকলে আমার ক্লাসের জন্য অন্যের অনভূতিও বোধহয় এমনই হবে। প্রতিদিনই স্কুলে যাই। বছর শেষে দেখা গেলো, মাত্র দিন ছুটি নিয়েছি। সহকর্মীদের প্রশংসায় অনুপ্রাণিত হয়ে পরের বছর একদিনও না। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আমাকে হাজার টাকা দিয়ে সম্মানিত করলেন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতার স্ত্রী। সময় এগিয়ে চলছে। বছর শেষে আমার ছুটি মাত্র দিন! বরেণ্য উপস্থাপক হানিফ সংকেত বিষয়টি জেনে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানইত্যাদিতে নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক হিসেবে প্রতিবেদন করলেন। বিদ্যালয়ে শুটিং পরবর্তী শালবন বৌদ্ধ বিহারের উম্মুক্ত মঞ্চে অজস্র দর্শকের সামনে শিক্ষার্থী পেশাকে অন্যরকম ভালবাসার প্রতি সম্মান জানিয়ে তিনি দুটি কম্পিউটার উপহার দেন। ২৯ মে ২০০৯ বিটিভি বিটিভি ওয়ার্ল্ডে তা প্রচার হলে দেশ-বিদেশ থেকে ধন্যবাদ আর শুভকামনায় অভিসিক্ত হতে লাগলাম। বিশ্ব শিক্ষক দিবসে পেলামবিএসবি ফাউন্ডেশন এওয়ার্ড শুভেচ্ছা আর প্রতিদান প্রাপ্তিতে হৃদয় ফুরফুরে।


ঈদের ইত্যাদিতে আবারও প্রত্যন্ত অঞ্চলের আলোকিত মানুষদের সাথে ইনডোর স্টেডিয়ামে। পলান সরকারদের সাথে মঞ্চে বসা এবং এন্ড্রু কিশোর সাবিনা ইয়াছমিনের সাথে মানবিক গানে অংশগ্রহণে সে এক অন্যরকম অনুভূতি! ২০১১ সালের ১৯ মে এবং ২০১৪ সালের ১৬ নভেম্বর দেশের প্রথম সারির দৈনিক প্রথম আলোয় আমার শিক্ষকতার উপর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ২০১২ এবং ২০২২ সালের জিপিএ প্রাপ্তদের সংবর্ধনায় আমাকেও সংবর্ধিত করে প্রথম আলো বন্ধুসভা। ২০২৩ সালের ১৬ মার্চ লাভ করি ‘আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা ২০২২’।


শিক্ষকতার পাশাপাশি বর্তমানে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম বিস্তরণের মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে নিয়োজিত আছি।শিক্ষকতায় ১৯ বছর পেরিয়েছে গত ২৪ এপ্রিল। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আমার দুরে থাকা দিনই! শিক্ষার্থী পেশাকে ভালবেসে প্রাপ্য ছুটি ভোগ না করার অন্যরকম নেশা আমার। নেশা শিক্ষার্থীদের ভালবাসার, নেশা সমাজকে আলোকিত মানুষ উপহার দেবার। আমি বিশ্বাস করি, স্ব-অবস্থান থেকে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ভালবাসা পেলে এদেশের শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তি নির্ভর বিশ্বমানের শিক্ষায় সমৃদ্ধ হবে, দেশের কল্যাণে কাজ করবে। ... সব শিক্ষার্থীর জন্য ভালবাসা।

আরো দেখুন